১৬ জুন ২০২৫, সোমবার, ০৯:২১:৩৬ পূর্বাহ্ন


দেশকে চিত্রনায়ক রুবেল
আমরা মাল্টিকাস্টিং কাজের চেষ্টাটাই করছি না
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-১০-২০২৪
আমরা মাল্টিকাস্টিং কাজের চেষ্টাটাই করছি না চিত্রনায়ক রুবেল


মাসুম পারভেজ রুবেল। বড় ভাই সোহেল রানার হাত ধরে চলচ্চিত্রে এসেছিলেন। ১৯৮৬ সালে পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘লড়াকু’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। সম্প্রতি রায়হান রাফীর পরিচালনায় ‘ব্ল্যাক মানি’ ওয়েব সিরিজে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছেন এ সিরিজের কাজ। নতুন সিনেমা ও অন্যান্য প্রসঙ্গে তিনি কথা বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: চলচ্চিত্র অঙ্গনে আপনার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। এখন অনেক ধরনের সঙ্কট রয়েছে কোনটি সবচেয়ে বড় বাধা মনে হয়?

মাসুম পারভেজ রুবেল: হল সংকটই চলচ্চিত্রের জন্য বড় বাধা। অনেক বছর ধরে এটি চলছে। আপনি যত ভালো সিনোমাই তৈরি করেন না কেন, সিনেমা হলে সেটি প্রদর্শন করতে না পারলে চলচ্চিত্রের কোনো পরিবর্তন আসবে না। ধরুন, কয়েক হাজার ভালো ছাত্র আছে। কিন্তু যদি স্কুলই না থাকে তাহলে তারা পড়বে কোথায়? আমার দর্শক আছে, কিন্তু সিনেমা হলে তারা গিয়ে ছবি দেখতে পারছে না। হল বাড়লে প্রযোজকরাও ছবি বানানোর জন্য আগ্রহী হবেন।

প্রশ্ন: আপনার সিনেমায় আসার আগ্রহটা কিভাবে হয়েছিল? 

মাসুম পারভেজ রুবেল: চলচ্চিত্রে আগ্রহের বিষয়টা ছিলো একটু ভিন্ন। আমি কিন্তু সিনেমায় প্রথমে প্লেব্যাক করি। ‘জীবন নৌকা’ সিনেমায় ‘মেঘ যদি সরে যায় দেখতে চাঁদমুখ ভালো লাগে’ গানটি গেয়েছিলাম। পর্দায় এই গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন সোহেল রানা। এই সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছি। মাত্র ২২ বছর বয়সেই আমি পরপর দুইবার জাতীয় কারাতে চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক পাই। এই বিষয়টি আমার অভিনয় জীবনে ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। আমি ‘হিরণ পাশা’ নামে একটি সিনেমায় ফাইট ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছি। একদিন ভাইয়া হঠাৎ আমাকে ডাকলেন। আমার গোল্ড মেডেলগুলো নিয়ে তার বাসায় যেতে বললেন। আমি গেলাম। বিভিন্নভাবে আমার অনেক ছবি তোলা হলো। প্রথমে কারণটা বুঝতে পারিনি। পরে জানলাম, আমি হিরো হতে যাচ্ছি। আমার ক্যামেরার সামনে আসার ইচ্ছা ছিলো না। আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন আলমাসুদ ভাই। তিনি আমাদের সিনেমার স্ক্রিপ্ট করতেন। ১৯৮৬ সালের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পড়ছি। তখন ভাইয়া ‘লড়াকু’ করার কথা ভাবছিলেন। তিনিই ডেকে বললেন, আমরা একটা সিনেমা করতে যাচ্ছি তুমি হিরো হবি। ওই সিনেমার মাধ্যমে নায়ক হিসেবে আমার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়ে গেলো। শুধু তাই নয়, সিনেমাটি সুপার ডুপার হিট হলো। যে কারণে পরের সিনেমাগুলোতে আমি কাজ করতে পেরেছি।

প্রশ্ন: তখন সামাজিক ছবির জোয়ার। সিনেমায় মার্শাল আর্ট ব্যবহারের চিন্তা কীভাবে এলো?

মাসুম পারভেজ রুবেল : বাংলা সিনেমায় এর আগে মার্শাল আর্ট ছিলো না এটা বললে অন্যায় হবে। ভাইয়া ‘শরীফ বদমাশ’ সিনেমায় প্রথম মার্শাল আর্ট দেখানোর চেষ্টা করেন। শুরুটা সেখান থেকেই হয়েছে। এর পরিপূর্ণরূপ দর্শক দেখেছে ‘লড়াকু’ সিনেমায়।

প্রশ্ন: এই ভাবনাটা এলো কীভাবে?

মাসুম পারভেজ রুবেল: মধুমিতা হলে ‘চাইনিজ বক্সার’ দেখেছিলাম। এই সিনেমাটি দেখার পর আমি খুব উৎসাহ পাই। আমি ভেবে দেখলাম, একজন মানুষের পক্ষে দুই-চার-দশজনের সঙ্গে মারামারি করা সম্ভব। আত্মরক্ষা করা সম্ভব। এরপরই আমি কারাতে শেখা শুরু করি। আমি চেয়েছি ফিল্মের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে কারাতে ছড়িয়ে দিতে। আত্মরক্ষার কৌশল ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজিক জীবনে অনেক সুফল মিলবে। তাছাড়া এটা শরীর চর্চারও অংশ। আমাদের তরুণদের অবশ্যই ফিটনেসের প্রয়োজন রয়েছে। সে কারণেই আমি আমার প্রত্যেকটা সিনেমায় পজেটিভ চরিত্রের পাশাপাশি কারাতে ব্যবহার করেছি। গ্রামগঞ্জে আমাকে এখনও দেখলে মানুষ হু হা করে ওঠে। ওদের ভিতরে সেই প্রভাবটা আমি ফেলতে পেরেছি। এখনও আমি কারাতে শেখাচ্ছি। আমার কারাতের স্কুল আছে। আমি সেখানে একশ ছাত্রছাত্রীকে শেখাচ্ছি। আমি এখনও চাই বাংলাদেশের প্রত্যেকটা স্কুল কলেজে কারাতে শেখানো হোক। এখন প্রত্যেকদিন পত্রিকা খুললেই দেখতে পাবেন ধর্ষণের খবর। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। নারী আত্মরক্ষায় শিক্ষিত হলে তারা নিরাপদে নির্ভয়ে সমাজে চলতে পারবে। আমি মনে করি, সরকারিভাবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ।

প্রশ্ন: অ্যাকশন হিরো হিসেবে আপনার অনুপ্রেরণা কে?

মাসুম পারভেজ রুবেল : জ্যাকি চ্যান। তিনি কখনও স্টান্ট ব্যবহার করতেন না। আমি তাকে অনুসরণ করতাম। আমিও কখনও স্টান্ট ব্যবহার করিনি। শুটিং করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে অনেকবার ফিরে এসেছি। ‘বিপ্লব’ সিনেমায় আমি জ্যান্ত ইঁদুর কামড়ে ধরেছিলাম। এমন কাজ আজ পর্যন্ত কোনো নায়ক করেছে কি না আমার জানা নেই। ‘লড়াই’ সিনেমায় দুইশ ফুট উপর থেকে নামতে গিয়ে প্রায় ৭০ ফুট উপর থেকে পড়ে প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। শুটিং ইউনিটের সবাই ধরেই নিয়েছিল আমি মারা গেছি। একটি সিনেমায় প্লেনের সঙ্গে দৌড়ানোর দৃশ্য ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে এমন একটা অবস্থা হয়েছিলো যে, আমি জোরে না দৌড়ালে পাখায় গলা কেটে যাওয়ার অবস্থা! এমন দৃশ্যেও আমি স্টান্ট ব্যবহার করিনি। ‘রুবেল আমার নাম’ সিনেমায় লাফ দিতে গিয়ে পা ভেঙে প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলাম। ‘পলাতক আসামী’ সিনেমায় নয় ফিট উপর থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য ছিল। লাফানোর সময় আমার মাথা নিচের দিকে পড়ে গিয়েছিলো। জ্ঞান ফিরে দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। ‘শাহেনশাহ’ সিনেমায় আমি গেঞ্জি পরে সরাসরি কাচের ভেতর দিয়ে ভেঙে বেরিয়ে গেছি। শট শেষে দেখি সারা শরীর রক্তাক্ত। এরপর আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। এই ধরনের ঘটনা আমার একটা-দুটো নয়, অসংখ্য।

প্রশ্ন: ‘ব্ল্যাক মানি’ ওয়েব সিরিজের কাজে আগ্রহী হলেন কেন? 

মাসুম পারভেজ রুবেল: চলচ্চিত্রে নির্মাতা রায়হান রাফী মানেই এখন অন্যকিছু। হট কেকের মতো। তার প্রমাণ আমরা গত কয়েক বছরে পেয়েছি। এই একটি কারণেই আমি এই সিরিজে যুক্ত হয়েছি। তিনি যখন আমাকে ফোন করে ‘ব্ল্যাক মানি’র কথা বলেছেন, আমি তাঁর কথা ফেলতে পারিনি।

প্রশ্ন: কোন ভাবনা থেকে ওয়েবের কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন?

মাসুম পারভেজ রুবেল: ইদানীং অনেকেই ওয়েবমাধ্যমে অভিনয় করছেন। ভালো কাজ হচ্ছে এখানে। আমি যেহেতু সিনেমায় কম কাজ করছি, চিন্তা করলাম ওয়েবের ভুবনে ঢুকে একটু দেখি। ভালো হলে থাকব। না হলে এ মাধ্যমে থাকব না। তা ছাড়া ওয়েব সিরিজটির চিত্রনাট্য যখন হাতে পেয়েছি, পড়ে একটু ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে। আমার কাজের তালিকায় চোখ বুলালে দেখতে পাবেন আমি অ্যান্টি হিরো হিসেবে অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছি। ‘ব্ল্যাক মানি’ সিরিজে আমার অভিনীত চরিত্রটি একটু অ্যান্টি হিরো টাইপের। সব দিক ভেবেচিন্তেই ওয়েবে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। 

প্রশ্ন: ওয়েবের কাজ কতটা চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন?

মাসুম পারভেজ রুবেল: যেহেতু আমি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে একেবারেই নতুন, তাই চ্যালেঞ্জ তো থাকবেই। সিরিজের কাজ শুরু উপলক্ষ্যে এক প্রেস মিটে নির্মাতা রাফী বলছেন, বঙ্গ’র সব কাজে ছাড়িয়ে যাবে ‘ব্ল্যাক মানি’। সেই জায়গা থেকে কাজটি একটু চ্যালেঞ্জিং মনে করি। আর সারাজীবনই চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেছি। আমাদের সবারই চ্যালেঞ্জ রাখা উচিত। আমি বিশ্বাস করি, সবকিছু দেবার মালিক সৃষ্টিকর্তা। আমরা সবাই মিলে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে কাজটি শেষ করতে চাই। আশা করছি, রাফীর সঙ্গে চমৎকার জার্নি হবে। 

প্রশ্ন: সিনেমার কাজ শুরু হচ্ছে কবে?

মাসুম পারভেজ রুবেল: সিরিজের কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমি শুটিংয়ে অংশ নিই ১১ অক্টোবর। শরীয়তপুরে এর দৃশ্যধারণ হয়। 

প্রশ্ন: সিনেমায় কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। এর কারণ কী?

মাসুম পারভেজ রুবেল: সত্যি বলতে কী, সিনিয়র অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে নির্মাতারা চিন্তা করছেন না। আমরা মাদ্রাজ বা বোম্বের দিকে যদি তাকাই, দেখবেন সিনিয়ররা এখনও কাজ করছেন। অভিনেতা রজনীকান্তের বয়স এখন ৭৭। অমিতাভ বচ্চনের বয়সতো আরও বেশি। তারা এখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমরা এখন কাজ করলে অনেকে অনেক ধরনের মন্তব্য করেন। নির্মাতাদের বলবে, এই লোকটাকে নিছো ক্যান। আমার কথা না হয় বাদই দিলাম। বড় বড় বরেণ্য অভিনেতা যেমন- আলমগীর, সোহেল রানা, উজ্জ্বল, ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো শিল্পীদের সিনেমার কাজে ডাকা হচ্ছে না; এটি দুঃখজনক। এখন যারা কাজ করছেন, তাদের প্রতি আমার অনুরোধ বড়দের ফেলে না দিয়ে তাদের নিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। মাল্টিকাস্টিং একটা কাজ করেই দেখুন না। ভালো কিছু না হলে করলেন না। আসলে আমরা সেই চেষ্টাটাই করছি না। 

প্রশ্ন: ‘লড়াকু’ আপনার অভিষেক সিনেমা। এ সিনেমার রিমেক করার কথা বলেছিলেন...

মাসুম পারভেজ রুবেল: সিনেমাটি নির্মাণের ইচ্ছা ছিল। অনেক পরিকল্পনাও করেছিলাম। একটু পিছিয়েছে। মার্শাল আর্ট জানা নতুন একটি ছেলে দরকার। সে রকম কাউকে পাচ্ছি না। ওই ধরনের ছেলে না পেলে কাজও শুরু করা সম্ভব হবে না। তবে নতুন আরও একটি সিনেমা নিয়ে পরিকল্পনা করছি। নাম এখনও ঠিক করিনি। তাই এখনই বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। নতুন বছরের শুরুতে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ইচ্ছা রয়েছে। 

প্রশ্ন: প্রায় চার দশকের বর্ণিল ক্যারিয়ার। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কষেছেন কখনও?

মাসুম পারভেজ রুবেল: সৃষ্টিকর্তার কাছে আমি অনেক অনেক কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন। অভিনয় দিয়ে দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রি আমাকে সব দিয়েছে। হয়তো আমি এর যোগ্য নই। আমার জার্নিতে আমি সফল ছিলাম। সৃষ্টিকর্তা আমাকে সফল করে দিয়েছেন। এটি আমার দর্শকরাও জানেন। আমার কোনো অতৃপ্তি নেই।

শেয়ার করুন