গণতন্ত্রের দাবিতে টানা ১৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে থাকা বিএনপি এখন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যনারে আন্দোলনকারীদের সাথে সম্পর্ক ক্রমেই মুখোমুখি অবস্থানের দিকে চলে যাচ্ছে। অনেক স্থানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার কাতারে থাকা নেতারা এখন বিএনপির বিরুদ্ধে ইঙ্গিত করেই বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে। এনিয়ে রাজনৈতিক মহলে যেমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তেমনি বিএনপিতে চরম অস্বস্তি ও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কারো কারো মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর বিএনপি ও এর পাশাপাশি দলটির ছায়াতলে থাকা প্রতিটি সংগঠনের বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার (আন্দোলকারীদের) সাথে বিএনপির দূরুত্ব বাড়াচ্ছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে আন্দোলনকারীদের প্রথম সারির নেতারা কোথাও কোথাও সরাসরি না হলে বিএনপি’র বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য ও মন্তব্য করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই রাজনৈতিক মাঠে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপির বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কর্মকান্ডের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারা এসব বক্তব্য দিচ্ছেন। এখন দেখা যাক বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কারা কি বলছেন?
মুন্সিগঞ্জ দিয়ে শুরু?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস সম্প্রতি মুন্সীগঞ্জ শহরের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ মাঠে ছাত্র-জনতার সঙ্গে মতবিনিময় সভায় কিছু কথা বলেন। সারজিস আলম আন্দোলন কীভাবে সফল হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে বলেন, ‘গত ১৬ বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে স্বৈরাচার সরকারের পতনের চেষ্টা করেছে। তারা সরকারের একটি খুঁটিও টলাতে পারেনি। মেধাবী ছাত্র-জনতা যখন রাজপথে নেমেছে, একটি গ্রুপ তত্ত্বীয় পড়াশোনা করেছে। বাস্তব ইতিহাস ঘেঁটেছে, এগুলোর সঙ্গে রিলেট (সম্পর্কিত) করে কর্মসূচিগুলো দিয়েছে, তখন আমাদের আন্দোলন সফল হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এই সমন্বয়ক সারজিস আলম দেশের আরেকটি স্থানের সমাবেশে বলেছেন, ‘দেশে এখন থেকে যা কিছু হবে, তা ছাত্র-জনতার রায়ে হবে। কোনও ফ্যাসিবাদী শক্তি কিংবা কোনও পরিবারতন্ত্রের(?) রায়ে কিছু হবে না।’ তিনি বলেন, ‘এখানে এসেও অভিযোগ পেয়েছি, মামলা-মামলা খেলা চলছে। টাকার বিনিময়ে মামলায় নাম দেওয়া হয় এবং টাকা দিলে মামলা থেকে নাম কাটা হয়। সব জায়গায় টাকা দিতে হয়। টাকা ছাড়া কোনও কাজ হয় না। এজন্যই কি এত ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছিল? এসব চলবে না, আর করতে দেওয়া হবে না।’ আরেক জায়গায় তিনি বলেন,‘একটা জিনিস মনে রাখবেন, দল(?) আর মার্কা(?) দেখার সময় শেষ, এখন সময় যোগ্যতা দেখার।’
মুন্সিগঞ্জে মতবিনিময়ে বিএনপির না!
মুন্সিগঞ্জ অনুষ্ঠিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওই সমাবেশেই তাদের ১৪ প্রতিনিধি গিয়েছিলেন। সমন্বয়ক প্রতিনিধিদলটি সেখানে ওইদিন বেলা একটা থেকে আড়াইটা পর্যস্ত জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এ সভায় জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টির একাংশ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীর) ও সিপিবির নেতারা অংশ নেন। কিন্তু জানা গেছে বিএনপি’র কোনো পর্যায়েরই নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বা অংশ নেননি, যা অনেকের কাছে প্রশ্নবোধক ঠেকেছে।
বাকি সমন্বয়কদের একই দৃষ্টিভঙ্গি
এদিকে সম্প্রতি দেশের নওগাঁ, নোয়াখালী, নড়াইল, ঠাকুরগাঁও ও বরগুনাসহ বেশ কয়েকটি স্থানে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে মতবিনিময় সভা হয়। এসব সমাবেশে ছাত্র নেতারা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। দেশে এখন যা কিছু হবে, তা ছাত্র-জনতার রায়ের ভিত্তিতেই হবে। সব ক্ষেত্রে সংস্কারের পর দেশে নির্বাচন হবে। বরগুনায় আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘দেশ এখনো ফ্যাসিস্ট, দালাল ও চাঁদাবাজমুক্ত হয়নি। উনসত্তরের অভ্যুথান ব্যর্থ হওয়ার কারণ, যারা বিপ্লব করেছে, তারা রাষ্ট্র গঠনে ভূমিকা রাখার সুযোগ পায়নি। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুথান ব্যর্থ হবে যারা রাজপথে থেকে আন্দোলন করছে, তারা যদি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের ভূমিকা না রাখে। এছাড়াও বলা হয় যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এক নয়। এই সরকার রাষ্ট্র, বিচার বিভাগ, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার করবে। সব খাতে সংস্কারের পর দেশে নির্বাচন হবে।
সমন্বয়কদের বক্তব্য কার বিরুদ্ধে
রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমন্বয়কদের প্রায় সবাই যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে তারা বিএনপি’র প্রতিই তীর্ষকভাবে ইঙ্গিত করছেন। কেননা গণাধ্যমের পাতা উল্টালেই দেখা যায় যে, কোথাও না কোথাও চাদাবাজি, দখল, পিটিয়ে মেরে ফেলার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। আর এসব খবরের পেছনে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র বিরুদ্ধেই অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হচ্ছে। দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষ গণমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করলেই এমনটাই দেখা যায়। এমন খবরও বেরিয়েছে যে, ছাত্রদের গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পলায়নের পর গোটা দেশের মতো পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় বিক্ষুব্ধ জনতার সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীরাও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িতে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করে।
এতে আতঙ্কিত উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান। এসব পরিবারের মেয়ে ও শিশু ছাড়া মাধ্যমিক ও উপরের ছেলে শিক্ষার্থীও আত্মগোপনে। যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সারাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তি সম্প্রীতি রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ সমাদৃত হয়েছিল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সারা দেশে যখন শুরু হয়ে যায় নৈরাজ্য ও সহিংসতা ঠিক তখনই বিএনপির হাইকমান্ড সর্তক হন। আর এমন পরিস্থিতিতে যে কোনো মূল্যে দেশে সম্প্রীতি রক্ষা, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব বন্ধসহ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে তড়িৎ কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে বিএনপি। দল কিংবা দলের নাম ব্যবহার করে অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিতও করা হয়েছে। এমন পদক্ষেপে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা পদ হারিয়েছেন। কিন্তু এরপরেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছেই না। বরং কারো কারো মতে,দলটির একশ্রেণীর নেতাকর্মী এখনই বিএনপি ক্ষমতায় চলে এসেছে বলে মনে করছে। রাজধানীসহ সারাদেশের পাড়া-মহল্লায় মহড়া দিচ্ছেন। এমনকি মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, রাজধানীসহ সারাদেশের পাড়া-মহল্লায় অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড বিএনপির নেতাদের নামে চাঁদাবাজদের হুংকারে বন্ধ হয়ে গেছে। আর এমন পরিস্থিতিতে দিন দিন বিএনপির মারাত্মক ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। বিএনপি ক্ষমতার আসনে না বসলেও দলটির নামে নামে গর্জে উঠা এসব চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোনো এলাতেই ভয়ে কেউ মুখই খুলছে না।
অন্যদিকে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীকারী দল জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ দলটি’র (বিএনপি) দিকে ইঙ্গিত করে এমনই অভিযোগ করেছেন। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেই ফেলেছেন, তাদের(?) তো নির্বাচন লাগেও না। ইতোমধ্যে যা দখল করেছিল ফুটপাত থেকে শুরু করে সব দখলে নিয়েছে। যা আওয়ামী লীগ ১৫ বছরে সাজিয়েছিল সব তারা দখলে নিয়ে নিয়েছে। অন্যদিকে শায়েখ চরমোনাই সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করিমও ছাড় দেননি। বলেছেন, ৫ আগস্টের পর একটি দল লুটপাট, জমি দখল ও ভাঙচুর করেছে; তাদের বাংলার মানুষ ক্ষমতায় নেবে না। আগামীতে কোনো ধর্ষণকারী লুটপাট ও চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের(?) মানুষ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
শেষ কথা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের চরম ও নির্মমভাবে পতন হয়েছে। আর এমন পরিস্থিতি সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে আশার বাণী। ধারণা করা হচ্ছে কেউ আশায় বুক বেধেও আছে যে, অতীতের মতো বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন ব্যর্থ হবে না। কিন্তু এমন আশাবাদের সময় মাঠ জুড়ে চাঁদাবাজি-লুটপাট, জমি দখল ও ভাংচুর পরিস্থিতিকে ক্রমেই পুরো পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে প্রকাশ্যেই ইঙ্গিত করে বলছে বিএনপি’র বর্তমান আচরন সদ্য পতিত আওয়ামী লীগের সাথেই মিলে যাচ্ছে। যদিও বলা হচ্ছে দলটির হাইকমান্ড শতভাগ আন্তরিকতা নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তা সত্ত্বেও কিছু নেতাকর্মীর নেতিবাচক কর্মকান্ড দিন দিন আরো বেপারোয়া হয়ে উঠছে।
আর পুরোপুরিও বন্ধ হচ্ছে না। এমনকি ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি আইনি পদক্ষেপও নেয়ার পরও থামানো যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন ধরনের পরিস্থিতি ঠেকাতে খোদ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন নয়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সমন্বয়কদের কাছে লিখিত মৌখিকভাবেও অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের ঘটনাস্থলেই ডেকে এনে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে করে গণতন্ত্র ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে হাজার হাজার নেতাকর্মীর লড়াই সংগ্রামে গুম হত্যা নির্যাতের শিকার হওয়ার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও বিএনপির নেতাকর্মীদের আত্মত্যাগ দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির ব্যানারে বা ছায়াতলে লুটেরাদের সম্পক্তি পাহাড়া ও তাদের প্রতিষ্ঠানের কারো কারো কর্নধার বনে যাওয়ার পাশাপাশি লুটপাট ও চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাকর্মীদের আচরণ ও গর্হিত কর্মকাণ্ড দলটিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পাশাপাশি বিএনপির শুভানুদায়ীদের আশঙ্কা, দলটির হাই কমান্ড এভাবে দলের নাম ব্যবহার করে লুটপাট ও চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ‘উচ্ছৃঙ্খল’ নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিও বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে পারে।
সেক্ষেত্রে কারো কারো মতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের সাথে মুখোমুখি অবস্থানে গিয়ে পুরো রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিএনপি ছিটকে পড়ে মাইনাস হয়ে গেলেও তা চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার না-ও থাকতে পারে।