ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ‘বর্ডার জার’ টম হোম্যান ২২ ডিসেম্বর ফিনিক্স, অ্যারিজোনায় আমেরিকা ফেস্ট ২০২৪ সম্মেলনে এক বিস্তৃত বক্তব্যে মার্কিন অভিবাসন নীতি নিয়ে তার নতুন পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল, পরিবারগুলোকে আবারও আটক কেন্দ্রে রাখা এবং অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত বিতাড়িত করার পরিকল্পনা। হোম্যান জানান, নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ জানুয়ারি অফিসে ফিরে আসলে, মার্কিন নাগরিক শিশুদের পিতা-মাতাকে বিতাড়িত করতে কর্মকর্তারা দ্বিধা করবেন না। পরিবারের সঙ্গে দেশত্যাগের সিদ্ধান্তটি পিতা-মাতার ওপর নির্ভর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে অবৈধ অভিবাসী পিতা-মাতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্টে জন্ম নেওয়া মার্কিন নাগরিক শিশুদের পিতা-মাতার সঙ্গে আটক কেন্দ্রে রাখবে। তারা চাইলে তাদের শিশুদের নিয়ে চলে যেতে পারে বা এক চলেও যাতে পারে। এই কেন্দ্রগুলোতে ‘সফট-সাইডেড’ তাঁবুর মতো কাঠামো ব্যবহার করা হবে যেগুলো সীমান্তে অভিবাসন চাপ সামলাতে আগে ব্যবহৃত হয়েছিল। এক দশক আগে শুরু হওয়া সেই কঠোর অভিবাসন নীতি ট্রাম্প প্রশাসন আবারও পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এতে কোনো ধরনের দ্বিধা বা নরম মনোভাব থাকবে না।
এ নীতি শুধু অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রবর্তিত নয়, বরং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন ও শিশুবিষয়ক বিপদ সৃষ্টি করে, যা সমাজে ব্যাপক রাজনৈতিক এবং মানবিক চাপের সৃষ্টি করবে। ট্রাম্প প্রশাসনের পরিকল্পনা, বিশেষ করে পরিবারবিচ্ছিন্নকরণ এবং অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং শিশু বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন। শিশুরা যেহেতু সবচেয়ে অরক্ষিত এবং নির্ভরশীল, তাদেরকে আটকে রাখা, পরিবার থেকে আলাদা করার সিদ্ধান্ত তাদের মানসিক এবং শারীরিক উন্নতির ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি কেবল অভিবাসন আইন বাস্তবায়নে কঠোরতার প্রতীক নয়, বরং একটি মানবিক সংকটের জন্ম দেবে, যা কেবল অভিবাসন সম্পর্কিত আলোচনাকেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিগুলোকেও চ্যালেঞ্জ করবে।
হোম্যান বলেন, যেহেতু আপনি জানতেন আপনি অবৈধভাবে দেশে ছিলেন এবং একটি শিশু জন্ম দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাই আপনি আপনার পরিবারকে সেই অবস্থানে ফেলেছেন। তার মতে, যদি অভিবাসী পরিবারের সদস্যরা অবৈধভাবে দেশে অবস্থান করছেন, তবে তাদের দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং পিতা-মাতাকে তাদের পরিবার একসঙ্গে বিতাড়িত হওয়া বা সন্তানদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বলা হবে। এর ফলে আবারও পরিবারগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার আশঙ্কা রয়েছে।
২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পারিবারিক আটক কেন্দ্রগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। বাইডেন প্রশাসনের নির্দেশে তিনটি রেসিডেন্সিয়াল সেন্টার (যেখানে প্রায় ৩ হাজার বেড ছিল) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এ কেন্দ্রগুলো ডরমেটরি সদৃশ ডিজাইনের ছিল এবং এখানে শিশুবান্ধব কার্যক্রম যেমন বিনোদন এবং শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম চলতো। কিন্তু শিশুবিষয়ক চিকিৎসক ও অভিবাসন সমর্থকরা এ ধরনের আটক ব্যবস্থা খোলামেলাভাবে সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তারা মনে করেন যে, এটি শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
ফেডারেল বিচারক সান্টিয়াগো মেন্ডোজা, ২০১৫ সালে একটি মামলা রায়ে , নাবালকদের জন্য আটক থাকার সর্বোচ্চ সময় ২০ দিন নির্ধারণ করেছেন। তবে, বিতাড়নের প্রক্রিয়া সাধারণত বেশি সময় নেয়, তাই ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট প্রাপ্তবয়স্কদের আগে বিতাড়িত করার দিকে নজর দিয়েছে। কিন্তু হোম্যান জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এ নীতি পরিবর্তন হতে পারে।
হোম্যান বলেন, আমাদের পারিবারিক সুবিধাগুলো তৈরি করতে হবে। আমাদের কত বেড প্রয়োজন হবে তা ডেটা যা বলবে তার ওপর নির্ভর করবে। তিনি আরো বলেন, আগামী সরকারের অভিবাসন অভিযানে পারিবারিক আটক কেন্দ্রগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, যেখানে অভিবাসী পরিবারগুলোকে আটক রাখা হবে। হোম্যান, যিনি পূর্বে ইমিগ্রেশন এন্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের পরিচালক হিসেবে ২০১৭-১৮ সালে কর্মরত ছিলেন, বলেছেন যে, তার পরিকল্পনা হচ্ছে ৩ লাখেরও বেশি শিশু এবং কিশোরের সন্ধান পাওয়া, যারা আইন অনুযায়ী অপ্রত্যাশিতভাবে অভিবাসী শিশু হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে। তাদের অনেকেই সরকারের কেসওয়ার্কারদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে, কিন্তু হোম্যান তার সহকর্মীদের নিয়ে এ শিশুদের খুঁজে বের করতে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান। যদিও তিনি এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিলের বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন না, তবে তার মতে, কিছু শিশুরা হয়তো জোরপূর্বক শ্রমে বা যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে, যা তাকে অত্যন্ত উদ্বেগজনক মনে হচ্ছে।
হোম্যান বলেছেন, যে ট্রাম্প প্রশাসন ন্যাশনাল গার্ডকে ব্যবহার করবে অভিবাসন বিতাড়নের জন্য সমর্থন হিসেবে। কেবল প্রশিক্ষিত আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তারাই অভিবাসন আটক ও বিতাড়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। তার মতে, এটি একটি টার্গেটেড অভিযান হবে, যেখানে কেবল অপরাধী ইতিহাসযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করা হবে এবং এটি মহল্লা জুড়ে ব্যাপক অভিযান হিসেবে হবে না।
অভিবাসন সমর্থকরা এ পরিকল্পনাকে কঠোরভাবে সমালোচনা করছেন। এলসিইউ (এসিএলউ)-এর অ্যাটর্নি লি গেলার্ন্ট বলেন, প্রথমবারের মতো এই প্রশাসন বুঝতে অস্বীকার করেছে যে এটি পরিবার এবং শিশুদের জন্য ভয়াবহ ক্ষতি সৃষ্টি করেছে। তিনি দাবি করেন, যে প্রক্রিয়ায় অভিবাসন কর্তৃপক্ষ শিশুদের পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করবে, সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
টম হোম্যান তার বক্তব্যে এ কথাও বলেন যে, ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিশ্বাস হারাতে পারবে না। তাকে অনুরোধ জানানো হয়েছে যেন তিনি একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অভিবাসন ব্যবস্থা চালু করেন, যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয় এবং মানুষের আস্থা বজায় থাকে। এখন দেখার বিষয়, এ কঠোর অভিবাসন নীতির বাস্তবায়ন কতটা সফল হবে এবং এতে কতটা রাজনৈতিক এবং মানবিক চাপ তৈরি হবে।
এ কঠোর অভিবাসন নীতি, যা ট্রাম্প প্রশাসন পুনরায় চালু করতে যাচ্ছে, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি স্পষ্ট উদাহরণ। পরিবারগুলোকে আটক কেন্দ্রে রাখা এবং তাদের বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা শুধু অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় নয়, বরং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিপজ্জনক। শিশুদের পিতা-মাতার থেকে আলাদা করা এবং তাদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা হুমকির মুখে ফেলা, একটি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য। অভিবাসী পরিবারদের জন্য এই নীতি কার্যকরী হতে পারে, তবে এর ফলে যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক চাপ তৈরি হবে, তা আরও অনেক বড় সমস্যা তৈরি করবে। ফলে এটি শুধু একটি কার্যকর অভিবাসন কৌশল হিসেবে নয়, বরং একটি নিষ্ঠুর এবং অমানবিক পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হবে।