২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৪:১২:১২ পূর্বাহ্ন


নির্বাচনের পথেই এগুচ্ছে সরকার
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১০-২০২৩
নির্বাচনের পথেই এগুচ্ছে সরকার


ভিনদেশি বা বিদেশি পরাশক্তির পরামর্শ বা চাওয়া-পাওয়া কোনো কিছুর দিকে তাকাচ্ছে না, ক্ষমতাসীন দল তাদের অবস্থান বা প্ল্যানের মধ্যেই রয়েছে। তাদের প্ল্যান আস্তে আস্তে তারা এগোচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। যেহেতু দেশের প্রধান বিরোধীদল বর্তমান ধারায় নির্বাচনে যেতে নারাজ। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য তাই বাড়তি কোনো উদ্বেগের কারণ নেই। তাইতো তারা নির্বাচনী মাঠে নির্বাচন নিয়ে হই চইয়ের পথ এড়িয়ে নীরবে নিস্তব্ধে এগোচ্ছে নির্বাচন পানে। তফসিল ঘোষণার দিনক্ষণ, নির্বাচনকালীন সরকার কখন হবে এসবই ইতিমধ্যে জানিয়ে দিচ্ছেন তারা। 

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রতিটা আসনে নমিনেশন পেতে মরিয়া সংশ্লিষ্টরা। যারা সামান্যতম সিগন্যাল পেয়েছেন তারাও চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী এলাকা। সাধারণ মানুষকে দিচ্ছেন প্রতিশ্রুতি বা শেষ মুহূর্তে যেসব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ঢিলেমিতে এগোচ্ছিল, সেগুলো একটা বিশ্বাসযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে নির্দেশনা। সব মিলিয়ে এলাকায় একটা নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। 

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন খবর উড়ে বেড়াচ্ছে। ওগুলো এখন পুরোনো হওয়ার উপক্রম। গত দুই টার্ম ২০১৪ ও ২০১৮ সালের আগের দেশের নির্বাচনী আমেজ কেমন ছিল, বিরোধীপক্ষও কী কী করেছিল সেগুলোর সঙ্গে এ বছরের বিষয়গুলো যোগসাজশের প্রাণান্ত চেষ্টা অনেকের। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে একটা আস্থা অবিচল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করছেন, বিশ্বের যে যাই বলুক না কেন, শেখ হাসিনা এর আগেও তিন টার্ম ক্ষমতার মসনদে বসেছেন। সব ম্যানেজ করেছেন শেষা অবধি। প্রতিবারই কিছু পক্ষ বলা হচ্ছিল, কোনো কিছুই কাজ হবে না, এটা হবে তো ওটা। এমন হবে তো অমন। দিন শেষে জয়জয়কার শেখ হাসিনার। এবারও তাদের ওই বিশ্বাস। 

কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের পরাশক্তি সবাই একত্রিত হয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশলে এগুলো এখন পর্যন্ত হালে পানি পাচ্ছে না বলেই অনেকের বিশ্বাস। পরাশক্তিদের চাহিদার সঙ্গে তিনিও একাত্মতা জানিয়ে আসছেন। তিনিও বলছেন, ভোট চুরি করে ক্ষমতায় যায়নি কখনো আওয়ামী লীগ। জনগণ চাইলে ক্ষমতায় আবার আসবে, নতুবা নয়। অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগই সারা জীবন সংগ্রাম করে আসছে। ফলে তারা এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারেও তার বক্তব্য রয়েছে। দেশের প্রধান বিরোধীদল দীর্ঘদিন ধরেই ক্ষমতার বাইরে থেকে তারা এখন জনসমর্থন শূন্য। তারা নির্বাচনে এলে নির্ঘাত পরাস্ত হবে। তাছাড়া ক্ষমতাসীন সরকার যে উন্নয়ন করেছে, তাতে মানুষ এখন আওয়ামী লীগের গুণগানে ব্যস্ত। ফলে বিএনপি জেনেশুনে নির্বাচনে এসে পরাস্ত হতে চাইবে না। কিন্তু দেশের সংবিধান অনুসারে নির্বাচন তো হতে হবে। সে বাধ্যবাদকতা রয়েছে। ফলে কে নির্বাচনে এলো না না এলো সেটা তো ভাবার সময় নেই।

বিদেশি পরাশক্তিদের পাঠানো প্রতিনিধিদের কাছে এ উক্তি বারবার। সরলমনা সেসব প্রতিনিধিও কনফিউজড। তারা কী বলতে চান, এখানে ক্ষমতাসীনরা কী বলছে। তারা যা বলতে চান, ক্ষমতাসীনরা তো আগেভাগে তাই বলছে, তাহলে সমস্যা তো কম। এভাবেই চলছে বিদেশি প্রতিনিধিদের বোঝানোর কাজ। 

তাছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে, সেখানে তো আমেরিকার ভিসানীতিসহ আরো অনেক (সম্ভাব্য) শাস্তি বা ব্যবস্থার কথাও শোনা যাচ্ছে। ফলে এসবে ক্ষমতাসীন সরকার তো প্রতিবাদ করছে না। অমান্য করছে না। বাধা দিচ্ছে না। ফলে সবই তো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। যেটা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শেখ হাসিনার সরকার। 

এমন একটা সন্দেহেরে দোলাচলের মধ্যেই বিদেশি প্রতিনিধিগণ। বিষয়টি এমন হয়ে গেছে, তারা এখন বাস্তবে দেখতেও চান বিষয়গুলো। কিন্তু সেক্ষেত্রে বিএনপির তো নির্বাচনে আসতে হবে। কিন্তু বিএনপিকে বা তাদের সমমনাদেও বোঝাবে কে? তারা তো তাদের শর্ত দিয়ে রেখেছে। ইতিমধ্যে যে সংলাপের দীর্ঘ প্রত্যাশা ছিল একটি সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে, সেখানেও এখন সংলাপের সুর দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। তবে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সেজন্য বিএনপিকে শর্তাদি প্রত্যাহার করে আসতে হবে। তার যুক্তি প্রধানমন্ত্রীকে যদি পদত্যাগই করতে হয়, তাহলে সংলাপ হবে কার সাথে? 

এ রকম নানা যুক্তি ও রাজনৈতিক নতুন নতুন কৌশলের বেড়াজালে ক্ষমতাসীন দল। অবশ্য রাজনীতিটা এমনই। বুদ্ধি, কৌশলের মারপ্যাঁচে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। যদিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আরো একটা বড় কৌশল প্রয়োগ করে আসছে। যেটা নির্বাচন এলে প্রকট আকার ধারণ করে। সেটা হলো প্রতিপক্ষদের ওপর মামলা-মোকদ্দমার খড়গ। কিছুদিন আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, যে আদালতের বারান্দায় প্রতিদিন যেসব মামলা হাজিরা দেওয়ার লোক উপস্থিত হন, তার ৯০ ভাগই বিএনপির। কারাগারেও রয়েছেন অনেক কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। ফলে বিএনপির শর্ত মেনেও যদি সংলাপে বসে একটা সমঝোতায় বিএনপির দাবি মেনেও যদি নির্বাচন হয়, তাতে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতৃত্বই থাকছে অনুপস্থিত। বিএনপি তো কার্যত অকার্যকর অন্তত সাংগঠনিক দিক থেকে। তাছাড়া ক্ষমতাসীনরা তৃণমূল পর্যন্ত যেভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছেন, সাথে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত প্রশাসন, তাহলে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে হারাবে কে?

এখানে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হতে পারে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কতিপয় ব্যবসায়ীর ওপর বিভিন্ন ইস্যুতে নিষেধাজ্ঞা। যেটা বিভিন্ন অসমর্থিত সোর্স থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাউর হচ্ছে। সেটা হয়তো ১৫ বা কুড়ি। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কী কুড়ি বা ত্রিশ নয় ১০০ ব্যবসায়ীর কি হলো, না হলো তাতে পরোয়া করে? মোটেও না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মূলত যে ইস্যুতে সোচ্চার ছিল এবং সম্ভাব্য একটা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাদানের সম্ভাবনার কথা দেশের কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ধারণা পোষণ করে আসছিলেন, সেটাও থোরাই কেয়ার। 

কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিংহভাগ পোশাক আমদানির পরীক্ষিত ক্ষেত্র বাংলাদেশ। ওইসব নিষেধাজ্ঞা দিয়ে উল্টা বিপাকে পড়বে তারাই। বাংলাদেশ হয়তো কোনোভাবে সারভাইভ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু নিজেদের স্বার্থও ভীষণভাবে ক্ষুণœ হবে নিঃসন্দেহে। তাছাড়া যে ইস্যু ছিল তাদের মুখ্য, সে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান ও এলানকে দুই বছরের সাজা মওকুফ ও জরিমানা স্থগিত করে জামিন দিয়ে দিয়েছে হাইকোর্ট। এখন তো তাদের (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) মুখ অনেকটাই বন্ধ। এরপরও তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে নিজেদের মধ্যেও একটা বিরোধের আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী চার দিনের সফরে যাচ্ছেন ব্রাসেলসে। সেখানেও তিনি চেষ্টা করবেন তাদের বোঝাতে। 

সব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাবা-মাসহ পরিবারবর্গের প্রায় সবাইকে বিসর্জন দিয়ে রাজনীতিটা করছেন এ মুহূর্তে। ফলে এমনি মুহূর্তে তিনি তার পরিবারের বাইরে কার কী ক্ষতি হয়ে গেল, তার জন্য তিনি দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে নেমে যাবেন-এ নীতিতে অন্তত ২০২৩ সালের শেখ হাসিনা সম্ভবত নেই। আশি ছুঁই ছুঁই একজন নেতৃত্ব এখন অনেক ভেবেচিন্তে এগোচ্ছে। কোথায় কার সঙ্গে কোনো কৌশলে কথা বলতে হবে সেটা তিনি বেশ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করেই এগিয়ে যাচ্ছেন এটা, আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

শেয়ার করুন