যতটুকু চোখ যায় ইটের পর ইট পড়ে আছে। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দরজা-জানালা। পড়ে আছে রড আর চুন-সুরকি মিশ্রিত ভবনের বিভিন্ন অংশ। দেখে মনে হচ্ছে যেনো একটু আগেই ভবনটির ওপর কামানের গোলা পড়েছে। কিংবা কেউ যেনো মারাত্মক কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য দিয়ে ভবনটিকে ধ্বংস করতে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে। আসলে তা নয়। মাত্র কয়েকদিন আগে এই ভবনটির ওপর নির্মম আঘাত হানা হয়েছে উন্নয়নের নামে। এমন করুণ দৃশ্য দেখা গেলো পুরান ঢাকায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে। হাতুড়ি আর শাবলের নির্মম আঘাতে সম্পূর্ণ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে রাজধানীর বুকে পুরান ঢাকায় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের দুইশ বছরের পুরনো ভবনটি। দেখা গেলো মাত্র কয়েকদিন আগে স্কুলের প্রায় দুই শত বছরের পুরাতন ভবনটি আর নেই। এখন শুধু পড়ে আছে এর ধবংসস্তুপ। মনে হচ্ছিল ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে মহাউৎসবে ভবনটি ভাঙ্গা হয়েছে।
ভবনটির ঐতিহাসিক মূল্য
বাংলাদেশ তথা অখণ্ড ভারতের অবিভক্ত বাংলার প্রথম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। বিদ্যালয়টি ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাংলার প্রথম সরকারি স্কুল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ঢাকা কলেজ, ঢাকা কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। বলা হয়ে থাকে শিক্ষার এই ধারাবাহিকতার সূচনায় ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মহান ব্রত নিয়ে স্কুলটির প্রতিষ্ঠা। সূচনালগ্ন থেকেই দেশ ও বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিবর্গের বিদ্যাপীঠ হিসেবে বিদ্যালয়টি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ১৮৪১ সালে এ সেমিনারি থেকে ঢাকা কলেজের জন্ম হয়।
প্রাক্তন একজন ছাত্রের স্মৃতিতে
ঢাকায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ওই ভেঙ্গে ফেলা ভবনটির ব্যাপারে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র এখলাস উদ্দিন আহমেদ খান তার পুরোনো স্মৃতি বলতে গিয়ে বলেন, আমি ২০১৫ ব্যাচের ছাত্র। ভবনটিতে আমাদের প্রধান শিক্ষকের অফিস, সহকারী প্রধান শিক্ষকের অফিস, টিচার্স রুম, লাইব্রেরি, মসজিদ, ক্লাসরুম ছিল। এখানে একটি ছোট হলের মত জায়গা ছিল যেখানে ছোটবেলায় বোতল দিয়ে ফুটবল খেলার স্মৃতি আছে আনেকের।
কারো অনুরোধ রাখা হলো না
আরবান স্টাডি গ্রুপের একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী পরিচালিত সংস্থা। এরা পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষা করার আন্দোলন করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের এই ভবনটি ভাঙ্গা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে গত ২১ মার্চ আরবান স্টাডি গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবীরা প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলামের নেতৃত্বে ছুটে যায়। সেসময় এই ভবনটি পুরোপুরি অক্ষত ছিল, অর্থাৎ সবে মাত্র ভবনটির কয়েকটি স্থানে শাবল আর হাতুড়ির আঘাত হানা হয়। আর সে অক্ষত ভবনের সামনেই আরবান স্টাডি গ্রুপের সদস্যরাসহ মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। অবিভক্ত বাংলার এই প্রথম সরকারি বিদ্যালয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের পুরাতন ভবনটি ধ্বংসের প্রতিবাদে এর পাশাপাশি বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সিটিউট, সেভ দা হেরিটেজ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের এলামনাই এর সদস্যসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্কুল প্রাঙ্গনে মানব্বন্ধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। তারা হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে পুরান ঢাকার অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। এই কর্মর্সচি মানব বন্ধনের কর্মসূচির পর আন্দোলনকারীদের একটি দল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে সাক্ষাত করে এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ধ্বংস বন্ধ করার জন্য অনুরোধ জানান হয়। এ সময় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা বিষয়টি তাকে অবহিত করা হলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক জানান যে, ভবনটির বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে জানান হয় এটি সংরক্ষিত ভবনের তালিকাভুক্ত নয়। তাছাড়া ভবন ধ্বংসের কার্যক্রম টিডিসি ঢাকা ও শিক্ষা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমেই করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনা শেষে আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলাম স্কুলের প্রধান শিক্ষক এর কাছে আদালাতের রায়ের একটি কপি হস্তান্তর করেন। এতে প্রধান শিক্ষক সন্তুষ্ঠ হয়েই উপস্থিত সকলের সামনে ভবন বন্ধ রাখবার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আরবান স্টাডি গ্রুপের সদস্যরা প্রধান শিক্ষকের আশ্বাস পেয়ে স্কুল প্রাঙ্গনের ত্যাগের পরপরই এদিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত শাবল হাতুড়ির নির্মম অত্যাচার চলে ভবনটি ওপর। মাটির সাথে ভবনটি প্রায় শতভাগ গুড়িয়ে দেয়া হয়। এপ্রসঙ্গে আরবান স্টাডি গ্রুপের একজন স্বেচ্ছাসেবক ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র এখলাস উদ্দিন আহমেদ খান আমেরকিা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকাকে জানান, ভবনটি ভাঙ্গা বন্ধ করতে তারা যেদিন এই কর্মসূচি পালন করছিল তখন পর্যন্ত ভবনটির মাত্র ৩৫ শতাংশ ভাঙ্গা হয়েছিল। ভবনের ভেতরের কিছু ছাদ ও দরজায় হাতুড়ি আর শাবলের আঘাত পরে। সামনের অংশ চারপাশে হাতুড়ে শাবলের আঘাত পড়েনি। কিন্ত তার ধারণা তারা চলে যাওয়ার পরই চলে ভবনটি ধবংসের সর্বশেষ তান্ডবললিা চালিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়।
স্থাপত্যশৈলী
প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ওই ভেঙ্গে ফেলা ভবনটির ভবনটি মূলত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গেস্টহাউস-অফিস ছিল। পরবর্তীতে এখানে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল স্থাপন করা হয়। ভবনের বিভিন্ন স্থানের ইট এবং স্থাপত্য শৈলী পর্যবেক্ষণ করলে এখানে জাফরী ইট (মূঘল আমলের পাতলা ইট) পাওয়া যায়। দিল্লীর সম্রাট হুমায়ুনের সমাধির পশ্চিম গেটের চারপাশে এমনকি বাংলাদেশের মাত্র অল্প কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনায় জাফরি ইটের স্থাপনা দেখা যায়। যদিও ভবনটি অনেকবার সংস্কার করা হয়। তবে মূল অংশটি মোঘল আমলের বলে ধারণা করা যায়, এখন ধবংস করে ফেলা হলো।
ভবন ভাঙ্গা বন্ধ রাখার হাস্যকর নোটিশ
এদিকে গত ২৮ মার্চ বৃহসপতিবার দুপুরে দেশ প্রতিনিধি সরজমিনে ঢাকায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখেন এক মর্মান্তিক দৃশ্য। প্রায় শতভাগ গুড়িয়ে দেয়া ওই ভবনের ধবংসস্তুপের এককোনেই ঝুলছে অস্পস্ট একটি নোটিশ। যাতে লেখা আছে ‘উধ্বতন কর্তপক্ষের টেলিফনিক নির্দেশে পুরাতন ভাঙ্গার কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকবে।’
শেষ কথা
সারা বিশ্বে প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনা রক্ষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়, দেয়া হয় সবোর্চ্চ গুরুত্ব। অথচ বাংলাদেশে চোখের সামনে একের পর এক ঐতিহাসিক স্থাপনা মাটির সাথে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। স্থাপত্যবিদরা মনে করেন কলেজইয়েট স্কুলের এই শতবর্ষী স্থাপনাটি ঝুঁকিপূর্ণ অজুহাতে ভেঙে ফেলার যে যুক্তি দেখান হচ্ছে তা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটি কে অতি সহজেই রেট্রফিটিং ও স্রেন্দেনিং পর আ্যাডাপ্টিভ রিইউসের মাধ্যমে নতুন ভবন নির্মাণের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নতুন ভবন হলে কোটি কোটি টাকার ব্যাপার যেখানে আছে সেখানে ঐতিহ্য তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। আর এমন মানসিকতা থেকে পুরোনো ঢাকায় একের পর এক স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। এখন প্রশ্নের পাশাপাশি আশঙ্কা সবার কাছে হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে সামনের দিনে পুরান ঢাকার আর আর কত ঐতিহাসিক স্থাপনা মাটির সাথে গুড়িয়ে দেয়া হবে? যেমনটা হাজার মানুষের চোখের সামনে ঘটে গেছে পুরান ঢাকার কোর্ট হাউস স্ট্রিটে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী নিলাম ঘরের বেলায়। হাইকোর্টের রায় লঙ্ঘন করে পুরান ঢাকার ১৫, ১৫/১ কোর্ট হাউস স্ট্রিটে অবস্থিত নিলাম ঘর নামে পরিচিত ১০০ বছর পুরনো ঐতিহ্যবাহী ভবনটি সবার চোখের সামনে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। যা রক্ষা করতে গিয়ে স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী স্থপতি তাইমুর ইসলামসহ স্বেচ্ছাসেবীরা মারাত্মক অপদস্থ ও হেনস্থার স্বীকার হয়েছিলেন।