২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৩:৩৮:২২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান


বিজয়ের মাস ডিসেম্বর
মুক্ত আকাশে আনন্দের পায়রাগুলো
ফকির ইলিয়াস
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-১২-২০২৩
মুক্ত আকাশে আনন্দের পায়রাগুলো


একাত্তরের সতেরোই ডিসেম্বর গোটা বাংলাদেশের মানুষ শহরে গ্রামে আনন্দ মিছিল নিয়ে বের হন। বাজারে বাজারে তখন চলছে মাইকিং। মুক্তিযোদ্ধারা দল বেঁধে নিজ নিজ শহরে ফিরতে শুরু করেছেন।

সড়কে সড়কে সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের বরণ করছেন। হাতে হাতে লাল-সবুজের পতাকা। বিভিন্ন শহরের মাঠগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তাঁবু ফেলেছেন। অন্যদিকে জরুরি ব্রিজগুলোতে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেছেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার পর ভীষণ অসহায় ও অনিরাপদ হয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার। পরিবারের বড় ছেলে শেখ কামাল ২৬ মার্চেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৬ মার্চেও তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়েছিল, গুলি করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে তাদের কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ মনে করলেন না তারা। কিন্তু কোথায় যাবেন?

নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ১ এপ্রিল খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার গোলচত্বরে ঢোকার প্রধান সড়কের কাছে একটি ভাড়াবাড়িতে গিয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু পরিবার। কিন্তু পাঁচ-ছয়দিন পর বাড়িওয়ালি বাড়িভাড়া ফেরত দিয়ে বেগম মুজিবকে বললেন, ‘আপনাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে গেছে। আল্লাহর দোহাই, আপনারা দয়া করে এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। তা না হলে পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাড়িটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেবে।’

এরপর মগবাজার চৌরাস্তার কাছে প্রধান সড়কে একটি বাড়ির নিচতলায় আশ্রয় নেন তারা। কিন্তু ওখানেও পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের আনাগোনা। আবারও বাসা বদল করে ওই বাড়ির আশপাশে আরেকটি বাসার দোতলায় এসে ওঠেন তারা। কিন্তু এখানেও বেশি দিন আত্মগোপনে থাকতে পারেনি বঙ্গবন্ধু পরিবার।

১২ মে তাদের ওই বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। সশস্ত্র সৈন্যসহ জিপ ও আর্মি ট্রাকে করে কড়া পাহারায় সন্ধ্যার সময় ধানমন্ডির ১৮ নম্বর (বর্তমানে ৯/এ) সড়কের ২৬ নম্বর বাড়িতে এনে বন্দি করে রাখা হয় সবাইকে। বন্দি থাকা অবস্থায় পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু পরিবারের তত্ত্বাবধানের কথা বলা হলেও বেগম মুজিব সরাসরি তাদের সহায়তা নিতে অস্বীকার করেন।

তাদের যে বাড়িতে এনে বন্দি করা হয়, ওই বাড়িতে কোনো আসবাবপত্র ছিল না। ছিল না কোনো ফ্যান। ঘরের মেঝেতে ঘুমাতে হতো সবাইকে। এ সময়টাতেই মায়ের গর্ভে এসেছিলেন সজীব ওয়াজেদ জয়। সন্তানসম্ভবা শেখ হাসিনার তখন প্রয়োজন ছিল মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি। কিন্তু এসবের কিছুই তিনি পাননি। ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে জানিয়েছেন, ‘যখনই বাইরে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যেতো, প্রহরারত সুবেদার মেজর স্টেনগান হাতে ডক্টর সাব, ডক্টর সাব বলতে বলতে আমার রুমে ঢুকতো। সে সময়ে তারা আমাদের নানাভাবে হয়রানি ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতো। বাড়ির ছাদে উঠে লাফালাফি করতো এবং লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমোতে দিতো না। রাইফেলের মাথায় বেয়নেট লাগিয়ে কক্ষের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো।’

এমনকি মাতৃত্বকালীন হাসপাতালে মেয়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব। কিন্তু তাকে থাকার অনুমতি দেয়নি পাকিস্তানিরা। হাসপাতালে ভর্তি শেখ হাসিনাকেও স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। হাসপাতালে তার কক্ষের বাইরে মারদাঙ্গা চেহারারা পাকিস্তানিরা ঘোরাফেরা করতো, কক্ষের ভেতরে ঢুকে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে আসা আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করতো, যখন তখন তাদের রুম থেকে বের করে দিতো।

ওদিকে একরাতে এক পাকিস্তানি হাবিলদার স্টেনগান নিয়ে বেগম মুজিবের ঘরে ঢুকে হুমকি দিয়ে বলেছিল, ‘আপনারা জয় বাংলা রেডিও শোনেন। ওটা বন্ধ না করলে জামালকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ঘরের সিলিংয়ে পা বেঁধে ঝুলিয়ে পিটিয়ে তার পিঠের চামড়া ওঠানো হবে।’

হাসপাতাল থেকে সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরলেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা ও সদ্যজাত শিশু জয় বেশ কয়েকবার অসুস্থ হয়ে পড়লেও সে বন্দিবাড়ি থেকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অনুমতিও মিলতো না। এমনকি বাইরে থেকে কোনো ডাক্তার আনতেও বাধা দিতো। সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের কটাক্ষ বা বুলিং। যখন তখন যাকে তাকে যা ইচ্ছে বুলিং করতো পাকিস্তানি সৈন্যরা। মুক্তিযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করলে সদ্য পিতা হওয়া জয়ের বাবা ড. ওয়াজেদ মিয়াকে প্রায়ই কটাক্ষ করতো, ‘পশ্চিম পাকিস্তানে এক নমরুদকো পাকড়াও কারকে রাখখা হুয়া, লেকিন এধার এক কাফের পয়দা হুয়া’।

ওই বাড়িতে যে কী পরিমাণ মানসিক ও শারীরিক কষ্টের মধ্য দিয়ে তারা কাটিয়েছেন, তার কিছু বিবরণ এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইতে পাওয়া যায়। একদিন তো ড. ওয়াজেদ মিয়াকে গুলিই করেছিল এক পাকিস্তানি সৈন্য। আর শেখ জামাল নিখোঁজ হওয়ার কারণে ওই বাড়ির সৈন্যসংখ্যা এক কোম্পানি থেকে বাড়িয়ে দুই কোম্পানি করা হয়। শুধু তাই নয়, বাড়ির ছাদে বালির বস্তা দিয়ে বাঙ্কার বানিয়ে ভারী মেশিনগান ও গাড়ি গ্যারেজের ছাদে মাঝারি ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিনগানও স্থাপন করা হয়েছিল।

বন্দি সময়টায় ওই বাড়ি থেকে সারাক্ষণ আর্মির জিপের শব্দ, আর্তচিৎকার, গুলির শব্দ, গ্রেনেড ফাটার শব্দ শুনতে পেতেন তারা। নানারকম কষ্ট তো ছিলই। খাবারের কষ্ট, ঘুমানোর কষ্ট, প্রাইভেসিজনিত কষ্ট, শীতের কষ্ট। খুব হিসাব করে খেতে হতো সবাইকে। কোনোরকমে খাবারের ব্যবস্থা হতো। সামান্য কিছু চাল-ডাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে রাখতেন বেগম মুজিব। আর সবাইকে বলে দিতেন পেট ভরে কিন্তু খাওয়া চলবে না। যার ক্ষুধা লাগবে সে খাবে। তা-ও একটা পরিমাপ বেঁধে দিতেন। এক মুঠোর বেশি খাওয়া যাবে না।

প্রচণ্ড শীতে তাদের পুরো পরিবারের জন্য মাত্র একটি কম্বল দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। এতো সব কষ্টের মধ্যেও মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলির শব্দ তাদের মনে বেশ আনন্দ দিতো। আর সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছিল যেদিন তারা জানতে পারলেন পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বাড়ির ভেতরে বন্দি থেকেও মানুষের খুশি টের পাচ্ছিলেন সবাই। ঢাকা মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সামনে দিয়ে গাড়ি যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে।

রেডিওতে আত্মসমর্পণের খবর প্রচার হয়েই চলেছে। বেগম মুজিব এক হাবিলদারকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমাদের নিয়াজী সারেন্ডার করেছে, তোমরাও করো।’ কিন্তু তখন ওরা সারেন্ডার করতে রাজি হয়নি। তখনো তারা এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতার কথা জানায়। আর সেই রাস্তা দিয়ে কোনো গাড়ি ঢুকলেই গুলি করে গাড়ির ভেতরে থাকা আরোহীদের হত্যা করতে থাকে। ওরা রাস্তা বন্ধ করেনি।

অথচ কেউ গাড়ি নিয়ে ঢুকলেই গুলি চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই মনে করেছিলেন, যেহেতু বাংলাদেশ মুক্ত, কাজেই ওই বাড়িতে বন্দি থাকা বঙ্গবন্ধু পরিবারও মুক্ত। তাই অনেকেই বন্দি বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে ছুটে আসতে চাইছিলেন। কিন্তু এলেই যে তাদের ওপর গুলি চলবে এটা তারা ভাবতেই পারেনি। আর এই না জানার কারণে প্রাণও দিতে হয়েছিল বেশ কয়েকজনকে।

বাড়ির ভেতরে থেকে তারা পাকিস্তানিদের বদ মতলব বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না। ৩২ নম্বর সড়কের এক প্রতিবেশী ও আত্মীয় ইঞ্জিনিয়ার হাতেম আলী এবং তার পরিবার ছুটে এসেছিলেন তাদের খবর নিতে। কিন্তু গেটের কাছে আসতেই মেশিনগান চলতে শুরু করলো। মুষলধারে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ঝরলো তাদের গাড়ির ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই ড্রাইভার শহিদ হলো। আহত হলেন হাতেম আলীর স্ত্রী ও পুত্রবধূ।

বাড়ির ভেতর থেকে তারা তখন ওদের পানি পানি বলে আর্তচিৎকার শুনেছিলেন। আর্তনাদ শুনে তারা কেউ আর থাকতে পারছিলেন না। ছুটে এসেছিলেন বারান্দায়। কিন্তু রাইফেল তাক করে ধমক দিয়ে আবার তাদের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি সেনারা। জানালা দিয়ে এসব অত্যাচার দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তাদের।

রেডিওতে তখনো প্রচার চলছে, ‘আত্মসমর্পণের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। মিত্রবাহিনী ভারত ও মুক্তিবাহিনীর পক্ষে জেনারেল অরোরা উপস্থিত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জেনারেল নিয়াজীকে আত্মসমর্পণ করালেন।’ অথচ তারা তখনো স্বাধীনতার স্বাদ পাননি। তখনো তাদের মাথার ওপর পাকিস্তানের পতাকা উড়ছিল।

কাদেরিয়া বাহিনী বাড়ির সামনে দিয়ে খোলা জিপ চালিয়ে স্লোগান দিতে দিতে যাচ্ছিল। তখনো মেশিনগান চলতে শুরু করলো। রাস্তা থেকেও পাল্টা গুলি এসেছিল। এটা দেখে তারা সবাই হঠাৎ সাহসী হয়ে উঠেছিলেন। সেদিন শেখ হাসিনার ছোট বোন রেহানা খুশিতে মুক্তিবাহিনী, মুক্তিবাহিনী বলে চিৎকার করছিলেন আর হাততালি দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েছিলেন।

সবাই অস্থির হয়ে উঠেছিলেন কখন বাইরে যাবেন, মিছিল করবেন, বিজয়োল্লাসে মেতে উঠবেন। কিন্তু তারা কেউ উল্লাস তো করতে পারছিলেনই না, বরং যতো সময় যাচ্ছিল, গোলাগুলি ততো বেড়েই যাচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে গোলাগুলি আরো বেড়ে গিয়েছিল। সে রাতে তারা সারারাত গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছেন। একসময় গোলাগুলি থেমে যায়। যখন গোলাগুলি থামে, তখন ১৭ ডিসেম্বর ভোর। হাবিলদার ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলেই গোলাগুলি থেমেছিল। ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে উদ্ধার করতে চলে আসে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী।

 ভারতীয় সেনারা তখন পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল। আর পাকিস্তানিদের চাপ দিয়েছিল সারেন্ডার করার জন্য। তবুও কিছুতেই পাকিস্তানি সেনারা সারেন্ডার করতে রাজি হচ্ছিল না। অনেক বাগ্বিতণ্ডার পর পাকিস্তানি সেনারা সারেন্ডার করতে রাজি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দুই ঘণ্টা সময় চেয়েছিল। তখনই বাড়ির ভেতর থেকে তারা সবাই মিলে ভারতীয় সেনাদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন, ওদেরকে যাতে সময় দেওয়া না হয়। কারণ এরই মধ্যে বাড়ির ভেতরের বন্দিরা বুঝে গিয়েছিলেন, ওরা এই সময়টা পেলেই সবাইকে মেরে ফেলবে। তখন ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন মেজর অশোক। তাদের অনুরোধ শুনে তিনিও সবকিছু বুঝে গিয়েছিলেন। তাই আর পাকিস্তানিদের সময় দেননি। ভারতীয় সেনারা নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় করে পাকিস্তানিদের মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে সারেন্ডার করতে বাধ্য করেছিলেন। সেই সময় আবারও তারা সবাই সাহসী হয়ে উঠেছিলেন।

সবাই মিলে ছুটে চলে এসেছিলেন বারান্দায়। আর তখনই দেখতে পেলেন, একে একে পাকিস্তানিরা অস্ত্র ফেলে সারেন্ডার করছে। সঙ্গে সঙ্গেই বেগম মুজিবের নির্দেশে নামিয়ে ফেলা হয় পাকিস্তানের পতাকা। তারপর সেই পতাকা পায়ের নিচে ফেলে মাড়িয়ে মাড়িয়ে রাগ মিটাতে চাইলেন বঙ্গবন্ধুপত্নী। তবু তার যেন রাগ মিটতেই চাইছিল না। শেষে ওই পাকিস্তানি পতাকা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেললেন। তবুও রাগ কমলো না। তারপর সেই পতাকায় ধরিয়ে দিলেন আগুন। এর মধ্যেই চারপাশ থেকে জনতার ঢল নেমে এসেছিল। ছুটে এসেছিলেন সাংবাদিকরাও। মুক্ত হওয়ার আনন্দে তখন তারা সবাই আনন্দের কান্না জুড়ে দিয়েছিলেন। চোখে পানি আর মুখে হাসি নিয়ে স্লোগান দিয়েছিলেন-‘জয় বাংলা।’

১৭ ডিসেম্বর ঘোষণা আসে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন যে, এখন সময় এসেছে যুদ্ধ-উত্তর পুনর্গঠন সরকার হিসেবে কাজ করার। তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকার নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

প্রায় একডজন অভিজ্ঞ প্রশাসক নিয়ে ঢাকায় একটি ছোটখাটো বেসরকারি প্রশাসন দাঁড় করানো হয়। এর নেতৃত্ব দেন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার’ অন্যতম অভিযুক্ত রুহুল কুদ্দুস।

দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে পশ্চিম রণাঙ্গনেও যুদ্ধবিরতি ঘটে। যুদ্ধবিরতির জন্য ভারতের একতরফা প্রস্তাব গ্রহণ করার ঘোষণা করেন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিযা খান। দুই সপ্তাহ, দুই ঘণ্টা স্থায়ী যুদ্ধে ভারত ধ্বংস করেছে পাকিস্তানের ৯৪টি যুদ্ধবিমান, ২১৪টি ট্যাংক এবং ২২টি নৌযান।

‘নিরপেক্ষ এলাকা’ হিসেবে ঘোষিত হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রাক্তন গভর্নর ডা. এ এম মালিককে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায় গেরিলারা। ভারতীয় বাহিনী গেরিলাদের বিরত করেছে, তবে পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে রয়েছে।

রাতে পিকিংয়ের ভোজসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ভারতীয় ‘আগ্রাসন’ সমর্থন করার জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেন। প্রতিবাদে রুশ রাষ্ট্রদূত ভোজসভা ত্যাগ করেন।

মিরপুরের বধ্যভূমিতে খুঁজে পাওয়া নিহত স্বজনের শতাধিক লাশ বিজয় আনন্দে উদ্বেল দেশবাসীর মনে বিষাদের ছায়া ফেলে। এসব শহিদের কাতারে রয়েছে বাংলার শ্রেষ্ঠ মনীষীরা।

 ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, বাংলাদেশ সরকারের দুই জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আজ ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। এরা হলেন-নবনিযুক্ত মহাসচিব রুহুল কুদ্দুস এবং পুলিশের আইজি আবদুল খালেক। সারা ঢাকা শহরে কিছুক্ষণ পরপরই গুলির শব্দ শোনা অব্যাহত রয়েছে। বিজয়-আনন্দে মুক্তিযোদ্ধারা আকাশে গুলি ছুড়েছে।

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে প্রেরিত এক খোলা চিঠিতে প্রখ্যাত ফরাসি লেখক ও বুদ্ধিজীবী আন্দ্রে ম্যালর ভারতের প্রতি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র সমালোচনা করেন এবং বাংলাদেশের যৌক্তিকতা সমর্থন করেন। উল্লেখ্য, তিন মাস আগে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে সরব হয়েছিলেন। বাংলাদেশের পক্ষে তার লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি কোনো ফাঁকা বুলি ছিল না-এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া দেড়শ অফিসার তার সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত ছিল।

ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে চারটি রুশ নির্মিত ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। এই হোটেলে আশ্রয় নেওয়া প্রাক্তন গভর্নর ডা. এ এম মালিককে মুক্তিযোদ্ধারা ছিনিয়ে নিতে পারে মনে করে এই প্রহরা বসানো হয়েছে।

সানডে টাইমসের সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, স্বাধীনতা বদ্ধদুয়ার খুলে দেয়। কিন্তু মূল কাজ শুরু হয় এরপর।

১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ রাতে পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্ট পদে ইয়াহিয়া খানের ইস্তফাদানের বার্তা ঘোষিত হয়। বার্তায় বলা হয়, আগামীকাল প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে এখন দেশের পথে রয়েছেন এবং তিনি নতুন সরকার গঠন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান এয়ার মার্শাল আসগর খান রাওয়ালপিন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আহাম্মক হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তিনি ইয়াহিয়া ও তার দোসর জেনারেলদের প্রকাশ্য বিচার দাবি করেন।

ঢাকা থেকে ফিরে ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউজ বলেন যে, তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার ঘৃণ্য দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। এখনো রাজপথে শবদেহ পড়ে আছে। তিনি আরো জানান, একজন মেজর জেনারেলসহ ছয়জন পাকিস্তানি অফিসার হত্যার জন্য ২ হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তালিকা তৈরি করেছিল।

ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদদাতা ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ ঢাকা থেকে পুনরায় চালু হওয়া প্রথম আন্তর্জাতিক টেলিফোন যোগাযোগের মাধ্যমে পত্রিকাকে জানান যে, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে প্রাক্তন গভর্নর ডাক্তার আবদুল মালিকের বিচার করতে পারে। রাতে কড়া প্রহরায় তাকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি জেনারেল এ একে নিয়াজিকে আজ বিশেষ বিমানযোগে ঢাকা থেকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। তার সঙ্গে রয়েছে আরেক বন্দি, প্রাক্তন গভর্নরের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি।

ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের মুখপাত্র জানান, গতরাত পর্যন্ত আটক পাকিস্তানি সৈন্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৭০। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে চট্টগ্রাম গ্যারিসনে আটক ৮ হাজার সৈনিক। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা-কর্মচারী, পুলিশ ইত্যাদির সংখ্যা হয়েছে ২০ হাজার। এদের এক মাসের মধ্যে ভারতে নিয়ে যাওয়া হবে।

বাংলাদেশের পক্ষে আজ যেসব কূটনীতিক আনুগত্য স্বীকার করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের ইকোনমিক মিনিস্টার এহসানুল কবির, প্যারিসনস্থ কমার্শিয়াল কাউন্সিলার মুসলেহউদ্দিন আহমদ এবং ব্রাসেলস্স্থ দ্বিতীয় সচিব খায়রুল আনাম।

জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। রাতে এক বেতার ভাষণে তিনি দম্ভ সহকারে বলেন, আমরা পূর্ব পাকিস্তান ফিরে পেতে লড়াই করবো।

প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, তার চিফ অব স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান এবং নিরাপত্তা সচিব মেজর জেনারেল গোলাম উমর খানসহ কয়েকজন পদস্থ পাকিস্তানি কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেওয়া হয়।

২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ রাওয়ালপিন্ডিতে বিদেশি সংবাদদাতাদের জন্য আয়োজিত নৈশভোজে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, শেখ মুজিব এখনো কারাগারে রয়েছেন। তবে শিগগিরই তাকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হবে।

পোল্যান্ডে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আবুল বশিরুল আলম বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেন। কয়েক ডজন পোলিশ সাংবাদিকের উপস্থিতিতে তিনি তার বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধের কারণে দেড় থেকে ২ কোটি উদ্বাস্তু দেখা দিয়েছে বলে এতদবিষয়ে কর্মরত ব্রিটিশ সংস্থাগুলো জানায়। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী উদ্বাস্তুর সংখ্যা মিলে সর্বমোট উদ্বাস্তু হয়েছে ৩ কোটি মানুষ।

মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী ঢাকা এসে পৌঁছেছেন।

কলকাতাস্থ বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের প্রতিনিধি ডি পি ধরের সঙ্গে উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। অনুমান করা হয় এ বাবদ ব্যয় হবে ১০ কোটি পাউন্ড।

 ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় বিমান বাহিনীর ক্যারিবু পরিবহন বিমানে করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ বাংলাদেশ সরকারের সাতজন সদস্য ঢাকা এসে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে তাদের বিপুলভাবে সংবর্ধিত করা হয়। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত গণহত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও অন্যান্য অভিযোগে যারা অভিযুক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন একজন জেনারেল, একজন ব্রিগেডিয়ার, তিনজন কর্নেল, দুইজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেন। এছাড়া দ্বিতীয় আরেকটি তালিকায় ১২ জন অভিযুক্তের নাম রয়েছে। এই তালিকা প্রণয়ন এখনো সম্পন্ন হয়নি।

রাওয়ালপিন্ডিতে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় যে, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে।

জুলফিকার আলি ভুট্টো জানান, তিনি শিগগিরই চীন সফরে যাবেন।

২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১: প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন যে, যারা স্বেচ্ছায় প্রত্যক্ষভাবে দখলদার বাহিনীকে গণহত্যা পরিচালনায় সহায়তা করেছে, তাদের কখনো ক্ষমা করা হবে না। তিনি আরো বলেন, যারা বিশেষ পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে, তাদের ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

ভারতের পুনর্বাসন সচিব সি এস কাহলোন জানিয়েছেন, কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন শুরু হবে এবং বিদায়কালে প্রত্যেক শরণার্থীকে দুই সপ্তাহের রেশন দেওয়া হবে। তিনি আরো জানান, ইতিমধ্যে ১ হাজার ৩০ হাজার শরণার্থী দেশে ফিরে গেছেন এবং এদের প্রায় সবাই পায়ে হেঁটে ফিরেছেন।

পাকিস্তানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, আলোচনার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়েছে।

লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার অ্যালেক ডগলাস হিউমের সঙ্গে আলোচনাকালে ভারতের বিদেশমন্ত্রী সরদার শরণ সিং জানান যে, বাংলাদেশে প্রয়োজনের চেয়ে একদিনও বেশি সৈন্যদের রাখার কোনো ইচ্ছা ভারতের নেই।

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো নৌবাহিনীর ছয়জন শীর্ষ অফিসারকে বরখাস্ত করেছেন।

 ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সংকল্প প্রকাশ করে যে, স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে এদেশের তরুণ সমাজ অস্ত্রধারণ করেছিল। যে নেতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন, সেই নেতার কাছেই অস্ত্র জমা দেবেন।

ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও জনসাধারণের নিরাপত্তা বিধানের ব্যাপারে মুজিব বাহিনী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন। তারা দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন।

৫৪ জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা নগরীসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা যে নৃশংস হত্যাকা- চালিয়েছে তার পূর্ণ তথ্য উদঘাটনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দাবি জানান। তারা বলেন, যারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংস বর্বরতার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের কোনোমতেই জেনেভা কনভেনশনের ছত্রছায়ায় থাকতে দেওয়া যেতে পারে না। যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন-কবি সুফিয়া কামাল, সৈয়দ আলী আহসান, জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, সমর দাস, এ বি এম মুসা, কামাল লোহানী, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ।

বুদ্ধিজীবীরা এসব নরপিশাচদের বিচার করার জন্য বিশ্বের প্রখ্যাত আইনবিদ ও মনীষীদের নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আবেদন জানান। তারা বলেন, ইয়াহিয়া খানের বর্বর সামরিক জান্তা এবং জেড এ ভুট্টো ২৫ মার্চের কালরাতে বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য তারা এক জঘন্য পরিকল্পনার কাজে হাত দেয়, যা ছিল সুপরিকল্পিত গণহত্যার ষড়যন্ত্র এবং তা নৃশংসতার সঙ্গে কার্যকরি হচ্ছিল। ইসলামের নামে এবং আল-বদর, আল-শামস, রাজাকার, মুজাহিদ, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি ও অন্যান্য গুন্ডাপান্ডাদের সহযোগিতায় চালানো হয় সভ্যতার ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য ও লোমহর্ষক গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ। এদের কুকীর্তির বিস্তারিত বিবরণ বিশ্ববাসী এখনো সম্পূর্ণভাবে অবহিত হতে পারেনি এবং এ বিষয়ে সব তথ্য এখনো সংগৃহীতও হয়নি।

বিবিসির এক খবরে বলা হয়, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বাংলাদেশে সামরিক বিপর্যয় এবং পশ্চিম পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত বরাবর যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে তদন্তের জন্য বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন।

বাংলাদেশ কীভাবে দাঁড়াবে, সেই স্বপ্ন তখন নেতাদের চোখে। মুজিব এখনো পাকিস্তানে বন্দি-সেটাই ছিল প্রধান শূন্যতা স্বাধীন বাংলাদেশের। 

শেয়ার করুন