১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ০৪:৪৯:২৩ পূর্বাহ্ন


দেশকে আলমগীর
আমার জন্য শাবানা অনেক বিশেষ
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-০৪-২০২৫
আমার জন্য শাবানা অনেক বিশেষ নায়ক আলমগীর


বাংলা চলচ্চিত্রের এক অমূল্য রত্ন, যাঁর অবদান ও অভিনয়ের ক্ষমতা আজও দর্শকদের মনে গেঁথে আছে তিনি আলমগীর। গত ৩ এপ্রিল ৭৫ বছর বয়সে পা দিয়ে তিনি আজও চলচ্চিত্রের প্রতি অটুট ভালোবাসা এবং প্রগাঢ় শ্রদ্ধা রেখে চলছেন। চলচ্চিত্রে তাঁর পাঁচ দশকের যাত্রা একদিকে যেমন সফল, তেমনি অন্যদিকে চ্যালেঞ্জেরও কমতি ছিল না। তবে, চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান অবস্থার কথা বললে, তাঁর কণ্ঠে গভীর উদ্বেগ, এক ধরনের অতৃপ্তি এবং ভবিষ্যতের জন্য আশার আলোও দেখা যায়। এ বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির 

প্রশ্ন: আপনার দীর্ঘ চলচ্চিত্র যাত্রা। ৭৫ বছর বয়সে এসে চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কেমন?

আলমগীর: চলচ্চিত্রে কাজ শুরুর পর থেকে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, তবে এখনও মনে হয়, অনেক কিছু শেখার বাকি। আমি জানি, যতটা আশা করেছিলাম, ততটা কিছু অর্জন করতে পারিনি। ৭৫ বছর বয়সে এসে মনে হয়, আমি চলচ্চিত্রে অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু অনেক কিছু হারিয়েও ফেলেছি। তবে এখন, যখন নিজের জীবনটাকে দেখি, ভালো লাগার বিষয় হলো- এই দীর্ঘ যাত্রায় আমি এখনও সতেজ, সুস্থ আছি। অবশ্যই আনন্দিত যে এই শিল্পের সাথে এত বছর কাটিয়েছি। তবে, চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থাটা সত্যিই খুব ভালো নয়। আমরা যখন শুরু করেছিলাম, তখন চলচ্চিত্র ছিল প্রাণবন্ত, সবকিছুই ছিল উজ্জ্বল। এখন তো ছবি তোলার সংখ্যা কমে গেছে, সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই বলতে পারি, ভালো আছি, তবে চলচ্চিত্রের অবস্থাটা ভালো নয়। এর জন্য আমি কিছুটা দুঃখিত।

প্রশ্ন: আপনি মনে করেন কি চলচ্চিত্রে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনা সম্ভব?

আলমগীর: আমি আশাবাদী, অবশ্যই। যদিও এখন রাত চলছে, আমি বিশ্বাস করি ভোর হবে। তবে এটা সহজ নয়। চলচ্চিত্রের এই অবস্থার জন্য অনেক কিছু দায়ী। আমাদের সময় সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল ছিল, যেখানে দর্শকরা সিনেমা দেখতে আসত। তবে এখন, মাল্টিপ্লেক্সগুলো এসে গেছে এবং সেগুলো এক ধরনের প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছে। কিন্তু, মাল্টিপ্লেক্স তো চলচ্চিত্রের আসল পরিচয় হতে পারে না। আমাদের সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল ফিরে না আসলে চলচ্চিত্রের অবস্থান উন্নতি করতে পারবে না। তবে আমি আশাবাদী, আমরা যদি একত্রিতভাবে চেষ্টা করি, তাহলে একসময় এই শিল্প আবার পুরনো গৌরব ফিরে পাবে।

প্রশ্ন: এই পাঁচ দশকে পেছন ফিরে তাকালে, চলচ্চিত্র শিল্পে কী ধরনের পরিবর্তন অনুভব করেছেন?

আলমগীর: বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে গেছে, চলচ্চিত্র শিল্পও বদলে গেছে। আমাদের সময় ছিল অন্যরকম- নতুন প্রযুক্তি, নতুন দর্শক, নতুন অভ্যস্ততা। তখনকার সিনেমাগুলোর মধ্যে এক ধরনের আবেগ ছিল, যা এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। এখনকার সিনেমাগুলোর কিছু কিছু ভালো হলেও, অধিকাংশ সিনেমা প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে গিয়ে দর্শককে কিছু দিতে পারেনি। তবে, পরিবর্তন সবসময়ই একটা সময় নেয়। আগে যেমন চলচ্চিত্র একটি শিল্প ছিল, এখন তা ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযোজকরা এখন সেলেবল (বিক্রয়যোগ্য) সিনেমা খুঁজছেন, তবে এতে শিল্পের প্রতি যেই ভালোবাসা ছিল তা অনেকাংশে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, এই পরিবর্তন চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ইতিবাচক ছিল না?

আলমগীর: না, এটা একেবারে ইতিবাচক ছিল না। চলচ্চিত্রকে কখনোই শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত নয়। যখন আমরা কাজ শুরু করেছিলাম, তখন চলচ্চিত্রের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা ছিল, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ছিল। প্রযোজকরা, পরিচালকরা, শিল্পীরা-সবাই এক জায়গায় এসে সেই ভালোবাসার অঙ্গীকারে কাজ করতেন। এখন, প্রযোজকরা কেবল সেলেবল সিনেমা চান, যেখানে দর্শকদের কিছুটা বিনোদন দিতে পারবেন। আর এই ব্যবসায়িক মনোভাব চলচ্চিত্রের আদর্শ এবং মানকে অনেকটা নষ্ট করে দিয়েছে।

প্রশ্ন: আপনি যে অপ্রাপ্তির কথা বললেন, এই অতৃপ্তি কি শিল্পীকে আরও ভালো কাজ করতে প্রেরণা দেয়?

আলমগীর: অবশ্যই, এই অতৃপ্তিই আমাকে কাজ করতে প্রেরণা দেয়। শিল্পী হিসেবে নিজেকে কখনোই সম্পূর্ণ মনে হয়নি। প্রতিটি শটের পর আমি ভাবি, ‘এটা আরেকটু ভালো হতে পারত।’ এটা আসলে স্বাভাবিক, কারণ এক জীবনে সবকিছু শেখা সম্ভব নয়। দীলিপ কুমার একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘আলমগীর, আমি অভিনয়ের ‘এ’ টাও শিখতে পারিনি।’ এমন একজন শিল্পী যখন এটা বলেন, তখন আমারও মনে হয়-আসলে আমি কতটা শিখতে পেরেছি? আমার অতৃপ্তি আমাকে প্রতিদিন নতুন কিছু শিখতে এবং আরো ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করে।

প্রশ্ন: আপনার সময়ের বহু বিখ্যাত নায়িকাদের সাথে কাজ করেছেন-শাবানা, কবরী, ববিতা। তাদের মধ্যে আপনি কার সাথে সবচেয়ে বেশি কাজ উপভোগ করেছেন?

আলমগীর: সবাই আলাদা। শাবানা, কবরী, ববিতা-তাদের সবার সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। তবে, আমার জন্য শাবানা অনেক বিশেষ। আমাদের প্রথম সিনেমা ছিল ‘দস্যুরানী’, এবং তারপর একে একে ‘অতিথি’ এবং ‘জয় পরাজয়’। এসব সিনেমা আমাদের সম্পর্কটা শক্তিশালী করেছিল। তবে, কেউ কাউকে বিশেষভাবে নির্বাচন করে জুটি গঠন করে না, এটা হয়ে যায়। আমাদের সময়ে, পরিচালকরা গল্প অনুযায়ী নায়ক-নায়িকা নির্বাচন করতেন। তবে, শাবানা, কবরী, ববিতা-তাদের সম্পর্ক নিয়ে আমি খুব বেশি কিছু বলব না, কারণ তারা সবাই আমার সিনিয়র। তবে, তাদের সাথে কাজ করার সময়টা ছিল একদমই কাজপাগল। আমাদের কাজ ছিল প্রথমে, প্রেম-টেম করার কোন সময় ছিল না।

প্রশ্ন: অন্তরালের জীবনে আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটি কী?

আলমগীর: একটা স্মরণীয় মুহূর্ত হলো, যখন কলকাতায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলাম। আমি জানতাম, সুচিত্রা সেন খুব কম মানুষকে তার কাছে আসার সুযোগ দেন। তবে আমি অনেক চেষ্টা করে, তার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রথমে তিনি সময় দিয়েছিলেন মাত্র পনেরো মিনিট, কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে সময়টা এক ঘণ্টা হয়ে গেল। আমরা অনেক কথা বলেছিলাম, এবং পরবর্তীতে আমি তার ছোট ভাই হয়ে গিয়েছিলাম। এমন মুহূর্তগুলো সত্যিই অবিস্মরণীয়।

শেয়ার করুন