নিউইয়র্ক সিটির গণপরিবহন ব্যবস্থা মেট্রোপলিটন ট্রান্সপোর্টেশন অথরিটির (এমটিএ) জন্য ভাড়া ফাঁকি এখন সবচেয়ে বড় আর্থিক মাথাব্যথা। ২০২৪ সালে শুধু ভাড়া ও টোল ফাঁকির কারণে সংস্থাটি প্রায় এক বিলিয়ন ডলার আয় হারিয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত সিটিজেনস বাজেট কমিশনের (সিবিসি) এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এ চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সিবিসির হিসাব অনুযায়ী, গত বছর এমটিএ বাস ভাড়ায় ৫৬৮ মিলিয়ন ডলার, সাবওয়ে ভাড়ায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার, টোল ফাঁকিতে অন্তত ৫১ মিলিয়ন ডলার এবং কমিউটার রেল টিকেটে অন্তত ৪৬ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৯১৮ মিলিয়ন ডলার হলেও আনুষঙ্গিক খাতে যোগ করলে মোট ক্ষতি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ ক্ষতির অঙ্ক ২০১৯ সালের তুলনায় তিনগুণ বেশি। তখন ক্ষতি ছিল মাত্র ৩০৫ মিলিয়ন ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিটি মিনিটে গড়ে ৩৩০ জন সাবওয়ে যাত্রী এবং ৭১০ জন বাসযাত্রী ভাড়া না দিয়ে যাতায়াত করেছেন। ফলে প্রতিদিন শতসহস্র যাত্রী সিস্টেম ব্যবহার করলেও ভাড়া প্রদান করেননি। নিউইয়র্কের মতো শহরে, যেখানে প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন মানুষ সাবওয়ে ও বাস ব্যবহার করেন, সেখানে এ ধরনের ভাড়া ফাঁকি এক বিপুল আর্থিক বোঝা তৈরি করছে। ভাড়া ফাঁকির প্রবণতা যদিও আগে থেকেই ছিল, তবে করোনাভাইরাস মহামারির সময় এটি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। এমটিএর আয় কমে গিয়েছিল, আর একই সঙ্গে অনেক মানুষ আর্থিক সংকটে পড়ে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত শুরু করেন। সিবিসির প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু রেইন বলেন, ভাড়া ফাঁকি মহামারির আগেই ছিল, কিন্তু কোভিডের পর এটি বিস্ফোরণ ঘটায়। যদিও সমস্যা এখনো বড় আকারে আছে, তবে সাম্প্রতিক তথ্য আশার আলো দেখাচ্ছে।
২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সাবওয়ে ও বাসে ভাড়া ফাঁকি তিনগুণ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বাসে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাস ভাড়া ফাঁকির হার ছিল ৪৮ শতাংশ, যা ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে নেমে এসেছে ৪৪ শতাংশে। সাবওয়েতে এ হার ১৪ শতাংশ থেকে কমে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যদিও এ সংখ্যা এখনো উদ্বেগজনকভাবে বেশি, তবে দীর্ঘদিনের ঊর্ধ্বমুখী ধারা থেমে যাওয়া নিজেই একটি বড় পরিবর্তন। সমস্যা মোকাবিলায় এমটিএ ২০২২ সালে গঠিত একটি বিশেষ প্যানেলের সুপারিশে চার দফা পদক্ষেপ নেয়। প্রথমত, টার্নস্টাইলে ফিন ও সিøভ বসানো হয়েছে, যাতে লাফিয়ে পার হওয়া কঠিন হয় এবং ইমার্জেন্সি দরজা খোলার চেষ্টা করলে সেটি ১৫ সেকেন্ডের জন্য লক থাকে। দ্বিতীয়ত, সাবওয়ে ও বাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ভাড়া পরিদর্শকের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয়ত, যাত্রীদের বোঝাতে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছে যে ভাড়া প্রদান মানে সিস্টেম সচল রাখা। চতুর্থত, নিম্নআয়ের যাত্রীদের জন্য ‘ফেয়ার ফেয়ার্স’ কর্মসূচি সম্প্রসারণ করা হয়েছে, যাতে তারা অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারেন।
এমটিএর বার্ষিক প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের বাজেট রয়েছে। এর একটি বড় অংশ নির্ভর করে ভাড়ার ওপর। অথচ ভাড়া ফাঁকি অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক বছরে সংস্থাটির আর্থিক টিকে থাকা বিপদের মুখে পড়তে পারে। ইতিমধ্যেই সংস্থার প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারের কাঠামোগত ঘাটতি রয়েছে। ঘাটতি মেটাতে নিউইয়র্কে ৯ ডলারের কনজেশন প্রাইসিং টোল আরোপ করা হয়েছে এবং সাবওয়ে ও বাসের ভাড়া বাড়িয়ে ৩ ডলার করার চিন্তাভাবনা চলছে।
ভাড়া ফাঁকি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিই করছে না, এটি যাত্রীদের আস্থাকেও ক্ষুণ্ন্ন করছে। অনেকেই বলেন, একজন যাত্রী ভাড়া দিয়ে টার্নস্টাইল অতিক্রম করেন, কিন্তু পাশের আরেকজন বিনা ভাড়ায় ঢুকে পড়েন। এটি পুরো ব্যবস্থার প্রতি অন্যায় ও অবিশ্বাস তৈরি করে।
যদিও এমটিএ নানা উদ্যোগ নিয়েছে, তবে সেগুলোর সাফল্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এক পর্যায়ে সংস্থাটি যাত্রীদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য ১ মিলিয়ন ডলারের সমীক্ষা চালায়, কিন্তু কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। তাছাড়া প্রাইভেট সিকিউরিটি গার্ড, আধুনিক টার্নস্টাইল ও বিভিন্ন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বসানো হলেও ভাড়া ফাঁকি পুরোপুরি রোধ করা যায়নি। সিবিসি সুপারিশ করেছে, দ্রুত উন্নত ফেয়ারগেট চালু করতে হবে, বাসে প্রুফ অব পেমেন্ট ব্যবস্থা চালু করতে হবে, নিউইয়র্ক সিটির সঙ্গে সমন্বয় করে পুলিশ মোতায়েনের কার্যকারিতা যাচাই করতে হবে এবং নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য ফেয়ার ফেয়ার্স কর্মসূচি আরো বিস্তৃত করতে হবে।
নিউইয়র্কের গণপরিবহন ব্যবস্থা শহরের প্রাণশক্তি। প্রতিদিন লাখো মানুষ সাবওয়ে বাস ও রেল ব্যবহার করেন। অথচ ভাড়া ফাঁকি এই ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে আর্থিক সংকটে ঠেলে দিচ্ছে। যদিও সাম্প্রতিক তথ্য কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে, তবু সমস্যাটি এখনো গুরুতর। এমটিএ যদি দ্রুত কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ না নেয়, তবে ভাড়া ফাঁকি পুরো ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও যাত্রী আস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সিবিসি প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু রেইনের ভাষায়, ভাড়া ফাঁকি কখনোই ভুক্তভোগীহীন অপরাধ নয়। এর প্রতিটি ডলার ক্ষতির বোঝা শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয় সৎ যাত্রীদেরই, যারা প্রতিদিন কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে ভাড়া পরিশোধ করেন।