আগামী ২৮ নভেম্বর বৃহস্পতিবার, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পালিত হবে ঐতিহাসিক থ্যাঙ্কস গিভিং ডে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এদিনটি এখন শুধু মার্কিন সংস্কৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিভিন্ন অভিবাসী কমিউনিটির জীবনযাত্রায় এক সুন্দর সংযোজন হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশি কমিউনিটিও এর ব্যতিক্রম নয়। কমিউনিটিতে দেশীয় ঐতিহ্যের রঙে বিশেষ আয়োজন। এবারের থ্যাঙ্কস গিভিংয়ে বাংলাদেশি পরিবারগুলোতে ডিনারের টেবিলে থ্যাঙ্কস গিভিং ডের প্রচলিত মেন্যুর সঙ্গে দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিশেষ ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে। ঐতিহ্যবাহী টার্কি তো থাকছেই, সেই সঙ্গে থাকছে দেশি খাবারের বাহারি আয়োজন। বিরিয়ানি, পোলাও, রোস্ট, কোর্মা, ভর্তা এবং পিঠার মতো প্রিয় দেশি খাবারগুলো মেন্যুতে জায়গা করে নিয়েছে। এতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনারে এক অন্যরকম উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে থাকলেও বাংলাদেশি কমিউনিটি থ্যাঙ্কস গিভিং ডেকে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং বন্ধুত্বের বন্ধনে আরো রঙিন করে তুলেছে। এদিনটি শুধু কৃতজ্ঞতার প্রকাশ নয়, বরং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, প্রিয়জনদের সঙ্গে খাবার ভাগাভাগি করা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে দেশীয় ঐতিহ্য তুলে ধরার এক চমৎকার সুযোগ হয়ে উঠেছে।
আজকের থ্যাঙ্কস গিভিং মানেই টেবিলজুড়ে থাকবে টার্কি, স্টাফিং, ম্যাশড পটেটো, ক্যান্ডিড ইয়াম, ক্র্যানবেরি সস এবং পাম্পকিন পাই। তবে প্রথম থ্যাঙ্কস গিভিং উদযাপন, যা ১৬২১ সালে প্লাইমাউথ কলোনিতে পিলগ্রিম এবং স্থানীয় ওয়ামপানোয়াগদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তার মেন্যু ছিল একেবারেই ভিন্ন। ইতিহাসের দলিল, রান্নার বই এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায়, সেই ভোজে পরিবেশিত খাবারগুলো ছিল পিলগ্রিমদের খাদ্যসংগ্রহ দক্ষতা এবং স্থানীয় প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। এটি ছিল এক সরল, কিন্তু বৈচিত্র্যময় ভোজ।
ঐতিহাসিক মেন্যুর বিবরণ : কী ছিল টেবিলে?
১৬২১ সালের প্রথম থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের মেন্যু সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের মূল উৎস দুটি। প্রথমটি হলো পিলগ্রিম নেতা এডওয়ার্ড উইনসলোর চিঠি, যেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, বন্যপাখি শিকারের মাধ্যমে ভোজের জন্য পর্যাপ্ত খাবার সংগ্রহ করা হয়েছিল। ওয়ামপানোয়াগদের প্রধান মাসাসোয়েট অতিথিদের জন্য পাঁচটি হরিণ উপহার দেন। দ্বিতীয়টি হলো গভর্নর উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ডের বিবরণ, যেখানে তিনি বলেন, জলজ পাখি এবং বুনো টার্কি সেই ভোজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
প্লিমথ প্ল্যান্টেশনের খাদ্য গবেষক ক্যাথলিন ওয়ালের গবেষণা থেকে জানা যায়, সেই ভোজে প্রধানত হাঁস, গুজ, রাজহাঁস এবং প্যাসেঞ্জার পিজন খাওয়া হয়েছিল। প্যাসেঞ্জার পিজন, যা আজ বিলুপ্ত, তখন এতো সংখ্যায় পাওয়া যেত যে এক গুলিতে শত শত পাখি ধরা পড়তো। ছোট পাখিগুলো থুথুতে গেঁথে খোলা আগুনে ভাজা হতো আর বড় পাখিগুলো সিদ্ধ বা আগুনে ঝলসানো হতো।
স্টাফিং করা পাখি তখনো জনপ্রিয় ছিল, তবে তা আজকের মতো রুটির তৈরি স্টাফিং নয়। পিলগ্রিমরা চেস্টনাট, পেঁয়াজ এবং মসলা দিয়ে পাখি ভরতেন। চেস্টনাটের এ স্টাফিং সরল হলেও সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর ছিল। ক্যাথলিন ওয়াল আরো উল্লেখ করেন যে, বড় পাখিগুলো আগুনে ভাজার পর স্যুপ তৈরির জন্য আবার সিদ্ধ করা হতো। এ স্যুপকে কর্ন বা অন্যান্য শস্য দিয়ে ঘন করা হতো।
সমুদ্রজাত এবং মাটির ফসল
প্রথম থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের মেন্যুতে সমুদ্রজাত খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ওয়ামপানোয়াগরা ইল এবং ঝিনুক, যেমন লবস্টার, ক্ল্যাম এবং মাসেল সরবরাহ করেন। তারা ঝিনুক শুকিয়ে সংরক্ষণ করতেন এবং ধূমায়িত পদ্ধতিতে মাছ সংরক্ষণ করতেন। এগুলো পিলগ্রিমদের জন্য এক নতুন ধরনের খাবার হলেও তাদের খাদ্যাভ্যাসে এটি ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মাটির ফসলের মধ্যে ফ্লিন্ট কর্ন (বহুরঙা ভারতীয় কর্ন) ছিল প্রধান শস্য। এটি পোরিজ বা রুটি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। স্কোয়াশ এবং বিনসও ছিল মেন্যুর অংশ। ফ্লিন্ট কর্ন পুষ্টিকর এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য ছিল, যা পিলগ্রিমদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া ওয়ামপানোয়াগরা বিভিন্ন ধরনের বাদাম, যেমন চেস্টনাট, ওয়ালনাট এবং বিচনাট সরবরাহ করেছিলেন।
অনুপস্থিত খাবার
আজকের থ্যাঙ্কস গিভিং মেন্যুর সঙ্গে তুলনা করলে প্রথম উদযাপনে অনেক কিছুই ছিল না। মিষ্টি আলু এবং সাদা আলু, যা যথাক্রমে ক্যারিবিয়ান এবং দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসেছে, তখনো উত্তর আমেরিকায় আসেনি। ক্র্যানবেরি থাকলেও চিনির অভাবে ক্র্যানবেরি সস তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মাখন এবং গমের ময়দার অভাবে পাম্পকিন পাইও ছিল না। পিলগ্রিমরা পাম্পকিন এবং অন্যান্য স্কোয়াশ চাষ করলেও পাই তৈরির মতো রসদ তাদের কাছে ছিল না। পানীয়ের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা ছিল। যদিও বিয়ার তাদের কাছে ছিল, তবে তা ছিল অল্প পরিমাণে। পিলগ্রিম এবং ওয়ামপানোয়াগরা মূলত পানি পান করতেন।
শেষ কথা
প্রথম থ্যাঙ্কস গিভিং ছিল সরল এবং প্রাকৃতিক উৎসব। এটি ছিল স্থানীয় প্রকৃতি ও সহযোগিতার উদযাপন, যেখানে পিলগ্রিম এবং ওয়ামপানোয়াগরা একত্রিত হয়ে খাবার ভাগাভাগি করেছিলেন। যদিও আজকের থ্যাঙ্কস গিভিং মেন্যু অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, তবে প্রথম উদযাপনের আত্মা এখনো প্রাসঙ্গিক। প্রথম থ্যাঙ্কস গিভিং আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগের গুরুত্ব এবং একত্রে উদযাপনের আনন্দ। ইতিহাসের সেই ভোজে পরিবেশিত বৈচিত্র্যময় খাবারগুলো কেবল খাদ্য নয়, বরং দুই ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। সময়ের সঙ্গে থ্যাঙ্কস গিভিং আধুনিক রূপ পেলেও সেই প্রাথমিক উদযাপনের শিক্ষা এখনো আমাদের জীবনকে অনুপ্রাণিত করে।