ত্রিশ লাখ মানুষের মহান আত্মত্যাগ, কয়েক লাখ মামা-বোনের সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভূলুণ্ঠিত। মুক্তিযুদ্ধ অপমানিত, মুক্তিযোদ্ধারা লাঞ্ছিত। মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়করা নিষিদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি যখন অপাংক্তেয় তখন ডিসেম্বর মহান বিজয়ের মাসে উচ্চারিত হচ্ছে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। এখনো রণাঙ্গনের অনেক সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছে, খুব একটা জোরালো প্রতিবাদ কোথাও হচ্ছে বলে দেখি না। সুদূর প্রবাসে থেকে নানা মিডিয়ায় স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত শক্তির আস্ফালন আর তথাকথিত সংস্কার মিশনে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের নিস্পৃহতা দেখে অসহায় লাগে, কষ্ট পাই। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ অহংকার ও গর্ব। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান।
মানবো ১৯৭২-২০২৪ কোনো সরকার মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে ধারণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ছিল একটি সংগ্রামী জাতির বিজয়। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণ করার অপপ্রয়াসের পরিণতি আজকের অবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক মীমাংসিত বিষয়গুলোকে নিয়ে অযথা বাহাস আর বিতর্ক না করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমতাভিত্তিক শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলে দেশ গঠন করলে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে দেশ দুর্নীতি, অপশাসন মব সন্ত্রাসের কবলে পড়তো না। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির লীলাভূমিতে পরিণত হতো না।
কোন পরিস্থিতিতে জুলাই-আগস্ট ২০২৪ ঘটনা দুর্ঘটনা বা ছাত্র-জনতার বিস্ফোরণ ঘটলো সেটি সবার জানা। রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনে সাধারণ জনতা সম্পৃক্ত হয়েছিল সমতাভিত্তিক সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য। আগস্ট ২০২৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ জাতি দেখলো পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি এবং প্রতিক্রিয়াশীল চক্র স্বাধীনতার সব অর্জনকে বিসর্জন দেওয়ার অপচেষ্টায় মত্ত।
সরকারের কাছে পাওয়ার বিষয় ছিল জুলাই-আগস্ট এবং পরবর্তী হত্যাকাণ্ডসমূহের আন্তর্জাতিক মানের নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ বিচার এবং সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সেই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার। কতটুকু অর্জন হয়েছে দেশবাসী’ বিশ্ববাসী দেখছে।
দেশে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি, বরং বিভেদ সংঘাতে রূপ নিয়েছে। প্রতিহিংসার পরিণতিতে মব সন্ত্রাস, ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। কয়েকটি প্রধান দল বা গোষ্ঠীকে নির্বাচনের বাইরে রাখার মেটিকুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নের অপপ্রয়াস চলছে। মামলা সন্ত্রাসের পর অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কিছু বিচার কাজ সম্পাদন করে মৃত্যুদণ্ডের মতো বিতর্কিত দণ্ড দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
দেশের অন্যতম প্রধান দল আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম স্থগিত, আওয়ামী লীগ ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকেও নির্বাচনের বাইরে রাখার নীলনকশা দৃশ্যমান। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাকর্মীরা দেশের বাইরে। অপর প্রধান দল বিএনপির চেয়ারম্যান তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক জিয়া দেড় যুগ অনেকটা সময় বাইরে। দেশে ফেরায় নানা চ্যালেঞ্জ আছে, দেশে সক্রিয় বিতর্কিত জামায়াতে ইসলামী এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রণোদনায় গঠিত ছাত্রদের দল, এনসিপি এবং কিছু প্রান্তিক দল। সরকার ঘোষিত জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চললেও পর্দার অন্তরালে অনেক কূটনীতি চলছে।
জানি না নির্বাচন আদৌ সময়মতো হবে কি না আর হলেও সেই নির্বাচন পুঞ্জীভূত সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারবে কি না। তবে এতটুকু বলতে পারি বাংলাদেশে কখনো স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের দূরভিসন্ধি বাস্তবায়িত হবে না। জাতি কখনো কোনো বিদেশি শক্তির কাছে দীর্ঘদিন পদানত হবে না, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আবারও পুনঃজাগরিত হবে।
দেশের মানুষ ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৭ এপ্রিল, ১৬ ডিসেম্বরে নতুন করে দেশ গোড়ার শপথ নিবে। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভেসে যাবে মেটিকুলাস ডিজাইন। পালাবার পথ পাবে না প্রতিক্রিয়াশীল চক্র।