০৮ অক্টোবর ২০২৫, বুধবার, ০৫:২০:০৫ অপরাহ্ন


চারদিকে অস্থিরতা মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-১০-২০২৫
চারদিকে অস্থিরতা মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা


জেন-জি সূচিত ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট ২০২৪ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ছিল নির্বাচন ব্যবস্থাকে সুকৌশলে ধ্বংস করা, রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সর্বস্তরে বিরোধী মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন। মৌলিক সংস্কার, বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ন্যূনতম সময়ে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার এক বছরের বেশি সময়ে দেশে কোনো মৌলিক পরিবর্তন বা সংস্কার করতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। খুন, ধর্ষণের ঘটনা কমেনি। চাঁদাবাজি, দখল, মব সন্ত্রাস জনজীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছে। পুলিশ এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আস্থাহীন। প্রশ্নে সুযোগসন্ধানী আমলারা নিজেদের মত কাজ করছে। আন্দোলনের অন্যতম শক্তি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রশক্তি ত্রিধাবিভক্ত। অনেকের বিরুদ্ধে নিয়োগবাণিজ্য এবং দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট এবং প্রণোদনায় দেশব্যাপী দাপিয়ে বেড়ানো এনসিপি হালে পানি পাচ্ছে না। ভুল কৌশলে বিএনপি দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সুসংহত হয়েছে জামায়াত। সরকার আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করলেও সরকারের ব্যর্থতার কারণে প্রতিদিন তৃণমূলে শক্তি পাচ্ছে আওয়ামী লীগ। হয়তো একপর্যায়ে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের সুযোগ দিতেই হবে। যেহেতু রাজনীতি বা সামাজিক কার্যক্রমে আদর্শভিত্তিক কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, তাই নির্বাচন হলেও নির্বাচিত সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

ঠিক কোন ধরনের মেটিকুলাস পরিকল্পনায় কাদের নেপথ্যে প্রণোদনায় আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে, তা এতোদিনে অনেকের কাছেই দিনের মতো পরিষ্কার। জনগণ এমনিতেই আওয়ামী লীগ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি এবং সমাজবিচ্ছিন্নতার কারণে বিরাগ ছিল। সুযোগটা নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী প্রান্তিক দল এবং গোষ্ঠী। পরিবর্তনের পর ১৯৭১ পরাজিত শক্তি মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি মুছে ফেলার জন্য ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, মব সন্ত্রাস চালিয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কোনো বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়নি। 

সংবিধানের আলোকে উচ্চ আদালতের একটি বিতর্কিত মতামতের ভিত্তিতে সৃষ্ট খণ্ডকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অবাধ লুটপাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও দেশ পরিচালনায় অনভিজ্ঞতার কারণে এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির প্রভাবে সংস্কার নিয়ে জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অধিকাংশ প্রবাসীদের নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশন বিপুল সংস্কার এজেন্ডা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। মৌলিক বিষয়গুলোতে জাতীয় ঐকমত্য একরকম ঐকমত্য হয়েছে বটে। কিন্তু সেটা নিয়েও এখনো রয়ে গেছে ফাকফোকর। একসময় সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী সংবিধান, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা পাল্টে ফেলার বিষয়ে সোচ্চার ছিল এখন সেই প্রবণতা স্তমিত। 

সরকার ঘোষিত ফেব্রুয়ারি ২০২৬ জাতীয় নির্বাচনের আগে কোনো মৌলিক সংস্কার করা সম্ভব হবে না। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু দেখতে হবে ২০২৪ স্বীকৃতি দেওয়ার বিনিময়ে ১৯৭১ যেন কোনোভাবে বিসর্জন দেওয়া না হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আদৌ প্রনিধানযোগ্য মনে হয় না।

তবে নির্বাচনের আগে সরকারকে অবশ্যই কয়েকজন পক্ষপাতদুষ্ট উপদেষ্টাকে পরিবর্তন করে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। বর্তমান সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ইঙ্গিত দিয়েছে ছাত্ররা পরিবর্তনে আগ্রহী। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনকে সরকার প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে জাতীয় নির্বাচনে সংকট এড়ানো যাবে না। তবু চাই নির্ধারিত সময়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার সংবিধান সংস্কারসহ দেশের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখুক। নির্বাচিত সরকারের অবর্তমানে সব ধরনের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য অসহনীয়, বেকার সমস্যা প্রকট। সীমান্ত অস্থির। এগুলো নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার।

যে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে জনগণ ২০২৪ পরিবর্তন কে স্বাগত জানিয়েছিল তার অনেকটাই অন্তর্বর্তী সরকারের আনাড়িপনার কারণে উবে গেছে। সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে কৃত্রিমভাবে রাজনীতির বাইরে রেখে নির্বাচন হলে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। দুর্বল সরকার ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে একটি আগ্রাসী আন্তর্জাতিক মহলের খপ্পড়ে নিয়ে গেছে। সবাই জানে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলের একটি অংশ স্বার্থপর সুযোগসন্ধানী। এমনকি সাংবাদিকদের একটি অংশ হিস্ মাস্টার্স ভয়েস। এমনি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মুক্তির পথ ক্রমশই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সরকার দেখেও না দেখার ভান করছে। অথবা বলবো পরিস্থিতীর করুন পরিণতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা নেই সরকারের। এমতাবস্থায় দেশপ্রেমিক সাধারণ জনগোষ্ঠীকে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের ভোটের অধিকার জনগণকে ফিরিয়ে দিতে হবে। একমাত্র দায়িত্বশীল প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচিত সরকার পারবে সকল চ্যালেঞ্জ সামাল দিতে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও আদর্শের ভিত্তিতে নিজেদের ব্যাপক সংস্কার করতে হবে. ঘর পড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি কিন্তু সত্যিই বিপদজনক হয়ে উঠছে।

শেয়ার করুন