যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন খাত এক অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতেই একাধিক বিশ্লেষণ ও গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি, বাণিজ্যযুদ্ধ এবং সীমান্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক পর্যটকদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও অনাস্থা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যয় ৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের মতে, ২০২৫ সালে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা ৭৯ মিলিয়ন থেকে কমে প্রায় ৬৬ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে, যা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটন খাতের পুনরুদ্ধারে বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
কাউন্সিলের মতে, এই ক্ষতির মূল কারণ হলো ট্রাম্প প্রশাসনের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিমালা, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে এখন অনেক বিদেশির কাছে ‘অস্বাগত’ দেশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অভিবাসীদের ওপর নজরদারি, ভিসা পদ্ধতির জটিলতা, বিমানবন্দরে হয়রানি এবং জাতিগত প্রোফাইলিংয়ের ঘটনা পর্যটকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। অনেক দেশ এমনকি তাদের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ব্যাপারে সতর্কতাও জারি করেছে। শুধু তাই নয়, ট্রাম্প ঘোষিত নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশের নাগরিকদের প্রবেশে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে বিশ্বকাপ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ইভেন্টেও যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ ও আয়োজনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
পর্যটন খাতের এই বিপর্যয় কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী ভাবমূর্তিতেও। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস ও মিয়ামির মতো পর্যটননির্ভর শহরগুলোতে হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটনসেবা খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাকরির বাজারে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। কারণ হাজার হাজার মানুষ এই খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিশেষ করে কানাডা ও ইউরোপ থেকে আগত পর্যটকের সংখ্যা কমে যাওয়ায় সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকাগুলোতে ব্যবসায়িক ক্ষতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
পর্যটন খাতের নেতারা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হয়, তবে জরুরিভিত্তিতে নীতিগত পরিবর্তন আনতে হবে। বিশ্ববাসীর কাছে ‘স্বাগত’ বার্তা পৌঁছে দিতে হবে এবং অভিবাসন নীতিমালায় মানবিক সংস্কার করতে হবে। ডিজিটাল ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, বিমানবন্দরে নিরাপত্তাসংক্রান্ত হয়রানি কমানো এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য একাধিক ভিসা সুবিধা চালু করাও হতে পারে এই সংকট কাটানোর কার্যকর উপায়। পর্যটন খাত শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কানাডার সঙ্গে টানাপড়েনের কারণে মিয়ামি, লাস ভেগাস ও নিউইয়র্কে ব্যবসায়ী এবং ছোট হোটেল ও রেস্তোরাঁর আয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
এই হুমকিতে ভূমিকম্পের মতো প্রভাব ফেলেছে ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা কঠোরতা, সীমান্ত স্থলায়ন এবং অভিবাসন নীতি। যেসব পর্যটক সীমান্তে আটকা পড়ছেন, ভিসা প্রসেসিং বিলম্বিত হচ্ছে এবং জার্মানি, কানাডা, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশে নিরাপত্তা সতর্কতা জারি হচ্ছে। ফোর্ট লামানুর মতো বড় শহরের পর্যটন ভবিষ্যৎ খর্ব হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে সতর্কতা দেওয়া হয়েছে। আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের কথা রয়েছে। এই ইভেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন খাতের জন্য একটি বিরাট সুযোগ হলেও বর্তমানে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা ও কড়াকড়ির পরিবেশে আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের আগ্রহ হ্রাস পেতে পারে। তাই এখনই সময় নীতি সংস্কারের, না হলে ১২ বিলিয়ন ডলারের এই লোকসান আগামী বছরগুলোতে আরো বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কড়া অভিবাসন ও বাণিজ্য নীতিমালা আমেরিকাকে পর্যটনের দিক থেকে এক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পিছিয়ে দিচ্ছে। আমেরিকার আতিথেয়তা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ব্যবসায়িক সম্ভাবনা সবই ম্লান হয়ে যাচ্ছে কেবল এককেন্দ্রিক ও সংবেদনশীল সিদ্ধান্তের কারণে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, পর্যটকদের আকর্ষণ করতে চাইলে দরজা খুলে রাখতে হবে, দেওয়াল তুললে চলবে না।
এই সংকট কাটাতে ওয়ার্ল্ড ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল ও ট্র্যাভেল ইকোনমিকসের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহ এখন প্রশাসনের কাছে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ প্রসার, ভিসা নিয়ম শিথিল এবং নিরাপত্তার অনুভূতি পুনর্বহালের আহ্বান জানাচ্ছে। অবশ্য ২০২৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপের মতো বড় ইভেন্ট আসন্ন, এতে সময়মতো পরিবর্তন না আনলে ১২ বিলিয়ন ডলারের বিশাল লোকসান বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এ মুহূর্তে সংকট কাটাতে হলে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বাগত’ স্লোগান বাস্তবায়ন, ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং সীমান্ত ব্যবহারকারীদের প্রতি সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব প্রদর্শন। না হলে শুধু ১২ বিলিয়ন ডলারের লোকসানই নয়, বরং ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সুনাম ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও বিপন্ন হতে পারে।