০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:৩৪:২৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


জনপ্রতিনিধিদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির নেপথ্যে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৫-২০২৪
জনপ্রতিনিধিদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির নেপথ্যে


জাতীয় নির্বাচনের মতো স্থানীয় পর্যায়েও রাজনৈতিকভাবে একদলীয় আধিপত্যের বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি ব্যবসায়ী স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে। ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন-২০২৪ (৩য় ধাপ) এর প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। হলফনামায় প্রদর্শিত প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ সম্পূর্ণ কি-না এবং বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না কিংবা কর ফাঁকির মতো ঘটনা ঘটেছে কি-না তা স্বপ্রণোদিতভাবে খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ধারাবাহিকতায় তৃতীয় ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ ও ড্যাশবোর্ড প্রস্তুত করেছে টিআইবি। প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখিয়েছে, গত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি এমন প্রার্থীদের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, যে সব জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন, তাদের আয় ও সম্পদ বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১০ বছরের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিতদের তুলনায় আয় ১০ গুণ ও অস্থাবর সম্পদ প্রায় ৩৭ গুণ বেশি বেড়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সাথে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট। দশ বছরের হিসাব তুলনা করলে দেখা যায়, পদে থাকা প্রার্থীদের আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৬৮১.৩৭ শতাংশ ও ১০১০.১২ শতাংশ। পদে না থাকাদের এক্ষেত্রে আয় ও সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৭১.৭১ শতাংশ ও ৩১.৩৫ শতাংশ।

হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতো তৃতীয় ধাপেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮.১৪ শতাংশ। চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৬.৫৩ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮.৯৯ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৩১.৫৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৪৮.৫৪ শতাংশই নিজেকে গৃহিণী হিসেবে/ গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। গৃহিণী/ গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের সাড়ে ১৪ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। ১৫.১৪ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও রাজনৈতিকভাবে একদলীয় আধিপত্যের বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি ব্যবসায়ী স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এখন জনস্বার্থের উপস্থিতি বিরল, আছে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থের বিকাশের সুযোগ। যারা ব্যবসা করেন, অন্য যে কোনো পেশাজীবির মতো তারা রাজনীতিতে আসবেন, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী অংশগ্রহণ সঠিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কিনা এবং জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে তারা রাজনীতিতে আসছেন কি-না? অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, মুনাফার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ছে, বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র। জনপ্রতিনিধি হতে পারাকে বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে একদিকে যেমন ক্ষমতা অপব্যবহারের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি সংশ্লিষ্ট খাতে সিদ্ধান্ত ও নীতিকাঠামোতে ব্যবসায়ী লবির প্রভাব ও স্বার্থ রক্ষিত হয়। ফলে যখন অনিয়ম, দুর্নীতি হয় বা সিন্ডিকেট যখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তখন দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। আবার যারা এই গোষ্ঠীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবেন তাদেরও একাংশ সুবিধাভোগী, অংশীদার বা সুরক্ষাকারী। ফলে রাজনীতিতে মুনাফামুখিতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সদিচ্ছার প্রমাণ রেখে এবং নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি সৎ থেকে জবাবদিহিতামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে সরকারের প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।’

বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের প্রায় ৩৭ শতাংশ আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০.৫ শতাংশ প্রার্থী। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ২৪.২১ শতাংশের আয় সাড়ে ষোল লাখ টাকার ওপরে। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৩.৪৫ শতাংশ। আবার চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ১৯.৫ শতাংশের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৪৫.৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তা ছাড়া, সার্বিকভাবে তৃতীয় ধাপের প্রার্থীদের মধ্যে ১০৬ জনের ১ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ রয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা আগের নির্বাচনের তুলনায় হয়েছে প্রায় চারগুণ।

তৃতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৬ শতাংশ প্রার্থী বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত, অতীতে অভিযুক্ত ছিলেন ২১.৬৩ শতাংশ। বর্তমানে ১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা ৭ জন, একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর সর্বোচ্চ মামলা চলমান রয়েছে ২৭ টি; অতীতে ১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৩৭ জন, পূর্বে সর্বোচ্চ ২৭টি মামলা ছিলো একজন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর। প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আঘাত, জনগণের শান্তিভঙ্গ, ভীতিপ্রদর্শন, অপমান, উৎপাত, নারী ও শিশু নির্যাতন, প্রতারণা ইত্যাদি ধরনের মামলা বর্তমানে রয়েছে বা পূর্বে ছিলো।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ বছরে একজন চেয়ারম্যানের আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ২৮৮৯.৬৮ শতাংশ, ৫ বছরে এই বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১০৪২২.০৪ শতাংশ। ১০ বছরে অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১৮৭৯৩ শতাংশ, ৫ বছরে স্ত্রী/স্বামী ও নির্ভরশীলদের সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫৪০০ শতাংশ। ৫ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। একজন সংসদ সদস্যের অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৩০৬৫ শতাংশ, যেখানে একজন চেয়ারম্যানের বেড়েছে ৯৮৫০ শতাংশের বেশি।

অস্বাভাবিক হারে আয় ও সম্পদ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আয় কিংবা সম্পদ বৃদ্ধি সকলের জন্যই প্রত্যাশিত, তবে অস্বাভাবিক আকার ধারণ করলে তা তো প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। প্রায় ৩৭ শতাংশ প্রার্থী হলফনামায় উল্লেখ করেছে তাদের করযোগ্য আয় নেই, যা অবিশ্বাস্য। অন্যদিকে অনেকেই আয় উল্লেখ করলেও সূত্র উল্লেখ করেননি। অর্থাৎ তারা নিজেরাই বলে দিচ্ছেন যে তাদের আয় বৈধ নয়। টিআইবি প্রণীত নির্বাচনী হলফনামার ড্যাশবোর্ড সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভান্ডার। যেমন-জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যদি যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে তাহলে এক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিশাল কর ফাঁকির ঘটনা খুঁজে বের করা সম্ভব। তা ছাড়া প্রার্থীদের হলফনামায় প্রদর্শিত আয় ও সম্পদ সম্পূর্ণ কি-না এবং বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না তা স্বপ্রণোদিতভাবে খতিয়ে দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন, রাজস্ব বোর্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের। যদিও সে দায়িত্ব পালনে এ সকল সংস্থাসমূহের ন্যূনতম আগ্রহ দেখা যায় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোকে আমাদের বিশ্লেষণের তথ্যসমূহ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই।’

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রহমান। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহসমন্বয়ক ইকরামুল হক ইভান ও কে. এম. রফিকুল আলম।

শেয়ার করুন