৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৩৯:২১ অপরাহ্ন


ডাকা প্রাপকদের আটক অব্যাহত
সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি থেকেও বাড়ছে অনিশ্চয়তা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৮-২০২৫
সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি থেকেও বাড়ছে অনিশ্চয়তা ডিফার্ড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস (ডাকা)


সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির অস্থিরতার মধ্যে আবারও আতঙ্ক বাড়ছে ডিফার্ড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড অ্যারাইভালস (ডাকা) প্রাপকদের মধ্যে। যদিও এই কর্মসূচি মূলত অপ্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে আসা অনথিভুক্ত অভিবাসীদের সাময়িক কর্মসংস্থান অনুমতি ও বহিষ্কার থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য চালু হয়েছিল, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তার বাস্তবতা ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। সম্প্রতি হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সহকারী সচিব ট্রিসিয়া ম্যাকলাফলিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ডাকা কোনো বৈধ আইনগত মর্যাদা দেয় না।’ তিনি আরো একধাপ এগিয়ে জানিয়েছেন, যে কোনো ডাকা প্রাপককে আটক ও বহিষ্কার করা যেতে পারে এবং তাদের স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ করার আহ্বানও জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্য প্রকাশের পরই মাঠপর্যায়ে নানা জায়গায় গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে। বিমানবন্দর, কর্মক্ষেত্র এমনকি মুদি দোকানের সামনে থেকেও ডাকা প্রাপকদের আটক করার খবর আসছে।

এল পাসো, টেক্সাসে কর্মসূত্রে বিমানে ওঠার সময় আটক হন ডাকা প্রাপক ক্যাটালিনা সোচিটল সান্তিয়াগো। কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই তাকে আটক করে অভিবাসন হেফাজতে পাঠানো হয়েছে এবং বর্তমানে তার অবস্থান অনিশ্চিত। একইভাবে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ডাকা প্রাপক হাভিয়ের দিয়াজ সান্তানা কর্মস্থলে অভিযানের সময় আটক হন। তিনি পরিচয় জানানোর চেষ্টা করলেও তার যোগাযোগের সরঞ্জাম কেড়ে নেওয়া হয়। প্রায় এক মাস তাকে এল পাসোর একটি ডিটেনশন সেন্টারে আটক রাখা হয় কোনো আইনজীবী বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ ছাড়াই। আরো মর্মান্তিক বিষয়, তাকে যে কাগজপত্র দেওয়া হয়েছিল তা ছিল স্প্যানিশ ভাষায় যা তিনি পড়তে পারেন না। আরেক ডাকা প্রাপক হোসে ভালদোভিনোসকে আটক করা হয়েছিল তার স্ত্রীর সঙ্গে গাড়িতে বসা অবস্থায়। যখন তার স্ত্রী প্রশ্ন করেন কেন তাকে নেওয়া হচ্ছে, কর্মকর্তারা সাফ জানিয়ে দেন, ‘ডাকা আর বৈধ স্ট্যাটাস নয়।’ তার স্ত্রী পাল্টা জানালেও যে স্বামী বৈধ কর্মপারমিট নিয়ে কাজ করছেন, কর্মকর্তারা বলেন, ‘তা কোনো ব্যাপার নয়।’ এরপরই তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আটক করা হয়।

আইনগতভাবে ডাকা এখনো কার্যকর। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের অস্পষ্ট ও পরস্পরবিরোধী মন্তব্য মাঠপর্যায়ে গ্রেফতার অভিযানে রূপ নিচ্ছে। ঠিক কোন নির্দেশে বা কেন এ প্রাপকদের টার্গেট করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট নয়। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি প্রশাসনিক ধারা পরিবর্তনের শুরু, সেটিও অনিশ্চিত। এর ফলে প্রাপকদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি আরো গভীর হচ্ছে। প্রাক্তন এক ডাকা প্রাপক বলেন, এই ভয় কেবল নীতিমালার কাগজ থেকে আসে না, বরং ক্ষমতাধর কেউ যখন বেপরোয়া মন্তব্য করে তখনই সেই ভয়ের ঢেউ পৌঁছে যায় আমাদের ঘরে। তার মতে, ডাকা প্রাপকদের জীবনযাপন সব সময়ই অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল। তারা পরিবার গড়েছে, কাজ করেছে, কর দিয়েছে কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল অস্থায়ী ভরসার ওপর দাঁড়ানো। এখন সেটুকুও টলমল করছে।

ডাকা কর্মসূচি শুরু হয় ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে। এটি কখনো কংগ্রেসের অনুমোদন পায়নি। ফলে প্রতিটি নতুন প্রশাসনের নীতি পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে এ কর্মসূচি। ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম মেয়াদেই ডাকা বাতিলের উদ্যোগ নেয়। তবে ২০২০ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট সেই সিদ্ধান্ত আটকে দেয় এবং প্রাপকদের সুরক্ষা বহাল রাখে। কিন্তু স্থায়ী সমাধান না থাকায় প্রায় ৬ লক্ষাধিক তরুণ অভিবাসীর জীবন আইনি অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঝুলে আছে।

বর্তমানে রিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রণাধীন কংগ্রেসে অভিবাসন আইন সংস্কার নিয়ে কোনো কার্যকর আলোচনা এগোচ্ছে না। রিপাবলিকানরা কড়া সীমান্ত নীতি ও ব্যাপক বহিষ্কারের দাবি তুলছে, অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা ডাকা প্রাপকদের স্থায়ী বৈধতার পক্ষে আইন পাস করাতে চাইছে। কিন্তু দ্বিদলীয় সমঝোতার অভাবে কোনো প্রস্তাবই অগ্রগতি পাচ্ছে না। হোয়াইট হাউস বলছে, স্থায়ী সমাধান কেবল কংগ্রেসের আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই সম্ভব। কিন্তু আইনগত অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত হওয়ায় ডাকা প্রাপকেরা এখন আরো বেশি করে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে, প্রশাসনের এই ধোঁয়াশাপূর্ণ বার্তা মাঠপর্যায়ে ইমিগ্রেশন এজেন্টদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দিচ্ছে। এতে আইনি সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও মানুষ আটক ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ধরনের পদক্ষেপ শুধু অমানবিকই নয়, এটি আইনের শাসনেরও পরিপন্থী। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় ডাকা প্রাপকের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৮০ হাজার। তাদের বড় অংশই ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ইলিনয়, নিউইয়র্ক, অ্যারিজোনা ও ফ্লোরিডায় বসবাস করেন। গবেষণা অনুযায়ী, ডাকা প্রাপকরা প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলার যোগ করেন। শুধু কর হিসেবে তারা প্রতিবছর গড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রদান করেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি, কৃষি ও নির্মাণ খাতে তাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। এই তথ্য প্রমাণ করে, ডাকা প্রাপকেরা শুধু নিজেরাই টিকে নেই, বরং অর্থনীতি ও সমাজে সক্রিয় অবদান রাখছেন।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন আর সাময়িক সমাধান যথেষ্ট নয়। ডাকা প্রাপকদের জন্য স্থায়ী বৈধতার পথ তৈরি করা জরুরি। কারণ প্রতিদিনের এ অনিশ্চয়তা শুধু নীতি ব্যর্থতা নয়, এটি মানুষের জীবনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অভিবাসীরা স্পষ্টতা প্রাপ্য, আর ডাকা প্রাপকরা প্রাপ্য এমন এক সকাল, যেখানে তারা ভাবতে হবে না আজ কি সবকিছু হারাতে হবে কি না। ডাকা প্রাপকরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন, অথচ তাদের অস্তিত্বকে আজও সাময়িক কাগজের টুকরোর ওপর ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি নতুন প্রশাসনের রাজনৈতিক স্বার্থ আর ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে তারা যেন বলির পাঁঠা কখনো আশার আলো, কখনো আবার আতঙ্কের অন্ধকার।

এভাবে মানুষকে অনিশ্চয়তায় বাঁচিয়ে রাখা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে না। ডাকা প্রাপকরা অপরাধী নয়, তারা এ দেশের অংশ, তারা শ্রম দিয়ে অর্থনীতি এগিয়ে নিয়েছে, কর দিয়ে রাষ্ট্রকে শক্ত করেছে, তবুও আজ তারা অবমাননার শিকার। স্থায়ী বৈধতা থেকে তাদের বঞ্চিত রাখা কেবল নীতিগত ব্যর্থতা নয়-এটি সরাসরি নিষ্ঠুরতা। প্রতিদিন নতুন করে ভয় দেখানো, আটক করা আর পরিবারগুলোকে ছিন্নভিন্ন করা কোনো সরকারের নৈতিকতা হতে পারে না। ডাকা প্রাপকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি যুক্তরাষ্ট্র এখনো দ্বিধাগ্রস্ত থাকে, তবে এটিই স্পষ্ট বার্তা দেশটি তাদের শ্রম নিলেও মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে ব্যর্থ। এটি কেবল খারাপ নীতি নয়, এটি এক নির্মম প্রতারণা।

শেয়ার করুন