০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০১:২৩:৩৭ অপরাহ্ন


বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশের বাজেট কী ইঙ্গিত দিচ্ছে?
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৬-২০২২
বিশ্বমন্দায় বাংলাদেশের বাজেট কী ইঙ্গিত দিচ্ছে? সংসদে বাজেট পেশ এর পূর্বে মন্ত্রীপরিষদের সভায় অনুমোদনকল্পে আলোচনা/ফাইল ছবি


করোনা অভিঘাত থেকে উত্তরণের বৈষয়িক প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধের অশুভ প্রভাব বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক মন্দার চোখ রাঙাচ্ছে। সম্ভাব্য মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভর্তুকি প্রদানের চাপে থাকা অবস্থায় ৯ জুন ২০২২ বাংলাদেশের জাতীয় পার্লামেন্টে অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ সালের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেছেন। ৬৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা মূল্যমানের এই ঘাটতি বাজেট বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ। 

বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ বাজেট হিসেবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এতো বাজেটের উপযোগিতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে নানা আলোচনা, বিশ্লেষণ হচ্ছে। কথা উঠেছে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে কর, ভ্যাট বাবদ প্রাক্কলিত অর্থ আদৌ আদায় করা সম্ভব কিনা? আমদানি নিয়ন্ত্রণ, রফতানি বৃদ্ধি এবং বহুমুখীকরণের মাধ্যমে আদৌ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা যাবে কিনা? দেশ থেকে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ফেরত আনার ঘোষিত প্রণোদনা নীতি-নৈতিকতার দৃষ্টিতে সঠিক কিনা? সীমিত পরিসরে সকল খাতের ব্যয় বরাদ্দ বিশ্লেষণ করার সুযোগ না থাকায় আন্তর্জাতিক জ্বালানি পরামর্শক হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটের জ্বালানি বিদ্যুৎখাতের বরাদ্দ টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জনে কতটা উপযোগী সেটি আলোচনা করবো। তবে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা কোনো দেশের অব্যাহত অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি বলে প্রাসঙ্গিক আলোচনা এসে যাবে। 

শুরুতেই বাজেটের কিছু মৌলিক দিক পর্যালোচনা করা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী বাজেট ভাষণে বলেছেন প্রস্তাবিত বাজেটের মূল লক্ষ হলো- আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়া। অর্থনীতি সচল রাখার জন্য বিপুল পরিমাণ ভর্তুকির সংস্থান, দেশীয় শিল্প উৎসাহিত করা, আমদানি নিরুৎসাহিত করা, মুদ্রাস্ফীতি ৫.৫ শতাংশ সীমিত রাখা। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, দেশের মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যেই ১০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত বাজেট প্রস্তাবে দেশীয় শিল্প উৎসাহিত করা এবং আমদানি নিরুসাহিত করার কিছু সাহসী উপকরণ আছে। প্রাক্কলিত বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ৪ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আদায়ের টার্গেট আছে ৩ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরের বাইরে থেকে অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে কর-বহির্ভূতখাত অর্জনের।বিজ্ঞজনেরা টার্গেট অতি উচ্চবিলাসী বলে অর্জন বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। 

বাংলাদেশের বিত্তশালী শ্রেণির একটি বিশাল অংশ কর ফাঁকি দিয়ে থাকেন। বাস্তব অসুবিধার কারণে এনবিআর কখনো টার্গেট অর্জন করতে পারে না। ট্যাক্স নেট বাড়ানো উচিত, ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা অনেকটা ব্যাংকঋত অনাদায়ী থাকার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার কতটা কঠোর হতে পারবে সন্দেহ আছে। 

এবার আসি জ্বালানি নিরাপত্তার প্রসঙ্গে। এটা অনস্বীকার্য যে, সরকার ২০০৯-২০২২ বিদ্যুৎ উৎপাদন কষ্টে বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে। ক্যাপটিভ জেনারেশন এবং আমদানিসহ এখন ইনস্টলড ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট।  সরকারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা। তবে কিছু চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে এড্রেস না হওয়ায় ১৫ হাজার গ্রিড চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। সংকট আছে প্রাথমিক জ্বালানি জোগানে, সমস্যা আছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থায়। তবে বিদ্যুৎ সেক্টরে সিস্টেম লস নিয়ন্ত্রণে এসেছে, গ্রাহক সেবা উন্নত হচ্ছে, কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানি বিশেষত গ্যাস সংকটে তরল জ্বালানি-নির্ভর কন্টিনজেন্সিবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সিস্টেমে রাখার কারণে বিপুল অর্থ ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে।  সরকারকেও ভর্তুকি প্রদান করতে হচ্ছে। 

অর্থমন্ত্রী ২০৩১ নাগাদ উচ্চ-মধ্যআয়ের দেশ এবং ২০৪১ নাগাদ উন্নত অর্থনীতির দেশের কথা বেলেছেন। একইসঙ্গে এসডিজি অনুযায়ী, ২০৩০ নাগাদ সবার জন্য টেকসই ভিত্তিতে মানসম্মত বিদ্যুৎ জ্বালানি সুলভ মূল্যে দেয়ার অঙ্গীকারের কথা বলেছেন। এগুলো কিছুই অর্জিত হবে না যদি প্রাথমিক জ্বালানির নিশ্চিত সরবরাহ করা না যায়। বর্তমান অবস্থায় জ্বালানি জোগানের পাশাপাশি জ্বালানি সেক্টর থেকে চুরি, অপচয় নির্মূল করতে হবে, সাপ্লাই চেইন আধুনিক করে দক্ষতা বাড়াতে হবে। জাতি বাজেট ভাষণে এই মর্মে দিকনির্দেশনা আশা করেছিল। 

২০০৯-২০২২ গ্যাস উৎপাদন ১৭৮৮ এমএমসিসিএফডি থেকে ২৫২৫ এমএমসিএফডিতে উন্নীত হলেও কোনো বোরো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়নি।  উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে মূলত শেভরণ পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে। বর্তমানে সকল গ্যাসক্ষেত্রেই দ্রুত ডিপ্রেশন হচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে ২০৩১ নাগাদ সম্পূর্ণ মজুদ নিঃশেষ হয়ে যাবে যদিনা এই সময়ের মাঝে জলে-স্থলে ব্যাপক অনুসন্ধান করে নতুন গ্যাস আবিষ্কৃত না হয়। সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা ৫ আবিষ্কৃত কয়লা ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ উন্নতমানের কয়লাসম্পদ মজুদ থাকলেও উত্তোলনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। 

আরো ব্যর্থতা জলে-স্থলে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানে ব্যর্থতা। স্থলভাগে শুধু বাপেক্সকে দিয়ে অনুসন্ধান অপ্রতুল প্রমাণ হয়ে গেছে। জলভাগে বিশেষ করে গভীর সাগরে কিছুই করেনি। বাংলাদেশ ২০০৯ থেকে এযাবৎ যদিও সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তিকে বিশাল অর্জন হিসেবে সরকার বিবেচনা করে। আমাদের মতে, প্রাথমিক জ্বালানির জোগান জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের প্রধান সমস্যা। অবাস্তব জেনেও বাংলাদেশ জ্বালানি আমদানির দিকে ঝুঁকছে। একে তো বাংলাদেশের অগভীর উপকূল আমদানিকৃত জ্বালানির স্থাপনা নির্মাণে অনুপযোগী তদুপরি, বিশ্ববাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য, সাপ্লাই চেইন ভেঙেপড়ার শঙ্কা। বাংলাদেশকে অবিলম্বে নিজেদের জ্বালানি আহরণ এবং উন্নয়নের নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। বাজেটে অন্তত গ্যাস অনুসন্ধান বিষয়ে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে পেট্রোবাংলাকে অনুদান দিতে হবে।

বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী জ্বালানি বিদ্যুৎখাতে ১৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলেছেন। এর একটা বিরাট অংশ যাবে কয়লা, এলএনজি এবং পেট্রোলিয়াম দ্রব্যাদি আমদানিতে। বিশেষজ্ঞদের ক্রমাগত সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি অনুসন্ধানের বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়নি। আশাকরি বাজেট আলোচনায় এগুলো প্রাধান্য পাবে এবং অনুমোদিত বাজেটে গ্যাস-তেল অনুসন্ধানের বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত হন যে, জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতার জন্য নির্দেশনা থাকবে। জ্বালানি নিশ্চয়তা অর্জন না হলে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সবই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হবে।


শেয়ার করুন