৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৯:৩৪:৫৭ অপরাহ্ন


দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে করণীয়
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-১২-২০২৪
দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতিতে করণীয় খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের তুলনায় বেশি


বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট গত রোববার ঢাকার লালমাটিয়ার অফিসে ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি : প্রবণতা, কারণ এবং প্রতিরোধের উপায়’ শীর্ষক একটি বিশেষ সেমিনার আয়োজন করে। সেমিনারের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান সমস্যা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও এর কারণ এবং কার্যকর সমাধানের কৌশলগুলো সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ। সেমিনারটি পরিচালনা করেন বিআইএসআর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. এম খুরশিদ আলম এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. বদরুন নেছা আহমেদ, গবেষণা ফেলো, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে উদ্বেগজনক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা এবং এর প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় নীতিগত সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

ড. বদরুন নেছা আহমেদের উপস্থাপনায় উল্লেখ করা হয় যে, স্বাভাবিক ৫-৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকা সত্ত্বেও গত দুই বছরে এটি ৯-১০ শতাংশে পৌঁছেছে। খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের তুলনায় বেশি, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় এর প্রভাব শহরের তুলনায় অনেক বেশি, যা সচরাচর হয় না। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ১১.৩৮ শতাংশে পৌঁছায়, যা মূলত খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ঘটেছে।

মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ৫ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্রের এবং ৮.৪ লাখ মানুষকে মাঝারি দারিদ্র্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে (বিশ্বব্যাংক, ২০২৩ ও ২০২৪)। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের ব্যবহার কমেছে, তবে গ্রামীণ এলাকায় চালের ব্যবহার বেড়েছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরাও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপ অনুভব করছে, বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক সরবরাহ সিস্টেমে বিঘ্ন, বন্যায় ফসলের ক্ষতি, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজারে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত বাজার তদারকি পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করছে। এছাড়া বাংলাদেশে বাজার সিগন্যাল সবচেয়ে বেশি কাজ করে। অর্থাৎ কোনো পণ্যের দাম বাড়তে পারে-এমন একটি সিগন্যাল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবাই মিলে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

সুপারিশমালা 

ড. বদরুন নেছা কিছু নীতিগত সুপারিশ প্রদান করেন। উৎপাদন এবং সরবরাহ সিস্টেম ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এছাড়াও সরকারের নিরাপত্তা প্রকল্পগুলো যেমন খোলাবাজারে বিক্রয় এবং ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য উদ্যোগ সম্প্রসারণ করা, বাজারের কারসাজি এবং মনোপলির বিরুদ্ধে তদারকি বাড়াতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বাজারের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা অপসারণ এবং বাজারের মাফিয়া কার্যকলাপ বন্ধ করা। ড. বদরুন নেছা জোর দিয়ে বলেন যে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ একটি বহুমাত্রিক এবং সমন্বিত পদ্ধতি প্রয়োজন।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আইনুল ইসলামের মতে ঘাটতি বাজেট কমাতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতিও কমাতে হবে। তাছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব নয়।

বিভিন্ন প্রজেক্টে দুর্নীতিগ্রস্তদের কারণে কতিপয় ব্যক্তির কাছে বেশি টাকা চলে যাচ্ছে। এতেই আয়ের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। মহার্ঘ ভাতা দিয়ে আয়ের ভারসাম্য তৈরি করতে গেলেও তা হিতে বিপরীত হবে। এই সুবিধা পেতে পারে ১৪ লাখ সরকারি চাকরিজীবী পরিবারের ৭০-৮০ লাখ মানুষ। বাকিরা এর ফলে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ গরিব উৎপাদক, কৃষকের কোনো আয় বাড়ছে না। এছাড়াও বড় বড় আমদানিকারকরা ছোটদের টিকে থাকতে দিতে চায় না বলেও মন্তব্য করেন ড. আইনুল।

তিনি একটি প্রাইস (মূল্য) কমিশন গঠনের প্রস্তাব দেন, যাতে এক কেজি পণ্য উৎপাদনস্থল থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে সর্বসাকূল্যে মোট কত টাকা খরচ হয় সেই হিসাব পাওয়া যায়।

ব্যবসায়ী প্রতিনিধি লুৎফর রহমান বাবুল বলেন, বড় বড় কোম্পানিগুলো বেশি দামে অধিক পরিমাণ চাহিদা সম্পন্ন পণ্য কিনে নেয়। বাজার যেহেতু সেই বড় কোম্পানিগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকে, সুতরাং তারা পরবর্তীতে খুচরা পর্যায়ে যে দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় সে দামেই ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব নিয়ে আসে।

অনুষ্ঠানের মডারেটর ও বিআইএসআর ট্রাস্টের চেয়ারম্যান ড. খুরশিদ আলম বলেন, অনেকে পরিবহন চাঁদাবাজিকে দোষারোপ করে। তবে মাঠপর্যায়ের চাঁদার হিসাব বিবেচনায় নিলে, প্রতি কেজি পণ্য পরিবহনে ৫০ পয়সাও চাঁদা বাবদ খরচ হয় না। এখানে আরো অনেক বিষয় জড়িত। যেমন স্ট্যাটাস বায়িং, যা উপমহাদেশের আর কোথাও নেই, কুক্ষিগত করে পণ্য বিক্রয় করা, দাম বেশি দেখলে বেশি করে কেনা এবং অনেক ক্রেতার বেশি দামে ক্রয় করার ক্ষমতা (বায়িং ক্যাপাসিটি) উল্লেখযোগ্য। এসব ক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে।

একটি বাড়ি করতে গেলে অন্তত ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দেওয়া লাগে, সেখানে পণ্যবাহী ট্রাকের ক্ষেত্রে জায়গা বিশেষে দিতে হয় ২০০ টাকা। দুই ধরনের চাঁদাকে মিলালে চলবে না। তবে ব্যবসায়ীরা এক্ষেত্রে সফল। চাঁদার দোহায় দিয়ে তারা ভোক্তাদের মধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির একটি শক্ত যুক্তি দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছে, যা দেশের সব মানুষ কমবেশি গ্রহণ করেছে। এবং বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকেরাও এটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পুলিশের বলে মনে করে।

এছাড়া ড. খুরশিদ আলম অভিযোগ করেন, আমরা মুখেই বলি প্রতিযোগিতামূলক বাজার। মার্কেটটা কম্পিটিটিভ নয়। যখন কেউ কুক্ষিগত করে পণ্য বিক্রয় করে, আবার যদি কোন ভোক্তা দাম না শুনেই নিজের সামাজিক স্ট্যাটাস ধরে রাখার জন্য অধিক পণ্য একসঙ্গে বেশি দামে কিনে নেয়, উভয় ক্ষেত্রেই বেশি দামে পণ্য বিক্রি করার জন্য বিক্রেতা উৎসাহী হয় ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এই আত্মবিশ্বাস থেকেই সে বর্ধিত দামে পণ্য বিক্রি করতে চায়। এভাবে একবার দাম বাড়লে আর কমে না। এগুলো বন্ধ করতে সার্বক্ষণিক বাজার মিনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে।

সেমিনারটি মূল্য স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে এবং একটি প্রতিযোগিতামূলক ও ন্যায়সংগত বাজার পরিবেশ গড়ে তুলতে কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়নের গুরুত্ব তুলে ধরে।

শেয়ার করুন