নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতির পাশাপাশি নারীর প্রতি নৃশংসতাও বাড়ছে। নারী দুর্বল তাই সবাই নারীর প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন করে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বেড়ে যায়। ফলে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার বর্তমান পরিস্থিতি, করণীয় বিষয়ে নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় এই বক্তব্য ইঠে আসে। গত ১০ মার্চ সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তন, কবি সুফিয়া কামাল ভবনে এই মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। বক্তব্য রাখেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, লেখক ও গবেষক মফিদুল হক, মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহবুব জামান, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এসএমএ সবুর, সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাড. মাসুদা রেহানা বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. শাহিদা চৌধুরী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. মো. আমিনুল ইসলাম ও অমিত দাশ গুপ্ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডীন ড. আরসাদ চৌধুরী, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, এএলআরডি’র সানজিদা খানসহ অন্যান্য সদস্যবৃন্দ।
সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, এই কমিটির সেক্রেটারিয়েট হিসেবে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কাজ করছে। বর্তমানে নারী ও কন্যা নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেছে এবং এ ব্যাপারে বিশেষ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করণীয় তা নির্ধারণ করতেই এই সভা। তিনি আরও বলেন, যেহেতু নারী দুর্বল তাই সবাই নারীর প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন করে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বেড়ে যায়। ফলে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। আজ নারীর প্রতি যা হচ্ছে তা কেবল নারীর ইস্যু নয় এটি একটি সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যা দূর করতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, অনেক আইন হওয়ার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছিল। কিন্ত এই সময় হঠাৎ করে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলো। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন ও জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয় সবসময়ই খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটি সবসময়ই গুরুত্বহীন হয়ে থাকে। বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব দ্রুতই পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে নারীরা নিরাপদে হাঁটতে পারে। নারীরা মানবিক জীবন চায়। কাউকে হিংসা করে নয় বা কাউকে ধিক্কার দিয়ে নয়, সবার সহযোগিতার মাধ্যমে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসা প্রতিরোধ করতে হবে।
লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতির পাশাপাশি নারীর প্রতি নৃশংসতাও বাড়ছে। ধর্মের নামে ধর্মের অপব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি, আইনের বাধাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য তরুণ প্রজন্মকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। চার্টার তৈরি করে সবাই একসাথে কাজ করতে পরে।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাড. এসএমএ সবুর বলেন, বিদ্যমান যে আইন আছে তার সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। কি কারণে সাজা হচ্ছে না বা মামলার দীর্ঘসূত্রিতার পেছনের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ভেবে দেখতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহবুব জামান বলেন, বর্তমান নারী নির্যাতন পরিস্থিতি নারী ও কন্যা নির্যাতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক নৈরাজ্য হয়ে উঠেছে। এটা দূর করতে হলে গবেষণা করে এলাকাভিত্তিক ধর্ষকের বিহেভিয়ার প্যাটার্ন বের করতে হবে। এজন্য গবেষণা সেল প্রয়োজন। স্পেসিফিক তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত বলেন, অনেক সময় জনদাবীর মুখে সরকারের পক্ষ থেকে আইন বাস্তবায়ন ও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তার বিপক্ষে আবার এক দল দাঁড়িয়ে যায়। ফলে দুই পক্ষ বিভক্ত হয়ে পড়ে। আইনের প্রয়োগ না হলে আইন পরিবর্তন করে বেশি কিছু করা যায় না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনার পেছনে অনেক সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকে। আইনের অপপ্রয়োগ, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বিচার পাওয়া যায় না।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ডীন ড. আরসাদ চৌধুরী বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিকারে, দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে প্রস্তাবনা সরকারকে দিতে হবে। পাশাপশি, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুুুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মাসুদা রেহান বেগম বলেন, আমাদের যার যার প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর থেকে কাজ করতে হবে। নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ কমিটির সকল সদস্য, সংগঠনের মতামত ও সুপারিশ সরকারের নিকট তুলে ধরতে হবে।
অন্যান্য বক্তারা বলেন, জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২৪ পর্যন্ত ৫১৬ জন নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ২০২৫ সালের জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতেই ৯৭ জন নারী ও কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। নারী ও কন্যা নির্যাতন আজ জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ডা. মাখদুমা নার্গিস রত্না, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ও কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।