বর্তমান অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্ধেকে নেমেছে। প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা শিল্প খাতে বিরাজমান সংকট দায়ী বলে অভিমত প্রকাশ করেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় তিন গুণ। আর শিল্প খাতের উৎপাদনের প্রবৃদ্ধিতে দেখা দিয়েছে বড় বিপর্যয়। আর শিল্প খাতের সংকটের কারণ হলো মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য আমদানি ব্যায় হ্রাস, ডলার সংকট, জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে উৎপাদন হ্রাস এবং সর্বোপরি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাওয়া। বর্তমান অবস্থা বজায় থাকলে রফতানি আয় ব্যাপকভাবে কমে যাবে। ক্ষুদ্র-মাঝারি অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক কর্মজীবী বেকার হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের উন্নয়নের জোয়ার গলার কাঁটা হয়ে পড়বে।
দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক। শিল্প খাতের এহেন বিপর্যয় আগে কখনো হয় নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত তথ্যের সূত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.২৪ শতাংশ। আগের প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.৬৩ শতাংশ। মাত্র তিন মাসের ব্যাবধানে ৬.৩৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হ্রাস রীতিমত আতঙ্কজনক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ শতাংশ, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে একই প্রান্তিকে ছিল ১৪.৫০ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিল্প খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি কমেছে উৎপাদন খাতে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে গিয়ে এই খাতে বড় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় প্রান্তিকে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ০.৪৫ শতাংশ।
পর্যালোচনায় আরো দেখা গেছে তিন মাস আগেও প্রবৃদ্ধি ছিল ১১.৬০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সময় উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০.৮৮ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ১৬.০৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ডলার সংকট নিয়ে শুরু হওয়া চলতি অর্থবছরে ডলার সংকটের কারণে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নসহ বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কা সামলাতে হয়েছে দেশের শিল্প খাতকে। কমেছে উৎপাদন সঙ্গত কারণেই প্রবৃদ্ধি। উপরন্তু শিল্প খাতে দেশী বিদেশি বিনিয়োগ পৌনঃপুনিক মাত্রায় কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে গেছে। অচিরেই প্রভাব পড়বে রফতানি বাণিজ্যে। রফতানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমতাবস্থায় সরকার সুদসহ বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে সংকটে পড়বে। জ্বালানি ক্রয়ে বিদেশি মুদ্রা প্রদান করা দুরূহ হবে। জ্বালানি সংকটে চালু শিল্পগুলোর উৎপাদন কমতে থাকবে। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
উৎপাদনের প্রধান উপকরণগুলোর মধ্যে অন্যতম গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল এবং বিনিয়োগ। এই খাতগুলোর প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি। চলতি অর্থবছরে এই খাতগুলোর প্রবৃদ্ধি তলানিতে নামায় উৎপাদনের ওপর প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে শিল্প উৎপাদন সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়েছে। এ জন্য দায়ী মূলত জ্বালানি খাতের নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধি।
আসছে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময়। সরকারকে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে পুঁজি সংগ্রহের পাশাপাশি মুদ্রা ব্যাবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনে জ্বালানি খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিল্পখাতকে প্রাধান্য দিয়ে জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আমদানি রফতানি খাতের চিহ্নিত সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে বাস্তবমুখী সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।