১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০১:৪৫:০৯ পূর্বাহ্ন


লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসন বিক্ষোভ দমনে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন অবৈধ : ফেডারেল কোর্টের রায়
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৯-২০২৫
লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসন বিক্ষোভ দমনে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন অবৈধ : ফেডারেল কোর্টের রায় ক্যালিফোর্নিয়া ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা ১০ জুন, ২০২৫-এ লস অ্যাঞ্জেলেস ফেডারেল ভবনের সামনে অবস্থান করছেন।


যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে অভিবাসন বিরোধী বিক্ষোভ দমনে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে ফেডারেল আইন ভঙ্গ করেছে বলে কঠোর মন্তব্য করেছেন সান ফ্রান্সিসকো ইউ এস ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক চার্লস ব্রেয়ার। গত ২ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার ঘোষিত রায়ে তিনি জানান, ট্রাম্প প্রশাসন সেনাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যবহার করে রাষ্ট্রপতি নিয়ন্ত্রিত জাতীয় পুলিশ বাহিনী তৈরির ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। গত জুনের শুরুর দিকে অভিবাসনবিরোধী অভিযান ঘিরে লস অ্যাঞ্জেলেসে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে শহরের প্রধান ফ্রিওয়ে বন্ধ হয়ে যায়, আত্মচালিত গাড়িতে আগুন ধরানো হয়, এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট ও ফ্ল্যাশব্যাং ব্যবহৃত হয়। এই পরিস্থিতির মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্যালিফোর্নিয়া ন্যাশনাল গার্ডকে ফেডারেল কর্তৃত্বে নিয়ে আসেন এবং প্রায় চার হাজার ন্যাশনাল গার্ড সদস্য ও সাতশ মেরিন লস অ্যাঞ্জেলেসে পাঠান। জুলাই শেষে অধিকাংশ সেনা প্রত্যাহার করা হলেও প্রায় তিনশ সদস্য থেকে যায়।

বিচারক ব্রেয়ার রায়ে বলেন, সেনাদের ব্যবহার ছিল আইনবিরোধী এবং এটি প্রশাসনের ইচ্ছাকৃত অবাধ্যতার উদাহরণ। সেনাদের প্রশিক্ষণ সামগ্রীতে স্পষ্টভাবে বলা ছিল যে তারা ভিড় নিয়ন্ত্রণ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, নিরাপত্তা টহল, জিজ্ঞাসাবাদ বা প্রমাণ সংগ্রহে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে সেনাদের এসব কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের সশস্ত্র অবস্থায় বর্ম পরে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যারিকেড বসানো, ভিড় নিয়ন্ত্রণ এবং এমনকি অভিবাসন অভিযানে অংশ নিতে দেখা গেছে। আদালতের ভাষায়, প্রমাণিত হয়েছে যে আসামিপক্ষ জানত সেনাদের আইন প্রয়োগে পাঠানো হচ্ছে, যা তাদের ক্ষমতার বাইরে। বিচারক নির্দেশ দেন, ১২ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া আদেশ অনুযায়ী ট্রাম্প প্রশাসন আর কোনো সেনাকে আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না।

ট্রাম্প প্রশাসনের আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি দেন যে পসে কমিটাটাস আইন প্রযোজ্য নয়, কারণ সেনারা আইন প্রয়োগে নয়, বরং ফেডারেল কর্মকর্তাদের সুরক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু আদালত বলেছে, সেনারা বাস্তবে অভিযানে অংশ নিয়েছেন, আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও প্রমাণ সংগ্রহে জড়িত ছিলেন। ফলে এটি সরাসরি আইন ভঙ্গ। ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাট গভর্নর গ্যাভিন নিউজম রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, কোনো প্রেসিডেন্টই রাজা নন-ট্রাম্পও নন। একজন প্রেসিডেন্ট কোনোভাবেই একটি স্টেটের নিজস্ব জনগণ রক্ষার ক্ষমতাকে পদদলিত করতে পারেন না। আদালত গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র আনা কেলি এক বিবৃতিতে আদালতের রায়কে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আবারও এক বিদ্রোহী বিচারক সেনাপ্রধানের সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব আমেরিকার শহরগুলোকে সহিংসতা থেকে রক্ষা করা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সচিব ক্রিস্টি নোএম জানিয়েছেন, প্রশাসন রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে এবং প্রয়োজনে অন্য শহরেও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করা হবে। নোএমের ভাষায়, লস অ্যাঞ্জেলেস ট্রাম্পের পদক্ষেপ ছাড়া টিকে থাকতে পারত না, শহরটি পুড়ে যেত যদি তা গভর্নর ও মেয়রের হাতে ছেড়ে দেওয়া হতো।

আদালতে মার্কিন আর্মির মেজর জেনারেল স্কট শেরম্যান স্বীকার করেন, তিনি মোতায়েন নিয়ে শুরু থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তার হাতে দেওয়া প্রশিক্ষণ সামগ্রীতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল যে ন্যাশনাল গার্ড সদস্যরা আইন প্রয়োগে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাকে জানান, এখানে সংবিধানগত ব্যতিক্রম প্রযোজ্য, কারণ সেনারা ফেডারেল সম্পত্তি ও কর্মকর্তাদের রক্ষায় ছিল। তবুও বাস্তবে তারা অভিবাসন অভিযানে অংশ নেয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের ম্যাকআর্থার পার্ক এলাকায় শক্তি প্রদর্শন করে এবং ভেন্টুরা কাউন্টির দুটি মারিজুয়ানা নার্সারিতে অভিযানে যুক্ত হয়।

বিচারক ব্রেয়ার রায়ে উল্লেখ করেছেন যে ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যেই ওকল্যান্ড, সান ফ্রান্সিসকো, শিকাগো, বাল্টিমোর এবং নিউইয়র্কে ন্যাশনাল গার্ড পাঠানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। শিকাগো নিয়ে পরিকল্পনা সবচেয়ে বেশি আলোচিত। তবে ইলিনয়ের গভর্নর জেবি প্রিট্জকার ও শিকাগোর মেয়র ব্র্যান্ডন জনসন জানিয়েছেন, শহরে অপরাধ কমেছে এবং বাহিনী পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তারা সতর্ক করেছেন, ট্রাম্প যদি ন্যাশনাল গার্ড পাঠান তবে তারা মামলা করবেন।

১৮৭৮ সালের পসে কমিটাটাস আইন অনুযায়ী মার্কিন সেনাবাহিনী ও এয়ারফোর্স অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগে অংশ নিতে পারে না। ন্যাশনাল গার্ড সাধারণত রাজ্য গভর্নরের অধীনে থাকে। তবে প্রেসিডেন্ট নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তাদের ফেডারেল নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন-যেমন দেশ আক্রমণের শিকার হলে, বিদ্রোহ হলে বা বিদ্রোহের ঝুঁকি দেখা দিলে, অথবা প্রেসিডেন্ট যদি মনে করেন আইন প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্ষেত্রে এমন কোনো পরিস্থিতি ছিল না। তাই আদালতের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ সরাসরি আইনবিরোধী।

রিপাবলিকান শিবিরে অনেকে আদালতের রায়কে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, ফেডারেল সরকার যদি শহরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ন্যাশনাল গার্ড পাঠাতে না পারে তবে অপরাধ ও বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা বলছেন, এটি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের আরেকটি উদাহরণ। তাদের মতে, এ ধরনের মোতায়েন আসলে ভিন্নমত দমন ও অভিবাসনবিরোধী নীতি শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালতের এই রায় আপাতত শুধু ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রযোজ্য হলেও এটি অন্য স্টেটেও গুরুত্বপূর্ণ নজির তৈরি করতে পারে। যদি ট্রাম্প প্রশাসন শিকাগো বা নিউইয়র্কে সেনা মোতায়েনের চেষ্টা করে, তবে ওই স্টেট গুলোও একই যুক্তিতে মামলা করতে পারে। এতে ফেডারেল ও স্টেটগুলোর মধ্যে সাংবিধানিক সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে। সামগ্রিকভাবে এই রায় যুক্তরাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের সীমা নিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে সেনাদের ব্যবহার করেছেন, তা মার্কিন ইতিহাসে নজিরবিহীন। আদালত পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে যে কোনো প্রেসিডেন্টই আইনের ঊর্ধ্বে নন। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসনের আপিল আদালতে কী ফল আসে এবং অন্য শহরগুলোতে সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা কতদূর এগোয়।

শেয়ার করুন