২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৭:১৯:৬ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে দরিদ্রমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে - আসাদুজ্জামান খান কামাল ৭০ শতাংশ মৃত্যু অসংক্রামক রোগে, বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি ‘বিদেশে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয় আইনে ব্যবস্থা নিন’ ভূল স্বীকার করে সরে দাড়ানোয় একজনের বহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার বাফেলোতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে দুই বাংলাদেশী নিহত ‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান


আইএমএফ’র লোন পাওয়াই টার্গেট
জ্বালানিতে পুড়ছে বাংলাদেশ
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৮-২০২২
জ্বালানিতে পুড়ছে বাংলাদেশ


করোনার অভিঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ। চাকরি-বাকরি ও ছোট-মাঝারি ব্যবসীরা তাদের অনেকের ব্যবসা হারিয়ে পথে বসার উপক্রম। বসেও গেছেন অনেকে। করোনা চলে যাওয়ার পর থেকে বেঁচে থাকার নতুন লড়াইয়ে মানুষ যখন কোনো না কোনো অবলম্বন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল- ঠিক তখনই আবার ইউক্রেন-রাশিয়ার নন স্টপ যুদ্ধ। গোটা বিশ্বকেই যেন তোলপাড় করে দিয়েছে যুদ্ধ। বিশ্বকে দ্বিখন্ডিত করা ওই যুদ্ধ এখনও চলছে অনাবরত। এতে বাংলাদেশ সরকার নিরূপায় হয়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। তবে একই সঙ্গে রেকর্ড প্রায় ৫০% শতাংশ জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ রীতিমত দিশেহারা। এর রেশ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা সর্বসাধারণের বুঝতে আর বাকি নেই। যেদিকে চোখ যায়- দেখছে শুধু অন্ধকার।

হু হু করে বাড়ছে সবকিছুর দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বলতে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে চাল,ডাল,সব্জি, জীবন রক্ষাকারী ঔষধসহ সবকিছুর দাম চলে যাচ্ছে নাগালের বাইরে। রাস্তায় পরিবহন ভাড়া ও খরচ সর্বত্রই বেড়েছে ৫০% এর মত। কী বাড়েনি। এক কথায় সবকিছুরই দাম ক্রমশ বাড়ছে। এর সঙ্গে শতভাগ বিদ্যুৎ পাওয়া মানুষের প্রচন্ড লোডশেডিং জীবনযাত্রা দুরুহ করে তুলেছে। সব মিলিয়ে মানুষ বড় অসহায় হয়ে গেছে। বলার জায়গা নেই। বলে লাভ নেই। মানুষ চুপ করে বসে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া নেই কোনো গত্যান্তর । 

যুদ্ধ শুরু দীর্ঘদিন। এ কাজটা ধীরে ধীরে করলে এতটা আলোচনা হতো না। কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি- এর ভয়ার্ত ছোবলটা ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করেছে মানুষ। এখনও এর রেশ মানুষ পুরাপুরি পায়নি। এক কৃষকের বক্তব্যটা বিশ্লেষণ করলে বুঝা যাবে কোন পর্যায়েও এর ছোয়া লাগবে। এবং এর রেশ কোথায় গিয়ে ঠেকবে। তিনি বলেছেন, সেচের মূল্যবৃদ্ধি অন্তত ৫০%। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যেখানে ১০০০ টাকার সেচমূল্য দিতে হতো- সেটা এখন ১৫০০ টাকা দিতে হবে। মুহূর্তে পাঁচশ টাকা এ এক সেচে। ফলে আমাদের ক্ষতি পোষাতে ফসলের দাম বৃদ্ধি করে এর দায় শোধ করতে হবে। এটা তো গেল প্রান্তিক এক কৃষকের কথা। কিন্তু ওই ফসল বা ধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে কটাস্তর পার হবে? যদি ধান হয়, তাকে বিদ্যুৎ বা ডিজেল পোড়ানো মেশিন দ্বারা চাল করতে হবে। এরপর ট্রাকে করে পৌঁছুবে ভোক্তা পর্যায়। তাহলে প্রতিটা স্তরেই যখন জ্বালানির উপর নির্ভর। তখন প্রান্তিক চাষী থেকে ভোক্তাপর্যায় কতটা খরচ বাড়বে সেটা একটু চোখ বুজে হিসেব কষলেই মিলে যাবে অংক। এমনটা শাকশব্জি,মাংস,ডিম থেকে শুরু করে সবকিছুই। এর সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আটাসহ অন্যান্য পণ্যের দাম তো আরেক দফা বেড়েই আছে করোনার কষাঘাতে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির পরও। অর্থাৎ সর্বশেষ জ্বালানিমূল্য বৃদ্ধিতে দ্রব্যমূল্যে আগুন ধীরে ধীরে লাগতে শুরু করবে। এবং সেটা চলবে অনাবরত।  

এভাবে প্রতিটা সেক্টরের অবস্থা। পরিবহন অর্থাৎ বাস,লঞ্চ, মালবাহী কার্গো, ট্রাক, সহ সকল পরিবহন-  জ্বালানি গ্যাস,তৈল,জরুরী ঔষধ, দ্রব্যমূল্য। সর্বত্রই তো এর ছোঁয়া। প্রতিটা স্থানেই সাধারণ মানুষকে দিতে হবে বাড়তি অন্তত ৫০% খরচ। যেখানে তার প্রতিমাসে পাঁচ হাজার টাকায় সংসার চলতো। সেটা এখন সাড়ে সাত হাজারে যাবে নিদেন পক্ষে। আনুষঙ্গিক অন্যান্য খরচ তো আছেই। কিন্তু এর আগেও তো সেই করোনার প্রভাবে দ্রব্যমূল্যে আকাশ ছুয়েছিল। বহু মানুষ চাকরি,ব্যাবসা হারা হয়েছিলেন। সে রেশ বিদ্যমান বাজারে। এরপর আবার আরেক দফা ডিজেলের দাম বৃদ্ধি হয়ে দাম বেড়েছিল। এবার সেই মরার উপর আবারও অ্যাটাক। কী হবে মানুষের। আয় ইনকাম কী সে করোনার পর থেকে বেড়েছে? মোটেও না। বরং অনেক কমেছে। ফলে একদিকে কমছে ইনকাম। অন্যদিকে বাড়ছে সবকিছুর দাম। মানুষ রীতিমত দিশেহারা। সাধারণ মানুষ বলবে কাকে? বলে কী লাভ। তাইতো বলেন না। শুধু চোখ বুঝে সহ্য করছে। আর নীরবে মোছেন চোখের পানি। আকাশের পানে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস। কতকাল এভাবে চলবে। 

সর্বশেষ, যে জালানিমূল্যবৃদ্ধি সেটা কোনোরকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই। ছিটেফোটা ইঙ্গিতও দেয়া হয়নি। সরকার ৫ আগস্ট মধ্যরাত থেকে দেশে সকল প্রকার জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছোয়া বৃদ্ধি করেছে। দাম বেড়েছে প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬, পেট্রোলে ৪৪ টাকা। দাম বাড়ার পর প্রতি লিটার ডিজেল ১১৪ টাকায়, কেরোসিন ১১৪ টাকায়, অকটেন ১৩৫ টাকায় ও প্রতি লিটার পেট্রোল ১৩০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। কতটা বেশি টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে সেটার হিসেবটা মিলিয়ে নেয়া দুরুহ কোনো ব্যাপার নয়।আগে ভোক্তা পর্যায়ে খুচরা মূল্য ছিল প্রতি লিটার ডিজেল ৮০ টাকা, কেরোসিন ৮০ টাকা, অকটেন ৮৯ টাকা ও পেট্রোল ৮৬ টাকা। শুক্রবার রাত ১২টার পরই ওই দাম কার্যকর বলে ঘোষনা দেয় সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। 

এমন মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যা  

এর কারণ হিসেবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশ প্রেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি করা ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রোলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মূল্যবৃদ্ধির অধিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয় ছাড়াও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের লোকসান কমানো ও পাচার ঠেকাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সীমান্ত দিয়ে পাচারটাও একটা বড় ইস্যু। কিন্তু বিশেষাজ্ঞরা বলছেন, করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ এক সপ্তাহ আগে শুরু হয়নি। দীর্ঘদিন হলো। তাহলে এ মূল্যবৃদ্ধিটা কী ধীরে ধীরে অর্থাৎ সহনীয় পর্যায়ে রেখে করা যেত না? এক সঙ্গে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি কোন যুক্তিতে? 

ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব পড়ছে বাস, ট্রাক, ভ্যান কাভার ভ্যানের ভাড়ায়। এতে লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে। এতে করে গ্রামগঞ্জে যেসব ছোট যানবাহন যেমনটা লেগুনা,ইজিবাইক সবকিছুরই এ সুযোগে দাম বাড়বে এটাই হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে সিটি সার্ভিস থেকে শুরু করে কম দূরত্বের বাস ও সংশ্লিষ্ট যানবহনের ভাড়া ১০ টাকার টা ১৫ টাকা বৃদ্ধি করে ফেলেছে। এছাড়াও দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চসমূহে কমবেশি ৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়ে পরিবহন চলাচল শুরু করেছে। এর মধ্যে কিছু কিছু সংশ্লিস্ট বিভাগ থেকে নির্ধারণ করছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুসারে নিজেরাই বাড়িয়ে নিয়েছে পরিবহন মালিক শ্রমিকগণ।  

হঠাৎ জ্বালানি বিশাল মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে  

২০২৩ সনের শেষ বা ২০২৪ এর সূচনায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। অনেকেই আবার এর আগেও ওই নির্বাচনটা হয়ে যাবার হিসেব দেখেন। সে অনেক কথা। এমনি মুহূর্তে ক্ষমতাসীন জনপ্রিয় রাজনীতি দল আওয়ামী লীগ সরকার এভাবে এত বিশাল পরিমাণ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি করে সাধারণ মানুষের বিরাগভাজন হতে যাবেন কেন? আগামী নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোট না পেলে পরের বারে তো ক্ষমতা নেই এটা আওয়ামী লীগ সরকার কেন সবারই জানা। তাহলে জেনে শুনে তারা কী নিষ্ঠুর হবেন? তাহলে এত বিশাল পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধি হঠাৎ কেন? 

বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন দাম বাড়ানোর জন্য সরকার ইউক্রেন-রাশিয়ার বিরাজমান ননষ্টপ যুদ্ধে বিশ্ব বাজারে তেলের অস্বাভাবিক মূল্য, পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি’র লোকসান কমানো এবং পাচার হওয়ার আশঙ্কার কথা জানালেও বিশ্লেষকরা বলছেন প্রকৃত অর্থে ঋণ দাতা গোষ্ঠীগুলোর সাথে বৈঠকের আগে সংস্কারে সদিচ্ছা প্রকাশের অংশ হিসেবেই এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। ইতিমধ্যে এ জন্য আবেদনও করেছে। কিন্তু এ সংস্থা থেকে ঋণের প্রধানতম শর্তই হলো জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া। 

আইএমএফের সঙ্গে কাজ করে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একাধিক বিষেশাজ্ঞ অভিমত রাখেন, তাদের ধারণা- সরকার যে ঋণ চেয়েছে সংস্থাটির কাছ থেকে তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগেই তেলের দাম বাড়িয়ে,ভতুর্কি তুলে নিয়ে তাদের শর্ত পূরণ করে নিলো। কারণ এ মুহূর্তে রিজার্ভ বাড়াতে আইএমএফের লোন ছাড়া যে কোনো উপায়ই নেই। সেটার জন্য মানুষকে কষ্ট দিতে হলেও এ ছাড়া কোনো উপায় যে নেই। 

জানা গেছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা যে ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বড় অংশই জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য। সর্বশেষ আইএমএফ'র যে প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসেছিলো এবং সে সময়ই সরকারকে সম্ভব্য আইএমএফ থেকে লোন পেতে ওই ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ ছিল। সরকার সেটাই এখন করে রেখেছে। তার অর্থ দাঁড়ালো আইএমএফের লোনটা সরকার দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রত্যাশা করছে।

 

শেয়ার করুন