১৮ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৪:৫৬:২৯ অপরাহ্ন


চীনাপররাষ্ট্রমন্ত্রীর কতটা গুরুত্বছিল বাংলাদেশ সফর
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৮-২০২২
চীনাপররাষ্ট্রমন্ত্রীর কতটা গুরুত্বছিল বাংলাদেশ সফর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত একটি মুহুরত/ছবি সংগৃহীত


তাইওয়ানকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যখন চরম উত্তেজনা। তাইওয়ানকে ঘিরে সামরিক মহড়া। যুদ্ধ যুদ্ধ একটা ভাব বলে বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়ায় গুরুত্বের সঙ্গে খবর প্রকাশ করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির গত ২ আগস্ট তাইওয়ান সফরকে ঘিরে যে বিতর্ক চীনের। সে মুহূর্তে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যস্ত থাকার কথা সে দেশে বিভিন্ন ইস্যুতে। কিন্তু সব রেখে তার দেশ চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়ে চায়না পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন হয়ে গেল এ প্রশ্নটা দীর্ঘদিন থেকেই। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, উপমহাদেশজুড়ে যে একটা সরব ভূ-রাজনীতি চলছে তার সূত্র ধরেই চায়না পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরটিকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে সম্প্রতি তাইওয়ান ঘিরে নতুন করে উত্তেজনায় জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন।

সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে। তার সফরে রোহিঙ্গা ইস্যু, চীনের সহায়তায় বিভিন্ন চলমান ও ভবিষ্যৎ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এর বাইরেও বাংলাদেশের বিভিন্ন ইস্যু ছিল। যেমনটা ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ঢাকা সফরের সময় ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই প্রকল্পগুলোতে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার দেয়ার কথা চীনের। কিন্তু গত ছয় বছরে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি নেই তাতে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যুও বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা। এ ব্যাপারেও এ সফরে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল বলে আগ থেকে জানানো হয়েছিল। 

চীনাপররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরসূচি যেভাবে হয়েছিল 

এর আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই-এর বাংলাদেশ সফরের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলে ঢাকায় চীনের দূতাবাস। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো আগাম অনুমতি বা সম্মতি নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সফরের আগের ৪ আগস্ট ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী বলেন, ‘তারা ডেসপারেটলি এই সফর চায়। চীনা দূতাবাস আমাদের সঙ্গে আলাপ না করেই এই সফরের দিনক্ষণ ঠিক করেছে। তারপর তারা তা জানাতে এসেছিল।

‘আমরা তাদের বলেছি, এই সময়ে আমি দেশে থাকছি না। যুক্তরাষ্ট্রে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও শান্তিপূর্ণ ক্ষেত্রে ব্যবহার বাড়ানো বিষয়ক এক সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে ওই সময় কম্বোডিয়ার নমপেনে আসিয়ানের একটি বৈঠকে অংশ নেবো।’ তিনি ওই  সময় আরো বলেছিলেন, ‘যেহেতু ওই সময়ে আমি দেশে থাকছি না, তাই তাদেরকে সফরসূচি পেছাতে হবে। পরের যে কোনো সময়ে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাবে ঢাকা।’

পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ২৫ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে ড. মোমেনকে তার দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত করার বিষয়ে প্রস্তাব দেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সহযোগিতা সংস্থাভুক্ত (আসিয়ান) পাঁচ দেশ, মঙ্গোলিয়া ও বাংলাদেশসহ বন্ধুপ্রতিম দেশ সফরের অংশ হিসেবে ঢাকায় আসার পরিকল্পনা করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি ৫ ও ৬ আগস্ট ঢাকা সফর শেষে উলানবাটোর যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন বলে চীনা রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান।

জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেইজিংকে ঢাকার আগে উলানবাটোর সফর সারার প্রস্তাবের কথা জানানো হয়েছে। এই প্রস্তাবে চীন রাজি থাকলে ৭ আগস্টের বদলে ৬ আগস্টই নপেন থেকে ঢাকায় ফিরবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। যদিও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসূচি পরির্বতন কঠিনই হবে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঢাকা সফরের পরিকল্পনাকে ‘অ্যাগ্রেসিভ প্ল্যান’ বলে মন্তব্য করেন আব্দুল মোমেন। একইসঙ্গে জানান, বেইজিংয়ের এ ধরনের পরিকল্পনায় বিব্রত ঢাকা।

তবে সংশিলিস্ট মহল মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই ঢাকা সফরের পরিকল্পনাকে বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ।

এছাড়াও ধারণা করা গেছে, ওয়াং ই-এর এই ঢাকা সফরের পরিকল্পনা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গঠিত কোয়াডে বাংলাদেশ যাতে অংশ না নেয় সে বিষয়ে চীনের পক্ষ থেকে পুনরায় অনুরোধ জানানোর একটি ইস্যু থাকতে পারে। পাশাপাশি পরিবর্তে ঢাকা-বেইজিং সহযোগিতা বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারেন ওয়াং ই। উল্লেখ্য, চীন অনেক আগে থেকেই এসব জোটে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নিয়ে কঠোর আপত্তি,হুশিয়ারি দিয়ে আসছিল। 


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন চায়না পররাষ্ট্রমন্ত্রী/ছবি সংগৃহীত 


প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক 

এদিকে তবে চায়না পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনর সঙ্গে বৈঠকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। যার মধ্যে ২ আগস্ট ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ান সফরের পর থেকেই চীন বন্ধুপ্রতিম অনেক দেশের মতো বাংলাদেশকেও ‘এক চীন’ নীতি নিয়ে বিবৃতি দেয়ার অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ গত বৃহস্পতিবার এক চীন নীতিতে বিশ্বাসী বলে একটি বিবৃতি দিয়েছে। চায়না পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। 

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর 

এছাড়াও দু’দেশের মধ্যে চারটি বিষয়ে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও চীন। গত রোববার সকালে স্থানীয় এক হোটেলে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। 

পরে তাদের উপস্থিতিতে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পিরোজপুরের কচা নদীর উপর নির্মিত সেতু হস্তান্তর, সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি নবায়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মেরিন সায়েন্সেস শিক্ষা বিষয়ে সহযোগিতার বিষয়ে এই চারটি দলিলে দু’দেশ স্বাক্ষর করেছে বলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, প্রায় দেড়ঘণ্টার আলোচনার মধ্যে এক ঘণ্টা ছিল দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। 

এরপর চুক্তি ও সমঝোতা স্মারকগুলো সই হয়েছে। এর মধ্যে কোনটা চুক্তি আর কোনটা সমঝোতা স্মারক পরে জানানো হবে। এর আগে পূর্ব ঘোষণা অনুসারে শনিবার বিকাল ৫টায় দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। বিমানবন্দর থেকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সফরের প্রথম কর্মসূচিতে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন।


শেয়ার করুন