প্রধান উপদেষ্টা ড. মূহাম্মদ ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার যে নতুন সূর্য উদিত হয়েছিল, বিগত বছরগুলোতে তা স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদে ম্লান হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আবারও একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছি। গত ১৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এই কথা বলেন তিনি।
গত বছরের পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের কর্মসূচির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এই কর্মসূচি সমাপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা এর আগে জাতীয় নির্বাচন, জুলাই সনদ, সরকার পতনের এক বছরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবসে জাতির উদ্দ্যেশে ভাষণ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জুলাই আন্দোলনের সময়ের হত্যাকান্ড কিংবা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিচার ও তাকে দেশে আনার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে এই ভাষণে। এবছর বিজয় দিবস এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে।
তফসিল ঘোষণার পরদিনই নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেওয়ার সময়। অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে শরিফ ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধের ঘটনায় সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। সেই সাথে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ও তার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কথাও উল্লেখ করেন অধ্যাপক ইউনূস।
হাদি গুলিবিদ্ধ অস্তিত্বের ওপর আঘাত
অধ্যাপক ইউনূস তার ভাষণে বলেন, আপনাদের সামনে আজ উপস্থিত হয়েছি অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে। এই আনন্দের দিনে গভীর বেদনারসঙ্গে জানাচ্ছি, জুলাই অভ্যুত্থানের সম্মুখযোদ্ধা ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর সম্প্রতি যে হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা শুধু একজন ব্যক্তির ওপর আঘাত নয়-এটি বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত, আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার ওপর আঘাত।
এই ঘটনায় সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি জানান, সংকটাপন্ন হাদির চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, যারা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত, তারা যেখানেই থাকুক না কেন, তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, পরাজিত শক্তি ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্টদের এই অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হবে। ভয় দেখিয়ে, সন্ত্রাস ঘটিয়ে বা রক্ত ঝরিয়ে এই দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা কেউ থামাতে পারবে না।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে
গত নভেম্বরের ২৩ তারিখ থেকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, খালেদা জিয়া বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আছেন। এ বিষয়টি আমাদের সকলের জন্যই উদ্বেগের বিষয়। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অবিচল অঙ্গীকার, দেশের উন্নয়নে তাঁর অবদান এবং তাঁর প্রতি জনগণের শ্রদ্ধাময় আবেগ বিবেচনায় নিয়ে সরকার ইতোমধ্যেই তাঁকে রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পরিবারের ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। দেশে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজনে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সব বিষয় বিবেচনায় রয়েছে।
আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে
বিজয় দিবসের এই ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতাচ্যুত ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গও টানেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট টেরোরিস্টরা, যারা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়, আমরা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের মোকাবিলা করব। তাদের ফাঁদে পা দেব না। পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি এ দেশের পবিত্র মাটিতে আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, যারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে তারা বুঝে গেছে তরুণ যোদ্ধারা তাদের পুনরুত্থানের পক্ষে ভীষণ রকম বাধা। এই অস্ত্রহীন, ভীতিহীন, ব্যক্তিগত স্বার্থ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন, দৈনন্দিন এই চেহারার ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের সাংঘাতিক ভীতি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগ ফিরে আসার চেষ্টা করছে ইঙ্গিত দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তারা চায় নির্বাচনের আগেই তাদের ফিরে আসা নিশ্চিত করতে। নানা ভঙ্গিতে এটা তারা করবে। এই চোরাগোপ্তা খুন করার উদ্যোগ তার একটা রূপ। আরও কঠিনতর পরিকল্পনা নিয়ে তাদের প্রস্তুতি আছে।
উৎসবমূখর পরিবেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন অব্দি আর বাকি মাত্র দু’মাস। আমরা তাদের উপর নজর রাখবো এবং বাকি দিনের প্রতিটি দিন উৎসবমুখর করে রাখবো। শেখ হাসিনার বিচারের প্রসঙ্গও টানেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশে সংগঠিত হত্যাকান্ডের বিচারকাজ যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক একটি মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল স্বাধীন ও স্বচ্ছ প্রমাণভিত্তিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের ছাত্র, শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচার হত্যাকান্ডের প্রধান নির্দেশদাতা হিসেবে পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছেন। মামলায় সাজাপ্রাপ্ত শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে দেশে ফেরাতে সরকারের উদ্যোগের কথাও ভাষণে তুলে ধরেন সরকার প্রধান।
নির্বাচন, সংস্কার ও জুলাই সনদ
গণঅভ্যুত্থানের পর সরকারের সংস্কারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জানান, এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার সম্পন্ন করা হয়েছে। কয়েক ডজন পুরোনো আইন সংশোধন করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি জানান, সংস্কারের সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। মৌলিক সাংবিধানিক সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য এটি আদেশ আকারে জারি করা হয়েছে।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথরেখা এখান থেকেই সূচিত হবে। আগামী সংসদ নির্বাচনের সময় একইসঙ্গে জুলাই জাতীয় সনদের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। এই গণভোটে আপনারা হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমে সংস্কারের পক্ষে বা বিপক্ষে মতামত দিন। তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন ও গণভোট বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমরা কোন ধরনের রাষ্ট্র প্রত্যাশা করি তা নির্ভর করবে গণভোটের ফলাফলের ওপর। এই ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে নতুন বাংলাদেশের চরিত্র, কাঠামো ও অগ্রযাত্রার গতিপথ।
আগামী নির্বাচন আয়োজনে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্নক সহযোগিতা করছে বলেও এই ভাষণে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটকে সামনে রেখে প্রশাসনকে আরও কার্যকর, নিরপেক্ষ ও নির্বাচনী পরিবেশের উপযোগী করতে সরকার মাঠ প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসনে বেশ কিছু রদবদল করেছে। এই পরিবর্তনগুলো কারও প্রতি অনুরাগ বা বিরাগ প্রসূত নয়। এগুলো করা হয়েছে দক্ষতা, যোগ্যতা এবং পেশাগত সক্ষমতার ভিত্তিতে।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে বলেন, অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সক্রিয় উদ্যোগের ফলে প্রথমবারের মতো লাখ লাখ প্রবাসী এবার পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে যাচ্ছেন।