‘বিদেশে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এটাই আমার ঠিকানা।’ এ বক্তব্যে খালেদা জিয়া প্রমাণ করে দিয়েছেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মাটি, এ দেশের জনগণ সবকিছুই তার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। শত নির্যাতন, কারাভোগ, চিকিৎসা নিতে না দেয়া, চোখের সামনে নিজের বড় ছেলের উপর অমানুষিক নির্যাতন করে প্রায় পঙ্গু করে দেয়া, ছোট ছেলেকে তিলে তিলে মেরে ফেলা। এতকিছুর পরও খালেদা জিয়ার ওই একই উচ্চরণ এটাই (বাংলাদেশ) আমার ঠিকানা। খালেদা জিয়া দেশের বাইরে চলে যাওয়ার প্রস্তাবনা গ্রহণ করলে উপরেল্লিখিত নির্যাতন হয়তো সহ্য করতে হতো না। দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য তিনি এখনও আপোষহীন। দেশের মানুষের টানে ফিরে এসেছেন তিনি। হাঁটতে পারছেন না। হুইল চেয়ার ব্যবহার করছেন। এরপরও তার শারীরিক ভাষাতে সেই লৌহমানবীর প্রতিচ্ছবি। ফিরেছেন। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে এ পর্যন্ত বহু চেষ্টা হয়েছে বিএনপিকে ভেঙ্গে টুকরো করতে। কিন্তু অসাধারণ এক নেতৃত্বের গুণে সব আগলে রেখেছেন আজোও। সেই নেতাকর্মীদের ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ৬ মে মঙ্গলবার বিমানবন্দর থেকে গুলশানে তার ভাড়া বাসা ফিরোজা পর্যন্ত। দু’ধারে সেই সকাল থেকে হাতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বরণে দাঁড়িয়ে। ফুলের পাপড়ি ছড়িয়েছেন। হাত নাড়িয়ে জবাব দিয়েছেন দীর্ঘ ভ্রমনক্লান্ত বেগম খালেদা জিয়া। দেখলেন দুই পুত্রবধু জুবাইদা রহমান ও শর্মীলা। এখনও তাদের শাশুড়ি ও দেশনেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ভালবাসা।
দীর্ঘদিন থেকে চিকিৎসকের যে পরামর্শ, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য তার একাধিক জটিল রোগের চিকিৎসা উন্নত বিশ্বেই সম্ভব। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সেটা ভ্রুক্ষেপ করেনি। ছাড় দেয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহযোগিতায় গত ৭ জানুয়ারি লন্ডন গিয়েছিলেন। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে ৬ মে মঙ্গলবার ফিরলেন দেশে দুই পুত্রবধু নিয়ে।
এদিকে খালেদা জিয়ার দেশে ফেরা নিয়ে বিএনপিতে উচ্ছাস। প্রথমত খালেদা জিয়াকে তারা ফিরে পাচ্ছেন। এবং অনেকটাই সুস্থ খালেদা জিয়াকে তারা নেতা হিসেবে দেশে পাচ্ছেন। তারেক রহমান ১৭ বছর আগে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি এখনও লন্ডনেই। খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার পর মাইনাস থ্রীর একটা গুজবও চলে। সেটা কেটে গেছে। হাসিনা তো গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে গেছে। খালেদা জিয়া ফিরেছেন এতে জনমনে স্বস্তি। একজন জনরোষে পালালেন, আরেকজন ভালবাসায় ফিরলেন।
১৭ বছর পর ফিরলেন জোবাইদা রহমান
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ডা. জোবাইদা রহমান ফিরছেন প্রায় ১৭ বছর পর। ৫ মে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাতে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়া ও জোবাইদা রহমানসহ অন্যদের পৌঁছে দেন তারেক রহমান। তিনি নিজে গাড়ি চালিয়ে মা’কে নিয়ে আসেন বিমান বন্দরে। মা’কে বিদায় জানানোর সময় এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়।
একটা ভিডিওতে দেখা যায় খালেদা জিয়া বসা, তার কাঁধে হাত রেখেছেন তারেক রহমান। বেগম খালেদা জিয়া কিছু বলছিলেন। পাশে দাড়িয়ে জুবাইদা রহমান হাসছিলেন।
একটি ভিডিও ও কিছু ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেসবে দেখা যাচ্ছে, মায়ের চোখে-মুখে যেমন ফুটে উঠেছে ছেলের থেকে বিদায় নেওয়ার কষ্ট, তেমনি ছেলের কণ্ঠেও শোনা গেছে মমতার মৃদু আশ্বাস। এই মুহূর্তটি শুধু রাজনৈতিক পরিবারের নয়, বরং যে কোনো মা-ছেলের সম্পর্কের গভীর আবেগের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিদায়ের মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে হুইলচেয়ারে বসা অবস্থায় দেখা যায়। পাশেই ছিলেন তার নাতনি জাইমা ও পুত্রবধূ । তিনি ছেলেকে উদ্দেশ করে বলেন, “তুমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?” জবাবে তারেক রহমান বলেন, “তুমি বিমানে ওঠার পর জাইমাকে নিয়ে চলে যাব।” এরপর মা আবার অনুরোধ করেন, “তোমরা ভাইয়ার খেয়াল রেখো।” লন্ডনের এক বিএনপি নেতা বলেন, তারেক রহমান ও জাইমা রহমানও যেন বুকে পাথর চেপে বিদায় জানিয়েছেন।
বহুবছর পর মা ও ছেলের দেখা হয়েছিল। মধ্যে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেলেন। খালেদা জিয়াও অনেক বেদনা পুষে রেখেছিলেন। দেখা হলো। আজ ফিরছেন নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
আগেই প্রস্তুত ছিল ‘ফিরোজা’
ঢাকায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কথা জেনে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি রাজকীয় বহরের বিশেষ বিমান দিয়েছিলেন। ওই বিশেষ বিমানে (বিশেষ ধরনের এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) করে তিনি ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছান। সেই বিশেষ বিমানেই আবার লন্ডন থেকে মঙ্গলবার দেশে ফিরছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
গুলশানের ৮০ নং সড়কের ১ নং বাড়িটি ‘ফিরোজা’। চারদিকে দেয়াল ঘেরা, সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য কক্ষ। পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ এবং চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)এর সদস্যরা।
বাসার ভেতরের সব কক্ষগুলোর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও শেষ হয়েছে। সামনের সবুজ আঙিনায় ফুল গাছের টব দিয়ে সাজানো হয়েছে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘‘ম্যাডামের বাসা কমপ্লিটলি রেডি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা, বাসার আঙিনা পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, সাজসজ্জা কোনো কিছুই বাদ নেই। ম্যাডামের স্বজনরা সব কিছু তদারকি করেছেন। এখন আমরা সবাই ম্যাডামের অপেক্ষায় আছি।” দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে খালেদা জিয়া পৌঁছান ফিরোজায়।
উল্লেখ্য, গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। লন্ডন ক্লিনিকে টানা ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বাসায় লন্ডনের ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
কতটা সুস্থ্য খালেদা জিয়া
লন্ডনে চিকিৎসার পর ‘শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকটুকু সুস্থ’ আছেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ভ্রমনক্লান্তির পরও চেহারায় সে ছাপ দেখা যায়নি। বড় কথা, ফিরোজা গাড়ি থেকে নেমে হেটেই প্রবেশ করেন তিনি নিজ বাসায়। তার এই হেঁটে প্রবেশ করা নেতানেত্রীদের মধ্যে মনবল আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে গুলশানে ‘ফিরোজা’র সামনে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন একথা জানান। তিনি বলেন, ‘‘উনি অনেকটা শারীরিক মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে লন্ডন থেকে ফেরত এসেছেন। চিকিৎসা পরবর্তিতে উনার (খালেদা জিয়া) শারীরিক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ, অনেকটুকু উনি সুস্থ আছেন। মানসিকভাবেও উনি স্টাবেল (স্থিতিশীল) আছেন। তবে ১৪ ঘন্টার জার্নি এবং রাস্তার এই জার্নির কারণে উনি শারীরিকভাবে একটু অবসন্ন। তারপরও মানসিকভাবে উনার অবস্থা অত্যন্ত স্থিতিশীল আছে।” খালেদা জিয়ার এই সুস্থতা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান অধ্যাপক জাহিদ।
চার মাস লন্ডনে উন্নত চিকিসা শেষে মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে কাতারের আমিরের দেয়া বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছান। সেখানে থেকে গাড়িতে করে তার গুলশানের বাসা ফিরোজায় আসতে দুই ঘন্টারও বেশি সময় লাগে। বিমান বন্দর থেকে গুলশানের বাসায় পর্যন্ত সড়ক পথে দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রচণ্ড ভিড় থাকায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গাড়িবহর ধীর গতিতে এগুতে হয়। এক পর্যায়ে নির্ধারিত রুট পরিবর্তন করে নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ফিরোজায় পৌঁছায় বেলা দেড়টায়।
বিএনপির চেয়ারপারসনের জন্য কাতারের ‘রাজকীয় বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স’ ‘বিনাভাড়ায়’ দেয়ার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি এবং কাতার কতৃপক্ষের প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কতৃজ্ঞতার কথাও জানান তিনি।
অধ্যাপক জাহিদ জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন লন্ডনে একদিন কম চার মাস ছিলেন। সেখানে লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা হয়েছে। সেখানে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসাধীন ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। টানা ১৭ দিন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি ২৫ জানুয়ারি থেকে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ছিলেন।
৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘ দিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো রাজকীয় বহরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করে গত ৭ জানুয়ারি লন্ডনে যান। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার বিষয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং তার সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশ্বন্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিমান কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের প্রতি খালেদা জিয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কথাও জানান জাহিদ।
বিএনপি চেয়ারপারসনকে বিমান বন্দর থেকে গুলশানের বাসায় নিয়ে আসতে বাংলাদেশ সেনা বাহিনী, বিজেবি, পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গণমাধ্যমের সংবাদ কর্মীরা যে দায়িত্ব পালন করেছেন সেজন্য তাদের প্রতি দলের চেয়ারপারসন এবং দলের পক্ষ থেকে কতৃজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
অধ্যাপক জাহিদ বলেন, ম্যাডামের চিকিৎসাধীন সময়ে লন্ডনে উনার জ্যেষ্ঠপুত্র বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান ৭ জানুয়ারি উনাকে রিসিভ করা থেকে শুরু করে গত ৫ মে পর্যন্ত উনি লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এবং উনার বাসায় উনার পরিবারের সকল সদস্যদের তত্ত্বাবধায়নে বিশেষ করে উনার তিন নাতনির কথা বলতেই হয়- ব্যারিস্টার জায়মা রহমান, জাফিয়া রহমান, জাহিয়া রহমান তারা সব সময় তাদের দাদু অর্থাৎ আমাদের দেশনেত্রীর বেগম খালেদা জিয়াকে মানসিকভাবে প্রশান্তি আনার জন্য যে দায়িত্ব পালন করেছেন সেজন্য আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে তারেক রহমানসহ তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।
একই সঙ্গে ইউক বিএনপির এমএ মালেক, কয়ছর এম আহমেদসহ সকল প্রবাসী বিএনপির নেতা-কর্মী ছাড়াও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দলের প্রবাসী নেতা-কর্মীরা বিএনপি চেয়ারপারসেনের চিকিৎসার জন্য যে সহযোগিতা করেছেন এবং দেশবাসী সুস্থতার জন্য দোয়া করেছেন সেজন্য দেশনেত্রী সবার কাছে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। আল্লাহর কাছে আমরা শুকরিয়া জানাই তার রহমতে দেশনেত্রী অনেকটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে আসতে পেরেছেন।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, অধ্যাপক এফএম সিদ্দিক, অধ্যাপক নুর উদ্দিন আহমেদ, ডা. জাফর ইকবাল, ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন, বিএনপির আহমেদ আজম খান, আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্লাহ আমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, শাম্মী আখতার, নিলোফার চৌধুরী মনি, সাইফ আলী খান, আতিকুর রহমান রুমন, শায়রুল কবির খান, শামসুদ্দিন দিদার, জাহিদুল ইসলাম রনি, আবদুল মোনায়েম মুন্না, এসএম জিলানী, লন্ডন বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক, সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।