২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ৬:৫০:৪৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :


প্রতারক চেনার ৯ উপায়
চাকরি ও ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে ৬৮ মিলিয়নের প্রতারণা
মো. জামান তপন
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-১২-২০২২
চাকরি ও ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে ৬৮ মিলিয়নের প্রতারণা


প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে ই-কমার্সের ব্যবহার সারা বিশ্বে বেড়েই চলছে। এর মধ্যে করোনা মহামারী কারণে মানুষ অনলাইনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে পড়েছে। করোনাকালীন সময়ে অনলাইন শপিং, ক্লাস, চাকরি, ব্যাংকিং এবং চিকিৎসাসহ সবই অনলাইনে অধিকতর নিরাপদ ছিল। বর্তমানে তা অনেকেটা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আর এই সুযোগ গ্রহণ করেছে কিছু অসাধু ব্যক্তি ও চক্র। তারা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অনলাইনে বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে সর্বস্বান্ত করছে। বিশ্বের বিভিন্ন ন্যায় এই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। আমেরিকাতে এই প্রতারণা দিন দিন বাড়ছে। প্রতারকদের নানা কৌশলে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরিহ নাগরিকরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রতারণা রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সাথে জনসচেতনতা সৃষ্টি চেষ্টা করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এসব প্রতারক অমেরিকায় নয় বিশ্বের অন্য দেশে বসে এই প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে। বহুদেশীয় প্রতারক চক্র ফোন কল, টেক্সট ম্যাসেজ, ই-মেইল বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে হরহামেশা প্রতারণা করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে তারা নিত্য নতুন ফন্দিফিকির করে জনগণকে ঠকাচ্ছে।

আমেরিকান ভোক্তারা বর্তমানে অন্যান্য প্রতারণার পাশাপাশি অনলাইন শপিংয়ে প্রতারিত হচ্ছেন। আমেরিকান এটলাস ভিপিএনের এক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত যে রিপোর্ট ফেডারেল ট্রেড কমিশন (এফটিসি) পাঠানো হয়। সেখানে দেখা যায় ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলার অনলাইনে প্রতারণা করা হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ ভাগ বেশি। প্রতারকরা ব্যবসার নামে অনলাইনে লোভনীয় মূল্যে বা অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য বিক্রয়ের জন্য অফার দেয়। এতে ভোক্তারা সরল মনে ক্রেডিট কার্ডে অর্ডার করেন। কিন্তু পণ্য কখনোই ভোক্তারা পান না। গত ৩০ মে ২০২২ সালে ট্রুকলারের হ্যারিস পোলের সাথে যৌথভাবে পরিচালিত প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, গত ১২ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমানভাবে ছড়িয়ে পড়া স্প্যাম এবং ফোন স্ক্যামের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। সমীক্ষাটি অনুমান করে যে গত বছর ফোন স্ক্যামের মাধ্যমে ৩৯.৫ বিলিয়ন ডলার প্রতারকরা হাতিয়ে নিয়েছে। যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।  প্রকাশিত সমীক্ষা মোতাবেক ৩৩ শতাংশ ভাগ আমেরিকান নাগরিকরা ফোন স্কেমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন এবং ২০ শতাংশ নাগরিক ন্যূনতম একাধিকবার বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ফোনকল স্কেমে গত ১২ মাসে গড়ে জনপ্রতি ৫৭৭ ডলার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। যা গত এক বছর আগে একই সময়ে ছিল জনপ্রতি গড়ে ৫০২ ডলার। অর্থাৎ প্রতারণা ১৪.৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর রবো কলের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছে ৬১.১ শতাংশ।

ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনের (এফসিসি) ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে জালিয়াতি নিয়ন্ত্রিত করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও (রবো কল/স্ক্যামারদের থেকে আমেরিকানদের রক্ষা করার লক্ষ্যে এফসিসি মানগুলির একটি সেট) গত ১২ মাসে প্রায় ৬৮.৪ মিলিয়ন আমেরিকান ফোন কেলেঙ্কারির শিকার হয়েছেন এবং ধারণা করা হয় যে স্ক্যামাররা সরকারি প্রবিধান লঙ্ঘন করছে এবং প্রতারণা করার আরো চতুর উপায় খুঁজে বের করছে। গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা বেশি প্রতারণার শিকার হন। গত ১২ মাসে যারা প্রতারিত হয়েছেন তাদের মধ্যে ৫৫.৬ শতাংশ ভাগ পুরুষ আর ৪২.২ শতাংশ ভাগ মহিলা। গবেষণায় আরো দেখানো হয় যে ফোন স্কেমে আর্থিকভাবে বয়স্কদের তুলনায় যুবকরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষত ১৮-৩৪ বছর বয়সী ৪৬ শতাংশ ভাগ, ৩৫-৪৪ বছর বয়স্ক ৫১ শতাংশ ভাগ এবং ৪৫-৫৪ বছর বয়সী ২৪ শতাংশ ভাগ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমেরিকার সিনিয়ার সিটিজেনরা (৬৫+) ও এসব প্রতারণা থেকে রেহাই পান না। পরিসংখ্যানে দেখা যায় কালো (৪৩ শতাংশ) এবং সাদা (৬৫ শতাংশ) প্রাপ্ত বয়স্কদের তুলনায় হিসপানিক উত্তরদাতাদের (৭৪ শতাংশ) রবো কলের জন্য অর্থ হারিয়েছেন। অপর দিকে ফেডারেল ট্রেড কমিশনের বরাত দিয়ে গত জুন ২০২২ এ প্রকাশিত খবরে জানা যায় এ বছর প্রথম কোয়ার্টারে বিভিন্নভাবে ভুয়া চাকরি ও ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারকরা ৬৮ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। সেই সাথে ব্যক্তিগত আর্থিক তথ্য, করোনা পরবর্তী আর্থিক সংকট, চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হওয়া সর্বোপরি মূল্যস্ফীতির কষাঘাতে মানুষ যখন জর্জরিত তখন সেই সুযোগে প্রতারকদের দৌরাত্ম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

এফটিসির মার্কেটিং অনুশীলন বিভাগের একজন অ্যাটর্নি এবং স্টাফের প্রধান রোন্ডা পারকিন্স বলেছেন, কর্মসংস্থান-সম্পর্কিত কেলেঙ্কারিগুলি একটি ক্রমাগত সমস্যা ছিল। তবে করোনা পরবর্তী ২০২০ সালে তা অনেক বেড়েছে। কারণ অপরাধীরা কোভিডের কারণে কাজ হারানো লোকদের প্রতারণা করেছে। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে ২০ হাজার ৭০০টিরও বেশি কেলেঙ্কারির ঘটনা রিপোর্ট করেছে। যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (আইআরএস) জুন মাসে জনসাধারণকে করোনাকালীন চলমান ট্যাক্স স্কেম এবং প্রতারকদের ভুয়া জবের স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্টের ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। প্রতারকরা নানাভাবে নান কৌশলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে। কখনো সরাসরি ফোনকল, কখনো ট্যাক্সট ম্যাসেজ বা ই-মেইলে। নামীদামি কোম্পানির নামে ভুয়া ওয়েটসাইট বানিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া কিংবা ভুয়া লিস্টিং জব সার্চ সাইটে ও ফেসবুকের মাধ্যমে। তবে যখনই কোনো কোম্পানি বা ওয়েবসাইট থেকে কোনো ফি চাইবে তখনই বুঝতে হবে এটা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ। সম্প্রতি এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিগত কয়েক বছরে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৩ লাখ ১২ হাজার নাগরিক বিভিন্নভাবে স্যোশাল সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এসএসএ) কর্মকর্তা সেজে বহুভাবে নবকৌশলে ৯৫ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। জানা যায়, সেই প্রতারক চক্র সরকারি কর্মচারী সেজে জনগণকে নানা ধরনের হুমকি দিয়ে গ্রেফতার বা আইনি ব্যবস্থা এড়াতে জরুরিভাবে তাদের পেমেন্ট দিতে বলা হয়। স্যোশাল সিকিউরিটি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে প্রতারকদের ফাঁদে না পড়ার জন্য সতর্ক করেছে। সেই সাথে বলেছে যে কোনো ব্যক্তি যদি এসএসএ বা আইআরএসকে কোনো অর্থ দেনা থাকে, তবে তার আপিলের অধিকারের সুবিধা রেখে পেমেন্ট অপশন দিয়ে পত্রযোগে পাওনা অর্থ চাইবে। কোনোভাবেই ফোনকল, টেক্সট বা ই-মেইলের মাধ্যমে নয়। সেখানে লেখা থাকবে আমরা ইলেকট্রনিক্যালি পে ডট গভের মাধ্যমে বা সশরীরে বা চেক কিংবা মানিঅর্ডার আমাদের অফিসের মাধ্যমে পেমেন্ট গ্রহণ করি। গত কয়েক বছরে এধরনের ১৮৪ জন প্রতারককে গ্রেফতার করেছে। সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারি সেজে যারা ফোনকল, টেক্সট ম্যাসেজ, ই-মেইল, চিঠিপত্র বা স্যোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করতে চায়, তাদের চেনা বা বোঝার কয়েকটি উপায় নিচে দেয়া হলো- ১. প্রতারকরা সোশ্যাল সিকিউরিটি নম্বর সাসপেন্ড করার হুমকি দেবে। ২. গ্রেফতার বা আইনিব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দেবে। ৩. দ্রুত পেমেন্ট দেয়ার জন্য চাপ বা অনুরোধ করবে। ৪. প্রাপ্য অর্থ গিফট কার্ড, প্রি-পেইড ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট কারেন্সী বা মেইল করে ক্যাশ পাঠাতে বলা। ৫.চাপ প্রয়োগ করবে ব্যাক্তিগত তথ্য জানার জন্য।  ৬. গোপন তথ্য জানতে অনুরোধ করা। ৭.ব্যাংক একাউন্ট জব্দের হুমকি প্রদান করা। ৮.স্যোসাল সিকিউরিটি বেনিফিট বৃদ্ধির প্রতিজ্ঞা করা। ৯.আস্থা অর্জনের জন্য জাল ডকুমেন্ট বা ভূয়া প্রমাণাদি বা একজন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার নাম ব্যবহার করা।

এছাড়া আমেরিকার নাগরিক বা বসবাসকারীদের পরিচয় তথ্য চুরির মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলছে। ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি সংক্রান্ত এফ টি সির রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ২০২২ সালে মাত্র ৬ মাসে ক্রডিট কার্ড জালিয়াতি ৬,০৩,৫৯১ টি। এর মধ্যে ২,৩০,৯৩৭ টি ছিল আইডেন্টিটি চুরির ঘটনা। অপর পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০২১ সালে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৬৯৮ জন তাদের পরিচয় তথ্য চুরির রিপোর্ট করেছে। যার সাধ্যমে জালিয়াতরা ৪৩ বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্য যাদের পরিচয় চুরি হয়েছে তাদের অধিকাংশের বয়স ৩০-৩৯ বছর, এটি তাদের ৫১% বার্ষিক আয়ের ৭৫হাজার ডলারের বা তার চেয়ে বেশি। তবে আমেরিকার প্রশাসন এ সকল প্রতারকদের রুখতে আমেরিকায় এবং সারাবিশ্বে ষাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে। বিশ্বজুড়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলি প্রতারকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি বড় বিজয় বলে মনে হচ্ছে। এই অপারেশনে মিলিয়ন  মিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং ২,০০০ জনেরও বেশি প্রতারককে গ্রেফতার করেছে। অপারেশন ’ফার্স্ট লাইট ২০২২’ ৮ মার্চ ২০২২ থেকে ৮ মে ২০২২ পর্যন্ত দুই মাস ধরে চলমান। ৭৬ টি দেশ বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারীর পিছনে সংগঠিত অপরাধের বলয়কে দমন করেছে। অপরাধী সম্পদ জব্দ করেছে এবং বিশ্বজুড়ে নতুন অনুসন্ধানী লিড প্রদান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের (ইন্টার পুল) আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সহযোগিতায় ১,৭৭০ টি তল্লাশী চালিয়ে ৩ হজার সন্দেহভাজন শনাক্ত করা হয়েছে। ২ হাজার জালিয়াত ও অর্থ পাচারকারী হোতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় ৪ হাজার ব্যাংক একাউন্ট জব্দ (ফ্রিজ) করা হয়েছে এবং ৫০ মিলিয়নের উপর অবৈধ তহবিল আটকানো হয়েছে। তার পর সবাইকে শতর্ক থাকতে হবে। কিছু স্বজাতি দেশী বা আন্তর্জাতিক চক্রের দ্বারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অভিজ্ঞ মহলের উপদেশ হলো- প্রতারণা সংক্রান্ত যে কোন ঘটনার রিপোর্ট করুন, নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।

শেয়ার করুন