স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল
একেবারে-ও সাদামাটা ঢাকার রাজপথ। নেই বিজয়ের উল্লাস। নেই রাস্তায় রাস্তায় দল বেধে শিশু কিশোর কিংবা সব বয়সের শ্রেণী পেশার মানুষের কোলাহল। নেই মাইকে বিজয়ের আর মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝড়া দিনগুলি গানের আওয়াজ..। এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের আগের রাতেই চারিদিকে ধুমধাম আওয়াজে মধ্য দিয়ে জানান দেওয়া হতো প্রতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের আগমন বার্তা। আর সাথে সাথে সাউন্ড বক্সে দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে মাতিয়ে রাখা হতো পুরো বাংলাদেশ। কিন্তু হুট করে যেনো এসব আয়োজন লুকিয়ে গেছে বা লুকিয়ে পেলা হয়েছে বা কোথাও পালিয়ে বেড়াচ্ছে। না-কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আত্মগোপন করেছে?
এমন দৃশ্য দেখা গেছে ২০২৫ এর বিজয় দিবসে। ভোর থেকে রাজধানী ঘুরে এমনটাই চোখে পড়লো এবার। মনে হচ্ছে পুরো রাজধানীবাসী বড়ো ধরনের ঈদের ছুটি উপভোগ করছে। অথচ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কতো না আয়োজন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে জাতি বিজয় দিবস উদ্যাপন করে আসছিল। রাজধানীর শিল্প সাংস্কৃতিক অঙ্গনে-ও থাকতো বিভিন্ন আয়োজন। সারা দেশের পাড়া মহল্লায় ছিল শত শত আয়াজন।
যেভাবে এবার ১৬ ডিসেম্বরের ভোরটা শুরু হলো..
২০২৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ৫৫তম মহান বিজয় দিবস। ৯ মাসের সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের আজকের দিনটিতে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই দিনে আমরা পেয়েছি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং লাল-সবুজ পতাকা।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গণমাধ্যমের খবরে দেখা গেলো ১৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সকাল ৬টা ৫৬ মিনিটে জাতীয় স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর চৌকস একটি দল রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদর্শন করে। বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। পরে প্রধান উপদেষ্টা স্মৃতিসৌধে সংরক্ষিত দর্শনার্থী বইয়ে সই করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা, তিন বাহিনীর প্রধান, বীর মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিকসহ উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রাজধানী বিজয়ে দিবসে নিরব কেনো?
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি এবারে সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাই জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন, তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা এবং সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের উদযাপন সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে বিজয় দিবসকে ‘ঢাকাকেন্দ্রিক উৎসব’ থেকে বের করে এনে দেশব্যাপী জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার নানান পদক্ষেপ নিয়েছে। বলা হচ্ছে, বড় কেন্দ্রীয় সমাবেশের পরিবর্তে বিজয় দিবসের মূলমন্ত্রকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য। এজন্য জেলা-উপজেলায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিজয় মেলাসহ নানা আয়োজন থাকছে। এজন্য ৬৪ জেলায় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তিন দিনব্যাপী বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় সব উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ও স্মরণানুষ্ঠান হচ্ছে। কিন্তু খোদ রাজধানী ঢাকায় কেনো এসব সরকারি আয়োজনের বাইরে সাধারণ মানুষের ঢল নেই? কেনো জাতির মহান বিজয় দিবসে ঢাকা নিরব নিথর? গণমাধ্যমে খবরে জানা গেলো বরাবর ঢাকায় বড় কে›ন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক সমাবেশের সংখ্যা গড়ে তিন থেকে পাঁচটি থাকলেও এ বছর তা একটি, তাও সীমিত পরিসরে। এছাড়া গণমাধ্যমের সূত্রে আরও জানা গেছে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ছয় থেকে সাতটি অনুষ্ঠান হতো। সেখানে ২০২৫ সালে তা নেমে এসেছে তিনটিতে। বাংলা একাডেমি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আয়োজনের সংখ্যা কমেছে, যদিও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্মরণানুষ্ঠান ও আলোচনা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু এবারে এসব আয়োজনে বিশেষ করে গত দু’বছরই কেমন নিরব নিথর হয়ে যাথে বিজয়ের মাসটি। এবারেও আর পাড়া মহল্লা ঘুরে দেখা গেলো তার কোনো আয়োজন নেই। এমনকি প্রতি বছর সাত সকাল থেকেই ঘরে ঘরে শিশু কিশোরদের হাতে এই বিজয়ের মাসে ছোট ছোট পতাকার ছড়াছড়ি। এসব হাতে নিয়ে কিংবা হাতে জাতীয় পতাকার রং এর সাথে তাল মিলিয়ে নানান ধরনের ব্যান্ড ফিতা জড়িয়ে রাখার দৃশ্য নেই। রাজধানীতে এসব দৃশ্যের অনুপস্থি দেথে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে এ কেমন বাংলাদেশ দেখছে দেশবাসী? সামনেই বা আরও কি আছে? কারো কারো মতে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনা নিয়ে জাতি এক ধরনের থমকে আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ২০২৪ সালেও দেখা গেছে বিজয় দিবসে অদ্ভুত নিররতা..যার ব্যাখ্যা হয়তো কেউ কেউ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দিবেন। তবে এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা হুট করে বিলীন হয়ে যাওয়াকে একটি প্রজন্ম নিরবে হজম করবে না বলে অনেকেই মনে করেন। একসময়ে এটা-ও তাদের মধ্যে ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে উদাহরণ হিসাবে কাজ করবে বলে কারো কারো অভিমত। অতীতে যেমনটা হয়েছে কেনো কোনো দল বা ব্যাক্তির কারণে। মুক্তিযুদ্ধ-কে নিজেদের সম্পত্তি আর দলীয়করণ করতে গিয়ে তারা কিভাবে বারবার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তা সবাই দেখেছে। তা-ই সময় থাকতে সবপক্ষকেই এ-বিষয় মনে রাখা দরকার বলে মনে করেন অনেকে।