০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:৩২:০৯ পূর্বাহ্ন


স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এখন প্রাধিকার
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০২-২০২৫
স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এখন প্রাধিকার অ্যাকশনে পুলিশ


যে নামেই ডাকুন অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ বা অন্য যে কোনো নামে, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংস, চাঁদাবাজি, লুটপাট অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন যৌথবাহিনীর সম্পূর্ণ নির্মোহ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। জাতির প্রত্যাশা ছিল জুলাই-আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনাচার, স্বৈরাচার, বৈষম্যের অবসানের জন্য জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু ছয় মাসে পরিস্থিতির পরিবর্তন না হয়ে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিরুদ্ধ মত নিষ্ঠুরভাবে দমন ক্রমাগত এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে এখন অপারেশন ডেভিল হান্টের মতো একটি চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে। তথাকথিত একনায়কত্বের পতন হয়েছে ছয় মাস হয়ে গেল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সব শ্রেণির মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল। তবে দীর্ঘ ছয় মাসে বেশ কিছু কার্যক্রমে সরকারের নিরপেক্ষতা কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়েছে। 

পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির পাশাপাশি সেনাবাহিনী কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে মাঠে আছে। কিন্তু সব বাহিনীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। দৃশ্যমান ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায় সেনাবহিনীসহ সব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। তাদের প্রতি কোনো নির্দেশনা যেতে দেরি হয়েছিল, না আদৌ হয়নি সেটা অজানা। ঘোষণা দিয়ে কিন্তু এ কাজগুলো হয়েছে।

অবশ্যই এ ঘটনা এমনিতেই হয়নি। এর পেছনে উসকানিমূলক আচরণ ছিল পতিত সরকারের দেশ-বিদেশে থাকা কিছু নির্বোধের। যারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি কোনোরকম আঁচ না করেই ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি ঘোষণা করে-এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি ও আওয়ামী লীগের নিরীহ কতিপয় নেতাকর্মীকে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ফেলে দিলো। কেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উসকানি দাতাদের আইনের আওতায় আনতে পারলো না এটা একটা প্রশ্ন? অবশেষে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফ থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হলো, এটাতে বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বস্তি এসেছে। কিন্তু সেটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে আদৌ গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না বড় প্রশ্ন। এতে যা ফল দাঁড়ালো, তাহলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ধ্বংসাত্মক কাজ করার সুযোগ দিয়ে, পতিত আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতি বাড়িয়ে দেওয়া কৌশলে। একই সঙ্গে অচেতনভাবেই সরকার ঘনিষ্ঠ একটি গোষ্ঠী সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এখন যদি সরকার অপারেশন ডেভিল হান্টের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডসহ ২০২৪-এর ৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত সব হত্যাকাণ্ড, ভাঙচুর, লুটপাট, চাঁদাবাজির হোতাদের আইনের আওতায় না এনে শুধু বিরুদ্ধ মতের মানুষদের দমন করে, তাহলে কিন্তু অনিবার্য সংকটে পড়বে ড. ইউনূস সরকার। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসায় কিন্তু বিশ্বরাজনৈতিক পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পূর্ববর্তী জো বাইডেন সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতের সংবাদ বিশ্বমিডিয়ায় আসা শুরু করেছে। বাংলাদেশে কিন্তু মার্কিন প্রশ্নে পরিবর্তনের জোয়ার যে কোনো সময় আঘাত করতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। বিশ্বসমাজ, কিন্তু নিবিড়ভাবে বাংলাদেশের প্রতিদিনের পরিস্থিতি মনিটর করছে।

বাংলাদেশ তার স্বাধীন সারভৌম সত্তা বজায় রেখে দ্রুত অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা সুদৃঢ় করে সাধারণ জনগণের জানমাল রক্ষা করুক। দেশ দ্রুত অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাক সেটি সবার কাম্য। বর্তমানে যে অবস্থা চলছে সেটির দ্রুত পরিবর্তন না ঘটলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনরায় উদ্ধার হবে না। দেশে বিনিয়োগ (দেশি-বিদেশি) স্থবির হয়ে পড়বে। শিল্পায়ন বিগত সরকারের আমল থেকেই মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেটা চলমান, বেকার সমস্যা বেড়েই চলছে। করোনা থেকেই অনেক মানুষ চাকরি, ছোট ব্যবসা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে সেটাতে কোনো সুরাহা হচ্ছে না। বিগত সরকারের অনেক কিছুর দায়ভার মাথায় নেওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে সৃষ্ট ঝামেলা সামলাতে সরকার ক্রমাগত দুর্বল হতে থাকলে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি বিধান করতে পারবে না। তখন কালোটাকা, পেশিশক্তি নির্বাচন প্রভাবিত করবে। 

এমতাবস্থায় সরকার সূচিত অপারেশন ডেভিল হান্ট কতটুকু সফল হয় দেখতে হবে। এ ধরনের চিরুনি অভিযানের আওতায় গ্যাস-বিদ্যুৎ চোরদের আনা যায় কি না- সেটাও বিবেচনা করা যেতে পারে। 

পক্ষান্তরে দেশটা কিন্তু আসলে সবার। এ দেশ ও দেশের মানুষের ভালো-মন্দ কিন্তু সবাইকেই দিনশেষে কাঁদায়, হাসায়-এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনার জন্য উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থেকে নিজ দলের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। জনমনে কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা-নেত্রীদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে। অপশাসন, দুর্নীতি, অর্থ পাচারের নির্ভরযোগ্য অভিযোগ কিন্তু অস্বীকার করতে পারবে না শেখ হাসিনা নিজেও। ফলে নিজেরা নিরাপদ অবস্থানে থেকে হঠকারী করে তৃণমূলের নিরীহ সমর্থকদের বিপদে ফেলা উচিত হচ্ছে না। 

সর্বোপরি অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি পুনঃস্থাপনের জন্য কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে কিন্তু নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জোরদার হবে। 

সবকিছুর কিন্তু শেষ আছে। আজ যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে আস্ফালন করছে, আগামী দিনে তাদের জন্য কঠিন দিন আসতেও পারে। ক্ষমতা, সম্পদ কারো জন্য চিরস্থায়ী হয় না। হিটলার, নমরুদ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কিন্তু পতন হয়েছে। ইতিহাস কিন্তু নির্মমভাবে প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। সরকার এবং সব দেশপ্রেমিক জনসাধারণের এবং জুলাই আন্দোলনে সফল করা ও যারা সহযোগিতা করেছেন, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সবারই উচিত দেশে দ্রুত স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। এটা যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই মঙ্গল। 

শেয়ার করুন