০৩ মে ২০১২, শুক্রবার, ০৮:২০:১৭ পূর্বাহ্ন


বিএনপির কর্মসূচি ঠেকাতে প্রশাসনেই ভরসা আ.লীগের
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-১১-২০২২
বিএনপির কর্মসূচি ঠেকাতে প্রশাসনেই ভরসা আ.লীগের


বিএনপি’র বিভাগীয় সমাবেশ রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে পারছে না দেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ।  এব্যাপারে সরকারের নিজ দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলি সাংগঠনিকভাবে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এসব নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে ক্ষোভ ও হতাশা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। 

বিএনপি’র পক্ষ থেকে গত ৮ অক্টোবর থেকে দেশের ১০ বিভাগীয় শহরে গণ-সমাবেশে কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিএনপি’র মতে, গণবিরোধী কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার কর্তৃক চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, চলমান আন্দোলনে ভোলার নুরে আলম ও আব্দুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন, মুন্সিগঞ্জে শহিদুল ইসলাম শাওন ও যশোরে আব্দুল আলিম মোট ৫ জন হত্যার প্রতিবাদে, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রতিবাদে ৮ অক্টোবর থেকে সারা দেশে বিভাগীয় গণ-সমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে ৮ অক্টোবরে প্রথম সমাবেশ হয় চট্টগ্রামে। ১৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহে।


২২ অক্টোবরে হয় খুলনায় হয়েছে। ২৯ হয় অক্টোবর রংপুরে।  ৫ নভেম্বর  হয় বরিশালে। ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে হয়ে গেছে। ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী। আর এধরণের কর্মসূচির শেষ হচ্ছে ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় গণ-সমাবেশের দিয়ে, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন কারণে আলোচনার ঝড় তুলছে। 

পাল্টা আয়োজন সরকারের

সরকারের অন্যতম দল আওয়ামী লীগ বিএনপির এধররনের সমাবেশের বিরুদ্ধে পাল্টা আয়োজনে সারাদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বেশ কয়েকটি সমাবেশসহ খোদ রাজধানীতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে জনস্রোতকে কোনোভাবেই সরকারি দল এখন আর হালকাভাবে নিচ্ছে না। আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপি সারাদেশে এসব সমাবেশ করছে মরিয়া হয়ে বা টিকে থাকার সংগ্রামের অংশ হিসাবে। এজন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে মারাত্মক চাপে ফেলেছে বিএনপি’র এসব কর্মসূচি। আবার এসব সমাবেশ কর্মসূচি শেষ কর্মসূচি হচ্ছে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায়। যাকে বিএনপি বিএনপির মহাসমাবেশ বলে অভিহিত করেছে। তাই এসব কর্মসূচি থেকে বিএনপি’কে যেনো ফায়দা নিতে না পারে সেজন্য ব্যাপক পরিকল্পনা করেই যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। কোথাও সমাবেশের বেশ কয়েকটি দিন আগে সভা সমাবেশ করছে। নিজ দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দেখিয়ে লোক সমাগম করছে। কিন্তু এসব  রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তেমন জনসম্পৃক্ত না থাকারই অভিযোগ বেশি। এমন কর্মসূচিকে আওয়ামী লীগ তেমন ফলও পাচ্ছে না বলে দলের মধ্যে ক্ষোভ উঠেছে। অভিযোগ উছেছে বিএনপি’কে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে পড়ছে সরকারের নিজ দল ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের । কারণ নিজ দলের নেতাকর্মীদের এসময় হাতের কাছে পাচ্ছে না বা সহযোগিতা মিলছে না, নানাবিধ কারণে। 

উদ্বেগ বাড়ছে নাগরিক সমাজের

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের দুই-তিনদিন আগে পরিবহন ধর্মঘট ডাকাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ডে সরকারের বিরুদ্ধে জনরোশ বাড়ছে। এর পাশাপাশি সরকারের এধরনের কর্মকান্ডে তাদের গুড ইমেজে আঘাত আসছে। এভাবে সমাবেশকে আটকে দেয়ার চেষ্টায় সরকার সমালোচিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে। শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশের অধিকার লঙ্ঘন ও জনদুর্ভোগ সৃষ্টি বন্ধ হোক এমনটা দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এতে বলা হয় শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করা ও সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার বাংলাদেশ সংবিধান (অনুচ্ছেদ ৩৭) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলে স্বীকৃত। আসকের পক্ষ থেকে বলা হয় শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ বা সভা-সমাবেশ আয়োজন ও তাতে যোগদান করে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করা নাগরিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের চর্চা, মানবাধিকার এবং জবাবদিহিতার নিশ্চিতের ক্ষেত্র তৈরি করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে এ অধিকার চর্চার ক্ষেত্র ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এ অধিকার চর্চা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল কিংবা সাধারণ নাগরিক-সবাইকে নানামুখী প্রতিকূলতার শিকার হতে হচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসন, সরকার দলীয় কর্মী কিংবা সমর্থকদের বিরুদ্ধে এ অধিকার লঙ্ঘন, আক্রমণ, সহিংসতা উদ্রেক ঘটানো এবং নানাভাবে হয়রানি-গ্রেপ্তার করার অভিযোগ তীব্রতর হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও  প্রতিবাদ প্রকাশ করছে।

ক্ষোভ বাড়ছে জনমনে

এমনকি বিএনপি’র সমাবেশ মোকাবেলায় সরকারি দলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বলেও গণমাধ্যমে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। গত শুক্রবার যুবলীগের রাজধানীর সমাবেশ নিয়ে নানান কার্যকলাপ নিয়ে সরকার সমালোচিত হয়েছে। জানা গেছে, যুবলীগের কর্মসূচি ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি খোদ সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যেও ক্ষোভ দেখা দেয়। দেখা গেছে শুক্রবারে যুবলীগের এমন সমাবেশে নেতাকর্মীদের দখলে চলে যায় ঢাবির বিভিন্ন হল। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম ভোগান্তি দেখা দেয়। যুবলীগের মহাসমাবেশে যোগ দিতে দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে আসা নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলের পাশেই অবস্থিত ঢাবির হলগুলোতে অবস্থান নেন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সেখানকার শিক্ষার্থীরা। ঔদিন দুপুরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও খুব সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলের দিকে আসতে থাকেন। এরপর তাঁরা পার্শ্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়েন। খাবার খাওয়ার পর প্যাকেটগুলো তাঁরা ডাস্টবিনে না ফেলে যত্রতত্র ফেলে রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বর, সবুজ চত্বর, ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনেসহ পুরো ক্যাম্পাস ময়লার ভাগাড়ে পরিণত করেছেন তারা। এমনকি সমাবেশে যোগ দিতে সকাল থেকেই দূর-দূরান্ত থেকে নেতাকর্মীরা গোসল ও খাওয়া দাওয়া, বিশ্রাম, শৌচাগার সারতে ঢাবির হলগুলোকে ব্যাবহার করে। এসব কর্মকান্ডের এক পর্যায়ে ঢাবি ঘটে যায় অন্যরকম ঘটনা। সূর্য সেন হলে সকালের দিকে হলে যুবলীগ নেতাকর্মীরা প্রবেশ করতে পারলেও দুপুরে মারামারির ঘটনার পর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। তারা সেখানে অবস্থানরত যুবলীগ কর্মীদের বের করে দেয়। হলের প্রধান ফটক আটকে দেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। তবে এদিন সারাদেশ থেকে আসা বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও পিকআপ ঢাবি এলাকায় রাখা হয়। আবার যারা ঢাবি হলে আসতে পারেনি তারা রাজধানীর বিভিন্ন নামি দাবি হোটেলে আগের রাতে বুকিং দিয়ে সেখানে রাজার হালে সমাবেশে যোগ দেন। জানা গেছে বিএনপি’র বিভাগীয় সম্মেলনের বিপরীতে দলের এমন শাহী কর্মকান্ডে বিরক্ত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। 

তাছাড়া গণমাধ্যমেই খবর বের হয়েছে যে, যেকোনো কমর্সূচিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গণপরিবহন বন্ধ থাকলে কমর্সূচি আহ্বানকারী রাজনৈতিক দল যতটা না ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তার চেয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হয় বেশি। আর এতে করে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন কিছুটা হলেও কমে। সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ধরে রাখতে ও জনদুর্ভোগ এড়াতে সমাবেশের আগে গণপরিবহন চালু রাখা যেতে পারে। শনিবার ফরিদপুরে বিএনপির গণসমাবেশ সামনে রেখে পুলিশের একটি শাখার তৈরি করা প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে বলে একটি গণমাধ্যমের খবরে উঠে আসে। 

যুবলীগের সমাবেশ নিয়ে ক্ষোভ আওয়ামী লীগে

বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে ম্লান করে দিতে নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষমতা জনগণের কাছে তুলে ধরতে আওয়ামী লীগের একটি বড়ো কর্মসূচি ছিল গত শুক্রবার যুবলীগের কর্মসূচি। আওয়ামী এমন সমাবেশকে একটি বড় রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসাবে দেশবাসির কাছে জানান দিতে চেয়েছিল। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাবেশে যে ধরনের লোক সমাগম হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি বলে দলের হাই কমান্ড অনেক মন:ক্ষুণ্ণ। তারা এমন সময়ে এধরনের সমাবেশকে মেনে নিতে পারেনি। খোদ সরকারের পক্ষ থেকে কেউ কেউ বলেছেন, ক্ষমতায় থেকে এমন আয়োজন জনগণের কাছে ভালো ঠেকেনি, হয়নি কাঙ্ক্ষিত জনসমাবেশ।  

সমাবেশ ঠেকাতে প্রশাসনে ভরসা আওয়ামী লীগে

বিএনপি’র এসব বিভাগীয় সমাবেশ ঠেকাকে আওয়ামী লীগ মূলত এখন দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক পদক্ষেপের চেয়ে প্রশাসনেই বেশি আস্থাশীল। দেখা গেছে পরিবহন ধর্মঘট, মামলা মোকাদ্দমা  সমাবেশের আগে বাড়ি বাড়ি পুলিশের তল্লাশিতেই সরকারের পক্ষে বেশি সহায়ক হচ্ছে বলে তারা মনে করেন, যদিও আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দলের জন্য মানান সই না। 

শেষ কথা

রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা হবে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। কেননা এমনিতেই এখন সরকারের ওপর নানান ধরনের খড়ক ঝুলছে আন্তর্জাতিকভাবে। কিন্তু সরকার বিএনপি’র সমাবেশে জনসমাবেশ ঠেকাতে প্রশাসনিকভাবেই মোকাবেলাকেই অন্যতম সেরা পদক্ষেপ বা একমাত্র হাতিয়ার বলে তারা মনে করছে।  কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের মাথার ওপর এধারনা আছে যে, গত বছরেরর ডিসেম্বর মাসে ’গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরএমন পদক্ষেপ সরকারের জন্য অনেক বিব্রতকর। যার থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকার এখনো কুলকিনারা পায়নি বা পাচ্ছে না। এরমধ্যে সরকার যদি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ ঠৈকাতে এমন সব পদক্ষেপ নেন তাহলে দেশ মারাত্মক ঝুকির মুখে পড়বে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন। অন্যদিকে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর থেকে বিএনপি বেশ চাঙ্গা। এরপর থেকেই সরকারও বেশ নমনীয় বিএনপি’র বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপারে। অন্যদিকে মার্কিনীদের এমন পদক্ষেপের কারণে বিএনপিও মাঠে বেশ তৎপর রয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচির নামে। বিএনপি সাহসী হয়ে উঠেছে এই ভেবে যে সরকার যতোই বলুক না কেনো তারা এখন আর সহজেই আগের মতো আইন শৃংখলায় নিয়োজিত বাহিনী সভা সমাবেশে প্রতিবন্ধকতায় কঠোর হতে পারবে না। তাই তারা একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছে। কিন্তু এমন কর্মসূচি রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় সরকার ব্যর্থ হয়ে কোনো ধরনের কঠোরতা দেখালে সরকার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো কোনঠাসা হয়ে পড়বে।  যা তাদের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনবে বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।

শেয়ার করুন