২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:৩৯:০০ অপরাহ্ন


দেশ’কে ফজলুর রহমান বাবু
আমার কাছে বর্তমানের গুরুত্বই বেশি
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-০৪-২০২২
আমার কাছে বর্তমানের গুরুত্বই বেশি ফজলুর রহমান বাবু,ফাইল ছবি


ফজলুর রহমান বাবু। ১৯৭৮ সালে যিনি অভিনয় শুরু করেছিলেন মঞ্চ নাটক দিয়ে। নব্বইয়ের দশকে প্রবেশ করেছিলেন টিভি নাটকে। ২০০০ সালে প্রথবার দাড়িয়ে ছিলেন বড় পর্দার ক্যামেরার সামনে। সর্বশেষ গত বছরের শেষ দিকে মুক্তি পেয়েছে বাবু অভিনীত ‘নোনা জলের কাব্য’। নতুন বছরের শুরুতেই ব্যস্ত হয়েছেন নাটক নিয়ে। এ বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ পত্রিকার সাথে। 

প্রশ্ন : অভিনয়ে আপনার দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ার। এর মধ্যে আরো একটি নতুন বছরে পদার্পন করলেন। সামনের পরিকল্পনা কি?

ফজলুর রহমান বাবু : পরিকল্পনা হলো অভিনয়টা আরো দক্ষতার সাথে করে যাওয়া। কাজ করতে গিয়ে যে ভুল গুলো হয়, নতুন বছরে যেন তার পরিমাণ একটু হলেও কমে সেই প্রত্যাশা আমার। 

প্রশ্ন : প্রত্যাশর কথাটা একটু খুলে বলবেন?

ফজলুর রহমান বাবু : দীর্ঘদিন ধরে অভিনয়ের সাথে আছি। এই সময়ে অনেকের সাথে কাজ হয়েছে। সব কাজ থেকেই নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করি। গত বছর বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের শুটিং করেছিলাম। ওখানে প্রায় দেড়শ জনের একটি টিম ছিলো। সবাই যার যার মতো করে কাজ করছে। কেউ কারো কাজে ফাঁকি দেয়নি। পরিচালক শ্যাম বেনেগাল যে নির্দেশনা আগে দিয়েছিলেন। কাজের সময় এসে সেটা নতুন করে কাউকে কিছু বলতে হয়নি। একটি উদাহরণ দেই, ৭ মার্চের ভাষণের শুটিং হয়েছিল ঢাকা কলেজের মাঠে। এতো বড় ক্যানবাস তবুও কোনো ক্রুটি নেই কোথাও। নতুন বছরে এই নিয়মটা সব জায়গায় দেখতে চাই। 

প্রশ্ন : আপনার জীবনের সেরা সময় কোনটি?

ফজলুর রহমান বাবু : সেরা সময় নিয়ে তো আসলে ওই ভাবে চিন্তা করি না। তবে কৈশোরের কিছু দিন, যখন আমার বাবা মারা গেলেন, ওই সময়টা ছাড়া জীবনের আর সব সময়কেই আমার কাছে সেরা সময় মনে হয়। এর কারণ হলো, বর্তমানটাকেই আমি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই, যখন যা বর্তমান ছিল সেই সময়টাকেই আমি উপভোগ করেছি। আমি মনে করি, এখন আমার সেরা সময়। অতীত নিয়ে আমি বেশি ভাবি না, আর ভবিষ্যৎ তো অবশ্যই মানুষের আছে, যা আমরা জানি না। তাই বর্তমানের গুরুত্বই আমার কাছে বেশি।

প্রশ্ন : অভিনয়দক্ষতায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছেন। এই তারকা জীবন কেমন উপভোগ করেন?

ফজলুর রহমান বাবু : আমি আসলে নিজেকে তারকা মনে করি না। আমি মনে করি, আর দশজন অভিনেতার মতো আমিও অভিনয় করি। তবে এই পেশায় কিছু বাড়তি সুবিধা রয়েছে। যেমন, ভালো কোনও অভিনয়ের পর অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায়, আনুকূল্য, সমর্থন ও প্রশংসা পাওয়া যায়। সেই দিক থেকে আমি তো অবশ্যই সৌভাগ্যবান। আমি মনে করি অন্য দশটা পেশার মতোই আমার পেশা অভিনয়। মানুষ আমাকে ভালোবাসে বলে আমার অনেক দায়িত্বও রয়েছে। দর্শকদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, আমার সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করা—এ সবই আমি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করি।

প্রশ্ন : এবার কাজের কথায় আসা যাক, সম্প্রতি একটি বিজ্ঞাপনে কাজ করলেন... 

ফজলুর রহমান বাবু : হ্যাঁ, বিঞ্জের। বাজারে নতুন এসেছে, তারা মনে করেছে যে আমি তাদের বিজ্ঞাপনের মডেল হতে পারি। তারা বলেছে, তাই কাজটি করেছি। 

প্রশ্ন : নাটকে নিয়মিতই অভিনয় করছেন। সিনেমা এবং গানের কী খবর।

ফজলুর রহমান বাবু : সিনেমা তো অভিনয়েরই অংশ। আমি সিনেমায় কাজ করি একজন অভিনেতা হিসেবে। একজন অভিনেতা যে কোনো জায়গায়ই কাজ করতে পারে। সিনেমাটা আমার পছন্দের একটি জায়গা। টেলিভিশন ফিকশনের চাইতে আমার বেশি ভালো লাগে, আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি চলচ্চিত্রে কাজ করার সময়। মঞ্চও আমার খুব প্রিয় জায়গা, যেহেতু মঞ্চই আমার অভিনয়ের জন্মস্থান। সে জায়গার প্রতিও আমার একটা নাড়ির টান রয়েছে। আর গানের ব্যাপারে বলব, আমি নিজেকে আসলে গায়ক ভাবি না। তবে গান যেহেতু করেছি এবং মানুষ আমার গান পছন্দ করেছে, গলা পছন্দ করেছে, সে কারণে মাঝেমধ্যে গান করি। এটাও অবশ্য আমার ইচ্ছামতো করি না। যারা গানের ব্যবসায় যুক্ত, নিয়মিত গান রেকর্ড করেন, বিশেষত বর্তমানে ইউটিউব চ্যানেলে, তাদের অনুরোধেই আমার গান করা হয়। নিজের পরিকল্পনামাফিক গাওয়া হয় না। সেটা একেবারে ‘মনপুরা’ সিনেমায় গাওয়া আমার প্রথম গান থেকে বর্তমান পর্যন্ত, সব ক্ষেত্রেই। গান আমি পছন্দ করি, গান গাইতে পছন্দ করি, মানুষ আমাকে পছন্দ করে। এটাই আমার সৌভাগ্য।

প্রশ্ন : নাটকে ভিউ প্রতিযোগিতা ও সিন্ডিকেটের গল্প শোনা যায়। আপনি তো সিনিয়র অভিনেতা; ব্যাপারগুলো কীভাবে দেখেন? 

ফজলুর রহমান বাবু : ভিউভিত্তিক নাটক মানেই যে খারাপ হবে, সেটা আমি মনে করি না। আমি মনে করি, একটি ভালো নাটকেরও অনেক ভিউ হতে পারে, আবার খারাপ নাটকেরও অনেক ভিউ হতে পারে। ভিউ নির্ভর করে দর্শকের ওপর, কেমন দর্শক দেখছে সেটার ওপরে। উদাহরণ দিয়ে বলি, আমার অভিনীত একটি চলচ্চিত্র ‘অজ্ঞাতনামা’। টিকেট কেটে সিনেমা হলে গিয়ে যত মানুষ এটি দেখেছে, তার চেয়ে বেশি দেখেছে ইউটিউবে। এর ভিউও অনেক বেশি অন্যান্য ফিল্মের চাইতে। কিন্তু এটা তো নিঃসন্দেহে একটি ভালো ছবি। আবার অনেক খারাপ, নিম্নমানের ছবি বা নাটকে আমরা দেখি অনেক ভিউ। এটা নির্ভর করছে কোন শ্রেণির দর্শক দেখছে, তার ওপর। আরো একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, আমি তিন-চার মিনিটের একটি ছোট্ট শর্টফিল্মে কাজ করেছিলাম, অলিম্পিক বিস্কুটের সৌজন্যে। একজন বাবা নিজের জন্য জুতা কিনতে গিয়েছেন, পরে সন্তানের জন্য কিনে এনেছেন। এটা তো কোটি কোটি ভিউ হয়েছে, কিন্তু এটি তো কোনো নিম্নমানের কাজ নয়। আমাদের দায়িত্ব হলো কোন কনটেন্ট আমরা দর্শককে বেশি দেখাব। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা। একজন শিল্পী হিসেবে, নাট্যকার হিসেবে কী ধরনের কনটেন্ট আমরা মানুষকে বেশি দেখাব, এই দায়িত্বশীলতার জায়গাটা সবাইকে পালন করতে হবে। দায়িত্বহীনভাবে যারা কাজ করছে, তারা ভিউয়ের পেছনে ছুটছে। আপনি যে ভিউ বোঝাতে চাচ্ছেন, সে ভিউ আসলে আমাদের কাম্য নয়, সে দর্শক আমাদের কাম্য নয়। অনেকে আজেবাজে গান গাইছে, নাটক করছে—এগুলো প্রত্যাশিত নয়। এবং এ ধরনের নাটকে আমি সাধারণত কাজ করি না। আমি বলে দিই যে আমি ওই ধরনের অভিনেতা নই যে ভিউয়ের পেছনে ছুটব। আমি চেষ্টা করি ভালো গল্পে কাজ করব, ভালো ডিরেক্টরের অধীনে এবং ভালো অভিনেতাদের সাথে কাজ করব। তাতেও কিন্তু ভিউ বাড়বে। আর আমি কোনো সিন্ডিকেটের ভেতরে নেই বলে এ সব নিয়ে খুব একটা ধারণা নেই।

প্রশ্ন : সবাই এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছে, বাংলাদেশে ওটিটির কেমন ভবিষ্যৎ দেখছেন?

ফজলুর রহমান বাবু : আমি মনে করি বাংলাদেশে এর ভবিষ্যৎ ভালো। আমরা একসময় মঞ্চে নাটক করতাম, টেলিভিশনে করতাম। এগুলো একেকটা প্ল্যাটফর্ম। ওটিটিও তেমনই একটি প্ল্যাটফর্ম। 

প্রশ্ন: আমাদের দেশের দর্শক টাকা খরচ করে ওটিটিতে দেখতে আগ্রহী হবেন?

ফজলুর রহমান বাবু : হ্যাঁ, মানুষজন তো খরচ করেই ওটিটিতে কনটেন্ট দেখছে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই তো ওয়াইফাই ব্যবহার করেন না। একেবারে খেটেখাওয়া যাঁরা, শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষ, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে যে শ্রমিক ভাইবোনেরা কাজ করেন, তাঁরা কিন্তু টাকা দিয়ে ডাটা কিনেই আমাদের নাটক দেখেন। কেউ যদি ২০ টাকা দিয়ে ডাটা কিনে নাটক দেখতে পারে, তাহলে সে ২০ টাকা দিয়ে একটি অ্যাপও এক সপ্তাহের জন্য বা একমাসের জন্য নিতে পারে। এমন তো নয় যে এগুলো একবছরের জন্য নিতে হয়। আপনি প্রয়োজনমতো কিনতে পারেন। আমাদের প্রান্তিক মানুষজন একসময় টিকেট কেটে সিনেমা দেখত। আজ থেকে ২০ বছর আগে কি সে ২০ টাকা দিয়ে সিনেমা দেখেনি? সে ২০ টাকার সমান যদি আমি বর্তমানে ৫০ টাকাও ধরি, এটা সে খরচ করতেই পারে কনটেন্ট দেখার জন্য। 

প্রশ্ন : দীর্ঘ তিন যুগের বেশি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। জীবনে অপূর্ণতার হিসাব আছে কতখানি? 

ফজলুর রহমান বাবু : না, আমার কোনও অপূর্ণতা নেই। অপূর্ণতা নিয়ে ওভাবে ভাবিও না। এক জীবনে তো সবকিছু করা সম্ভব নয়, জীবনের তো সীমা রয়েছে। সবকিছু করতে গেলে তো অনেক জীবন লাগে। আমার জীবনে যতটুকু সম্ভব আমি করছি। তবে হ্যাঁ, আমার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আরও ভালো ভালো কাজ যদি করতে পারতাম, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতাম বা আন্তর্জাতিক কোনও কাজ করতে পারতাম, যা বিশ্বব্যাপী দর্শক দেখবে, আমাদের ছবি ভেনিস উৎসবে, কান উৎসবে যাবে; সেখানে সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের অভিনয় দেখবে—এমন অনেক আকাঙ্ক্ষা আমার রয়েছে।

শেয়ার করুন