২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৫:৩৭:৫৩ অপরাহ্ন


প্রান্তিক কৃষককে কারাগারে পাঠানোতে তোলপাড়
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-১১-২০২২
প্রান্তিক কৃষককে কারাগারে পাঠানোতে তোলপাড় প্রতীকী ছবি


‘দুর্ভিক্ষ আসছে। কোনো খালি জমি ফেলে রাখা যাবে না। আবাদ করতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না।’ সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পেতে কৃষিভিত্তিক কর্মকা-ের ওপর প্রচ- চাপ দেয়া হচ্ছে। কারণ টাকা দিয়ে তো আমদানি করা যাবে না। আমদানি করতে ডলার প্রয়োজন। কিন্তু দেশে ডলার সংকট। তাহলে কীভাবে বাঁচবে মানুষ। তাই তো কৃষিকাজে গুরুত্ব দিতে বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। 

তার এ আহ্বান কী শুধু কৃষকদের জন্যই। আর কী কারোরই দায় নেই, আছে। তবু এখন কৃষকরাই মূল ভরসা। তারা ফসল ফলাতে পারলে আমদানি কম করতে হবে। ডলারটা কম লাগবে। কিন্তু সেই গুরুত্বানুসারে ১২ কৃষককে সামান্য ২৫ হাজার টাকার খেলাপির জন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হতো না। শুধু ১২ জনকে গ্রেফতারই করা হয়নি। মোট ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলাও  গ্রেফতারি পরোয়ানা যাদের মধ্যে বাকি ২৫ জন ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। চলছে গ্রেফতার আতঙ্ক। এই একই ঘটনায় ব্যাংক থেকে লোন নেয়া দেশের সর্বত্র যে কৃষক সমাজ সবার মধ্যেই এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। কৃষকদের গ্রেফতার আতঙ্কটা এ মুহূর্তে কতটা জরুরি ছিল সেটা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রীতিমতো তোলপাড় দেশে।

দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি হওয়াদের সাফাই গেয়ে চলেন যে দেশের অর্থমন্ত্রী। সে দেশে একজন কৃষক ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে ঋণখেলাপি হওয়ারও যুক্তি থাকতেই পারে। কারন করোনা মহামারীতে যেখানে মানুষ দিশেহারা ছিল। ফসল ফলাতে যেয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল ফলাতে না পেরে যেখানে ব্যাংকের অর্থ দিতে ব্যর্থ হন। সেখানে তাকে সুযোগ দেয়াটা খুব বড় কোনো বিষয় না। কিন্তু সরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান এভাবে মামলা করে সামান্য কটা টাকার জন্য কৃষককে মামলা দিয়ে জেলে নিয়ে গেলে দেশের চাষাবাদের কী বড় কোনো উপকার হয়ে যাবে? 

এখনো সরকারের অনেক মন্ত্রী ও এমপিরা বলে বেড়ান। বিগত সরকারের সময়ে বিএনপি সরকার সারের জন্য গুলি করে ১৭ কৃষক হত্যা করা হয়েছিল। তাই এ সরকার কৃষকবান্ধব ও কৃষিবান্ধব। তাহলে সে কৃষককে সামান্য অপরাধে জেলে নিয়ে যাওয়া কীসের ম্যাসেজ? এ সরকারও কী তাহলে সেই সময়ের বিএনপি পথে? 

এমন প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক যে ফসল ফলান, তার ন্যায্যমূল্য কোনোদিনই পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা সব ভোগ করে যাচ্ছেন এ নিয়ে অনেক রিপোর্ট, অনেক সমালোচনা সর্বপর্যায়ে। ফলে কৃষক এমনিতেই বিপাকে। সেই কৃষক ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে যদি দিতে একটু দেরি করেন, তার জন্য মামলা হবে? জেলে নিতে হবে? 

আইএমএফের ঋণখেলাপি তথ্য 

সরকার বা আইন আদালত যদি এতোই কঠিন হয়, আইন যদি সবার জন্যই  সমানভাবে চলে। দেশের প্রকৃত ঋণখেলাপি এক লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশে ঋণখেলাপির পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকার ওপরে। তিন লাখ কোটিতে কত হাজার টাকা হবে? বা এক কোটি ৩৪ হাজার কোটি টাকাতে একজন কৃষকের ৩০ হাজার টাকার পরিমাণে কত বেশি অপরাধ? কিন্তু তাদের কেউই কী জেলে গেছেন? আইন আদালত বা সরকার কী তাদের জেলে পাঠাতে পেরেছেন? 

২০০৯ সনে বর্তমান সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশে ঋণখেলাপির পরিমাণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। গত তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সে পরিমাণ এখন কোথায় যেয়ে ঠেকছে বলে রিপোর্ট রয়েছে। 

কিছুদিন আগে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম এক নিবন্ধে লিখেছেন যে, ‘খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। পাচার হওয়া অর্থ কখনোই ফেরত আসবে না। পাচার হওয়া অর্থে বিদেশে বাড়ি কিনেছে পাচারকারীরা, সম্পত্তি কিনেছে। পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে অনেকেই এখন ওই সব দেশে আসা-যাওয়া করছে। একটা পর্যায়ে তারাও চলে যাবে। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকট তার নেপথ্যে রয়েছে খেলাপি ঋণ ও দুর্নীতির অর্থ বিদেশে পাচার বেড়ে যাওয়া।’ 

এ ব্যাপারে প্রতিটা বাজেটে বিদেশ থেকে পাচার হওয়ার টাকা দেশে এনে ডিক্লেয়ার করলে বিশেষ রেয়ায়েত দেয়ার সুবিধা ঘোষণা করছে সরকার। বারবার ঘোষণা হয় কালোটাকা সাদা করার নিয়মাবলি এবং উৎসাহ দেয়া হচ্ছে জামাই আদারে। সেখানে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ঘটনা এখন সারাদেশে মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন। 

কীভাবে ঘটেছে ঘটনা 

ঘটনার স্থান পাবনা, ঈশ্বরদী থানা। এ উপজেলার একটি ‘বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক’ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার অভিযোগে করা একটি মামলায় ৩৭ জন কৃষকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। এতে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১২ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পরবর্তীতে তাঁদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এসব প্রান্তিক কৃষকরা হলেন, ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারি গ্রামের শুকুর প্রামাডুকের ছেলে আলম প্রামাডুক (৫০), মনি মন্ডলের ছেলে মাহাতাব মন্ডল (৪৫), মৃত সোবহান মন্ডলের ছেলে আবদুল গডু মন্ডল (৫০), কামাল প্রামাডুকের ছেলে শামীম হোসেন (৪৫), মৃত আয়েজ উদ্দিনের ছেলে সামাদ প্রামাডুক (৪৩), মৃত সামির উদ্দিনের ছেলে নূর বক্স (৪৫), রিয়াজ উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আকরাম (৪৬), লালু খাঁর ছেলে মোহাম্মদ রজব আলী (৪০), মৃত কোরবান আলীর ছেলে কিতাব আলী (৫০), হারেজ মিয়ার ছেলে হান্নান মিয়া (৪৩), মৃত আবুল হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ মজনু (৪০) ও মৃত আখের উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ আতিয়ার রহমান (৫০)। 

মামলার সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে ঋণ নিয়েছিলেন ৩৭ জন কৃষক। এই ঋণ ফেরত না দেয়ার অভিযোগে ২০২১ সালে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরে আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।

কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে এ সকল কৃষক তাদের নেয়া ঋণের কথা স্বীকার করেছেন এবং তারা তা পরিশোধও করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন পরিশোধের পরও কেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারি পরোয়ানা এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।

শেয়ার করুন