৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি-নেতা গ্রেফতার হন। এখনো সেই গ্রেফতার চলছে। তবে অনেকে বিদেশেও পালিয়ে যান। দীর্ঘদিন ধরে ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতায় থাকা সেই আওয়ামী লীগ এখনো দেশ-বিদেশে ফ্যাসিবাদ নামে পরিচিত। আর দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে এই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যারা বিভিন্নভাবে সঙ্গে ছিল তারা এখন ‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী’ হিসাবে পরিচিত।
বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দীর্ঘদিন যে বাম-ডানপন্থীরা এখন ‘ফ্যাসিবাদের সহযোগী’ হিসেবে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত। এদের মধ্যে বিশেষ করে ১৪ দলের শরিক দলগুলোর অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল। দলটির হাল এখনো সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়ার হাতে। তিনি সাধারণ সম্পাদক পদটিতে আছেন। তিনি বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে তার দল শরিক হওয়ার সুবাদে তাকে টেকনোক্র্যাট শিল্পমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
তবে দলটির অস্তিত্ব এখন রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে। এর পাশাপাশি দিলীপ বড়ুয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। তাই একসময়ে দোর্দণ্ড প্রতাপ বজায় রেখে চলা দিলীপ বড়ুয়ার দলে শীর্ষ বিশেষ করে তাত্ত্বিক নেতারা এখন সাম্যবাদী দলটি পুনর্গঠন করতে চায়। কেননা সংস্কারবাদীরা মনে করেন, এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে রয়েছে সাম্যবাদী দলটি। ফ্যাসিবাদীদের দোসর অন্যতম সহযোগী বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে।
আর এমন সার্বিক বিষয় নিয়ে দলটির একজন তাত্ত্বিক নেতা বলে সুপরিচিত সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর পলিটব্যুরোর একজন সিনিয়র সদস্য। দলের ভেতরে তাত্ত্বিক বাম নেতা হিসেবে তার সঙ্গেই মূলত চীনের সর্বত্র পর্যায়ের যোগাযোগকে দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বিভিন্ন সময়ে কাজে লাগিয়েছেন। অত্যন্ত নিভৃতে থাকা এই রাজনৈতিক ব্যক্তি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয় দেশ পত্রিকার প্রতিনিধির।
দেশ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে তার দলের বর্তমান অবস্থার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটি দুই পর্বে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমেরিকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ-এর বিশেষ প্রতিনিধি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
দেশ : আপনাদের দলের বর্তমান অবস্থা কি?
সাইফুল ইসলাম : আমাদের দলের অবস্থা এক কথায় বলতে গেলে সংকটাপন্ন।
দেশ : এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে?
সাইফুল ইসলাম : দেখুন, একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হলে প্রথমত দায়ী হয় ট্রেনের চালক। রাজনৈতিক দলও একটি ট্রেনের মতো, এটার চালক সম্পাদক। দল লাইনচ্যুত হলে প্রথমত দায় বর্তাবে দলীয় প্রধানের ওপর। সম্পাদক (সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়াকে উদ্দেশ্য করে। তিনি বর্তমানে দলের সাধারণ সম্পদক) আমাদের দলীয় প্রধানও বলতে পারেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সেদিক থেকে এ বিপর্যয়ের দায় তিনি এড়াতে পারেন না। এর পেছনে আনুষঙ্গিক কারণ কী ছিল সে প্রশ্নের জবাবও তিনিই ভালো দিতে পারবেন। বস্তুত তিনি ও তার কতিপয় অনুসারীর ভুল সিদ্ধান্তের বলি হচ্ছে পার্টি।
দেশ : কিন্তু আপনারা যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করতে চাননি বা দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, তারা এতোদিন এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি কেন?
সাইফুল ইসলাম : দেখুন, আমি পার্টিতে ভিন্নমত পোষণ করি। অর্থাৎ কংগ্রেসে গৃহীত লাইনের প্রতি আমার সমর্থন ছিল না। ভিন্ন মতের অনুসারী হিসেবে পার্টির গণবিরোধী সব পদক্ষেপের আমি বিরোধী ছিলাম। আমাদের দলের সংবিধান বা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী রীতি হলো ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা দলীয় ফোরাম। আর দলীয় ফোরামে আমি এবং আমার মুষ্টিমেয় অনুসারী সব সময় ১৪ দলীয় জোটে দলের অবস্থানের বিরোধিতা করে আসছি। পার্টিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে- অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে। আমরা সেখানে সংখ্যালঘু ছিলাম। আমরা পার্টি ত্যাগ করে চলে এলে পার্টি ভেঙে যেতো, সেজন্য আমাদের লক্ষ্য ছিল পার্টির অভ্যন্তরে আন্তঃসংগ্রামের মাধ্যমে দলটিকে ১৪ দল থেকে বের করে আনা। এ প্রক্রিয়ার মাধ্যম হলো দলের জাতীয় কংগ্রেস। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কংগ্রেসে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে দলকে অক্ষত অবস্থায় ১৪ দল থেকে বের করে আনার জন্য। কিন্তু গঠনতন্ত্র অনুয়ায়ী তিন বছর পরপর দলের জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও সম্পাদক (দিলীপ বড়ুয়া) কংগ্রেস অনুষ্ঠানে সম্মত হননি। উল্লেখ করা প্রয়োজন, দুই কংগ্রেসের মধ্যবর্তী সময় পার্টির নেতৃত্বে থাকবে কেন্দ্রীয় কমিটি। মেয়াদান্তে দুই কংগ্রেসের মধ্যবর্তী সময় ৯০ দিন। বিগত কংগ্রেসের পর এখন ৮-৯ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে যদিও গঠনতন্ত্র মোতাবেক তিন বছর অন্তর কংগ্রেস অনুষ্ঠান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর মধ্যেই জাতীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। বলুন তো মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো বস্তু কি বাজারে বিক্রি হয়? আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির মেয়াদ ২০১৯ সালের প্রথম দিকেই উত্তীর্ণ হয়েছে। তারপরও তিনি কংগ্রেস অনুষ্ঠানের কোনো পদক্ষেপ নেননি। মেয়াদোত্তীর্ণ জিনিসপত্র যেমন বাজারে অচল, তেমনি আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটিও পার্টি পরিচালনার ক্ষেত্রে অচল হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি আমাদের মতে বৈধতা হারিয়েছে। কিন্তু সম্পাদক মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিকেই বৈধ কমিটি হিসেবে চালিয়ে আসছেন। তার এ আমলাতান্ত্রিকতার কারণে কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে কংগ্রেসের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছি, কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। ২০১৯ এরপর সব সিদ্ধান্ত সম্পাদকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর দায়-দায়িত্ব অন্য কেউ বহন করবে না।
দেশ : আপনাদের ওপর কেমন চাপ ছিল? কোন তরফের চাপের কথা বলছেন?
সাইফুল ইসলাম : আমরা সব সময়ই মনস্তাত্তিক চাপে ছিলাম। এখন নেতাকর্মীদের মানসিক চাপ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৪ দলে অবস্থান করে দলের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কোনো নেতাকর্মী কোনো প্রকার সুযোগ-সুবিধা না পেলেও এখন সমাজের লোকজন দলের নেতাকর্মীদের দালাল বলে আখ্যায়িত করে। অথচ এ নেতাকর্মীরা ১৪ দলের কোনো প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করেননি। আমি নিজেও ১৪ দলীয় জোটের কোনো সভা-সমাবেশে যোগ দিইনি। তারপরও মানুষের নিন্দা, সন্দেহ এবং একধরনের অচ্যুত; আমাদের মনস্তাত্তিক চাপ বৃদ্ধিসহ নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা, হতাশাও বিরাজমান। আমাদের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ ছিল, কারণ ১৪ দল থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিলেই রাজনৈতিক যুক্তি প্রদর্শন না করে সম্পাদকের তরফ থেকে বলা হতো ১৪ দল ত্যাগ করলে নেতাকর্মীদের আওয়ামী সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতে হবে। এটাও ছিল এক ধরনের চাপ।
দেশ : তাহলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এতোটা বছর কীভাবে জোটবদ্ধ হয়ে থাকলেন?
সাইফুল ইসলাম : ২০০৪ সালে তখনকার প্রেক্ষাপটে ১৪ দলীয় জোট আত্মপ্রকাশ করে। যুক্তি ছিল দেশে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করতে হলে কথিত অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোট বাঁধতে হবে। যুক্তি দেখানো হলো তথাকথিত বাংলা ভাই-শায়খ আব্দুর রহমান প্রমুখ ৬৩ জেলায় একসঙ্গে বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে দেশে মৌলবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই জোটবদ্ধ হতে হয়েছে। এ ঘটনার পর তৎকালীন বিএনপি সরকার বাংলা ভাই ও শায়খ আ. রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পর আমরা যখন বললাম, সরকার তো জঙ্গি ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সুতরাং সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা দরকার। কারো কোনো কথাই রক্ষা হলো না। পরবর্তী সময়ে নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় সরকার গঠিত হলো। পার্টির সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী হলেন, তখন তো মনে করা হলো বিপ্লবই হয়ে গেল। এতোদিন কি করেছিলাম- এ প্রশ্নের উত্তরে বলবো, আমাদের মধ্যে কই মাছের প্রাণ বিদ্যমান- তাই জীবনমৃত অবস্থায় বেঁচে ছিলাম। এখানে উল্লেখ করা দরকার, জোটটি গঠিত হয়েছিল মোটা দাগে ২৩ দফার ভিত্তিতে, একক কোনো দলের সঙ্গে নয়। কিন্তু নির্বাচনের পর ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ ২৩ দফাকে পাশ কাটিয়ে সবকিছুই দলীয় করণ করে ফেলে।
দেশ : আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কী কী সুযোগ সুবিধা পেলেন?
সাইফুল ইসলাম : সুযোগ-সুবিধার কথা চিন্তা করে রাজনীতিতে আসিনি। আমার রাজনীতিতে আসার বয়স প্রায় ৬২ বছর- এ দীর্ঘ সময় রাজনীতি করতে গিয়ে হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হয়েছি, আত্মগোপনে দুঃসহ জীবনযাপন করেছি, জেল খেটেছি, বিনিময়ে পেয়েছি কষ্ট ও গ্লানি। আমার বর্তমানে ৬২ পয়সাও ব্যালেন্স নেই। বলতে পারেন দিন আনি-দিন খাই অবস্থা। রাজনীতি করতে গিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি ও অস্থাবর সম্পত্তি সবকিছুই বিক্রি করতে হয়েছে। কারা মুক্তির পর মহলবিশেষের পক্ষ থেকে লোভনীয় প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু আমি কারো কাছে স্বর্ণ-রৌপ্য সূত্রে আবদ্ধ হয়নি। কারণ আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই, মাথানত করতে শিখিনি। আদর্শিক কারণে রাজনীতিতে এসেছিলাম, আদর্শের ওপর অবিচল আস্থা রেখেই মরতে চাই। সমাজতন্ত্রই আমার জীবনের শেষকথা।
দেশ : তা-না হলে কীসের আশায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে এতোদিন একসঙ্গে ছিলেন?
সাইফুল ইসলাম : কীসের জন্য ছিলাম, কীভাবে ছিলাম-এ প্রশ্নের উত্তর আমি এর আগে দিয়েছি। এখন বলছি, কাগজে-কলমে দলে ছিলাম ঠিকই। আমি ১৪ দলের কোনো সভা-সমাবেশে যোগ দিইনি। দলীয় সমাবেশে যোগ দিলেও কোনোদিন আওয়ামী সরকারের সমর্থনে বক্তব্য রাখিনি। দলীয় আদর্শ অনুযায়ী, মেহনতী মানুষের পক্ষে কথা বলেছি। সরকারের গুম, খুন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও নির্যাতন, ভোট ডাকাতি ও সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবির সপক্ষে কথা বলেছি। ইন্টারনেটে যদি আমার বক্তব্য পাওয়া যায়, তবে দেখতে পারেন।
দেশ : এই আওয়ামী লীগের সঙ্গে এতোদিন থাকাটা আপনাদের দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হলো না?
সাইফুল ইসলাম : এ প্রশ্নটা আপনি ঠিকই উত্থাপন করেছেন। তবে তারা যে আদর্শের জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে, দলটি যদি আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে সে কাজটি করতে পারতো, তাহলে এ অপবাদ ঘুচে যেতো। আমরা যারা ভিন্নমত পোষণ করি, সব সমই ওইসব ত্যাগী নেতাদের আদর্শ ও আশা-আকাক্সক্ষা যাতে বাস্তবায়ন করা যায়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট ছিলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে জোটপন্থীরা আমাদের মতামত অগ্রাহ্য করেন। তার কারণ ছিল ঝুঁকিমুক্ত জীবনযাপন ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্য অক্ষুণ্ন রেখে ব্যক্তিবিশেষের কিছু একটা পদ-পদবি প্রাপ্তির প্রত্যাশা।