০১ মে ২০১২, বুধবার, ১০:৪৬:১২ অপরাহ্ন


বন্ধুদের টানেই বিদেশ থেকে ছুটে আসা ঢাকা কলেজ' ৮৫ মিলনমেলায়
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৩-২০২৩
বন্ধুদের টানেই বিদেশ থেকে ছুটে আসা ঢাকা কলেজ' ৮৫ মিলনমেলায়


খালেদ শামিম। কানাডায় স্থায়ীভাবে তার বসবাস। পেশায় সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ। সেখানকার ক্যানন সিকিউরিটি এন্ড পেট্রল সার্ভিসের মানবসম্পদ (এইচ আর) ও নিরাপত্ত্ াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ। আরেক জনের নাম খোন্দকার মোঃ মাহবুব রানা। ইংল্যান্ড স্থায়ী ভাবে থাকা। লন্ডন স্ট্যান্ডার্ট এয়ারপোর্টের কাস্টমার অপারেশন এ আছে। অন্যজন জন হলো মো: সাইদুর রহমান। সিংগাপুরে সিটি ব্যাংক এন.এ. সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এরা তিনজনই ঢাকা কলেজের ৮৫’র ব্যাচের প্রাক্তন ছাত্র । বন্ধুতের টানেই ৩৬ বছর পর গত তিন মার্চ এরা যোগ দিয়েছে ঢাকা কলেজ' ৮৫ মিলনমেলায়।  তাদের মতো আরো অনেকে এসেছেন এমন প্রানের মেলায়। 

এবারে এমন মিলনমেলার আয়োজন করা হয় সাভারের বিরুলিয়ায় একটি রিসোর্টে। এটা ছিল প্রায় ৩৬ বছর আগে ঢাকা কলেজে ১৯৮৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়া ছাত্রদের ফ্যামিরি ডে’র ব্যানারে মিলনমেলা। ঢাকা কলেজের ৮৫’র ব্যাচের ছাত্রদের এ আয়োজন ২০১৬ থেকে নিয়মিতই হচ্ছে। এমন মিলনমেলা পেছনের কারিগর হচ্ছে ব্যাচের ডাক্তার এনাম, প্রকৌশলী নাসিম, রাজনীতিবিদ বাহাদুর বেপারী, ডা: ইকবাল কবির ও প্রকৌশলী মঞ্জু। এদেরই নেতৃত্বে ব্যাচের এই ছাত্রদের এক ছাতার নিচে নিয়ে আনা হয়েছে ডিসি কেইভ-৮৫ এর ব্যানারে। এই নামেই ফেইসবুকে একটি একাউন্টও খুলেছে। আছে এই নামেই ভাইভার গ্রুপ। প্রতিদিনই ভাইভার গ্রুপে চলে অনলাইন আড্ডা। কেউ অফিসে বা নিজ বাসা থেকে বের হওয়ার আগে সেড়ে ফেলে হায় হেলো করে। কোনো বন্ধু কোথাও বেড়াতে গেছে..ব্যাস আর পায় কে মেরে দিলো গ্রুপে একটা সেলফি এই ভাইভার গ্রুপে....এমন সেলফি নিয়ে চলে নানান ধরণের কমেন্ট। সবই চলে একে অপরকে বন্ধুত্বের শ্রদ্ধা রেখেই। কারো সু-খবর বা দু:সংবাদ কিংবা চলতে চলতে দেখা মজার ঘটনা- সবই উঠে আসে ডিসি কেইভ-৮৫ এর ভাইভার গ্রুপে। এমনও দেখা গেছে, সারা রাতই অনেকে বন্ধুদের সাথে এই ভাইভার গ্রুপে হাসি তামাশায় ব্যস্ত। আর এজন্য এভাবে গ্রুপে সম্পৃক্ত হয়ে সুদুর লন্ডনে থেকেও বন্ধু রানাকে বলতে শোনা গেছে-’আমি এখন আর একাকিত্ব অনুভব করি না..সব সময় মনে হয় বন্ধুরা আমার সাথেই তো আছে।’ ঢাকা কলেজে ১৯৮৫ সালে ইন্টারমিডিয়েটে পড়া এমন বন্ধুদের মধ্যে এই গ্রুপে এপর্যন্ত প্রায় তিনশত-জনকে পাওয়া গেছে।  




এবারে ডিসি কেইভ-৮৫ মিলনমেলার টুকিটাকি..

নাস্তায় পরোটা খাওয়ার প্রতিযোগিতা..

সকালে মিলনমেলা স্পটে ছিল ওপেন বুফে’তে নাস্তার আয়োজন। গািড় করে নামার সাথে সাথে প্রত্যেকে রেজিস্ট্রেশনে সেরেই নাস্তার জন্য হুরোহুড়ি। নাস্তার টেবিলে বসেই ডিসি কেইভ-৮৫ ফারুক কঠোর ভাষায় নির্দেশ, দুইটার বেশি পরোটা নিবি না কইলাম...কিন্তু কে শুনে কার কথা?  গরম গরম পরোটার সাথে বুটের ডাল-মাংশের স্বাধ কি দুই পরোটায় মেটানো যায় ? আর সাথে আছে খাটি ঘি’য়ের হালুয়া আর ভাজি? আর তাই এসব পেয়ে কেউ আর দুই পরোটায় সন্তুুষ্ট ছিল না,এমন আয়োজনে থাকার কথাও না..।  

ভাবিদের সন্মান করার প্রতিযোগিতা..

এসব মেধাবী বাঘ্র শাবকরা কে কিভাবে নিজের স্ত্রী-কে তাদের ভালোবাসা ফুলটি দিতে পারে এমন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় অনুষ্ঠানে। ডাক্তার ইকবাল কবির এবং অনেক অসুস্থ অবস্থাতেও একাধারে কবি সংগিত শিল্পী রিন্টু এমন প্রতিযোগিতাটি পরিচালনা দায়িত্ব পড়ে।  তাদের কে সহযোগিতা করে নাদুস নুদুস সর্বদা হাসি মুখে থাকা তুখোড় ব্যবস্থাপক অংশু। আর বিচারকের দায়িত্বে ছিল ডিসি কেইভ-৮৫ ব্যাচেরই অধ্যাপক ডা. বিধান চন্দ্র সরকার। বর্তমানে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান। যদিও এই বন্ধুটি নিজের স্ত্রীকে মিলনমেলায় নিয়ে আসেনি। বন্ধুদের মিলনমেলায় ডা. বিধান চন্দ্র সরকার তার স্ত্রীকে না আনতে পারার নানান অজুহাত তুলে ধরলেও মাননে চায়নি অনেকে। যাক বিচারকের দায়িত্ব নিয়েই দেখতে হয়েছে বিধানকে বন্ধুদের স্ত্রীরা কে কিভাবে একটি গোলাপ হাতে তুলে দিয়েছে। এমন প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেতে ডিসি কেইভের এই বাঘ্র শাবকরা কতোই না কাচুমাচু করেছে ভাবিদের হাতে একটি গোলাপটি তুলে দিতে- যা ছিল দেখার মতো। এনিয়ে বন্ধুদের মধ্যে হাসি তামাশার শেষ ছিল না। কেউ কেউ এমন মন্তব্য ছুড়ে দিয়ে বলেছে কি রে দোস্তো কলেজ জীবনে কতো জন-রে গোলাপ দিয়েছিলি যে এখন পারস না ? উল্লেখ্য ঢাকা কলেজের একটু দুরেই ইডেন কলেজের অবস্থান। 

গরম তা-তে কি,কামরুজ্জামান আছে না? 

মিলনমেলাটা কিছুটা গরমের দিনে পরে গেছে। তাই বেলা বাড়ার সাথে সাথে সব্বাই একটু হাফিয়ে উঠেছে। সবারই টি-শার্টের বোতাম খোলা। কিন্তু এমন গরম তাতে কি? দোস্তো কামরুজ্জামান আছে না। লাভেলো’র আইসক্রিমের অন্যতম একজন কর্নধার কামরুজ্জামানও ঢাকা কলেজ’র ৮৫ ব্যাচের। এর্পযন্ত বন্ধুদের ছোট-বড়ো যে কোনো ধরণের মিলনমেলায় লাভেলো’র আইসক্রিম আইসক্রিম পাওয়াই যাবে। এজন্য গরমে যারা উ...আহ করছিল তাদের কেউ কেউ বললো কামরুজ্জামান আছে না? হা আছেই তো। পুরো মিলনমেলায় যখন তখন হাত বাড়ালেই চলে এসেছে বন্ধুদের হাতের কাছে নানান আইটেমের লাভেলো আইস ক্রিম। কেননা কামরুজ্জামান যে লাভোলো আইসক্রিম ভর্তি বেশ কয়েকটা ভ্যানই বন্ধুদের জন্যই নিয়ে এসেছে মিলনমেলায়। 

এমন নাচন কেউ দেখেনি...

হালকা কনসার্ট আয়োজন করা হয় মিলন মেলায়। তো এমন আয়োজনে গানের সাথে সাথে ড্যান্স হাবে না? ঝাকা নাকা থাকবে না..এটাতো হতে পারে না। আর যেই না গান শুরু হয়েছে তো পায় কে। ইংল্যান্ড থেকে ছুটে আসা রানা শুরু করে নাচন। গানের তালে তালে তার হাত পা আসলে কি করছে তা না দেখলে বোঝার সাধ্য নেই এটা কি ড্যান্স না অন্য কিছু..আর এমন নাচন দেখে উপস্থিত ভাবীরা ও তাদের সন্তানরা মুখ টিপে হেসেছে। আর বন্ধুরা বললো- জীবেন এমন নাচন দেখি নাইরে দোস্তো। 

আয়োজকরাই যখন খাদক..

অনুষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ কমিটি করা হয়। এমন কমিটির একটি ছিল ডিসি কেইভ-৮৫’র বন্ধুদের এমন আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। যারা অপেক্ষাকৃত ত্যাগি তারা থাকবে এতে। কিন্তু কমিটির এমন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের কেউ কেউ সবার আগে দুপুরের খাওয়ার টেবিলে প্রথম বেচেই খাবার খেতে দেখা যায়। এমন পরিস্থিতি কিভাবে কি করা যায়? সবাইতো বন্ধু। তারপরেও সমাজসেবক ও অত্যন্ত দুষ্ঠু যাকে বলা হয় সেই টুটুল লাঠি নিয়ে শায়েস্তা করতে আসে তাদের। টুটুল বলে উঠে এতো দেখি রক্ষকরাই এখন ভক্ষক দেখি....কিন্তু কে শোনে কার কথা। আপন মনেই মহাদায়িত্ব পাওয়া বন্ধুরা কেয়েই চলেছে..

আরো অনেক আয়োজন..

মিলনমেলার মাঝে দুপুরের খাবারের আয়োজনে ছিল অন্যান্য আইটেমের সাথে গরুর মাংশ। ডিসি কেইভ-৮৫ এর বন্ধু ব্যবসায়ি রফিক। সে তার নিজস্ব খামারের একটি গরু বন্ধুদের আয়োজনে দিয়ে দেয়। শুধু কি রফিকই বন্ধুদের জন্য গরু দিয়েছে। দেশের ডিসি কেইভ-৮৫ আরেকজন বিশিষ্ট শিল্পপতি শাহিদ আলম এমন আয়োজনে অকাতরে সহযোগিতা করেছে বলে তাকে এই গ্রুপের অর্থমন্ত্রী বলে উপাধি দিয়েছে কেউ কেউ। খুবই চমৎকার আরামদায়ক, আনন্দদায়ক ও সফল একটা পিকনিকের পেছনে অবশ্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর মিঠুসহ ডা: খুরশীদ বাবু ও ডা: তৌফিকের অবদান ছিল। এরা বন্ধুদের কোনো কিছুতে যেনো কারো  কস্ট না হয় সে ব্যাপারে কঠোর নজড় রেখেছে। অবশ্য এমন আয়োজনে ৮৫’ ব্যাচের  জিয়াউদ্দিন ফারুক জিয়া,জুবায়ের, তৌহিদ, শামীম, ইউনুস, আরেক জাহাঙ্গীর, সগীর, মুন্নার আন্তরিকতাও দেখা মতো ছিল। এছাড়া শাফায়াতের ডেকো বিস্কুট পেয়ে বন্ধুদের সে কি উচ্ছ্বাস। আসলে শাফায়াত তো ভাইভার ডিসি কেইভের ভাইভার গ্রুপ যে জমিয়ে রাখে তা-ও সবার মুখে মুখে উঠে আসে।। 

র‌্যাফেল ড্র...

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে আবারো কনসার্টের সাথে সাথে ড্যান্স। পরন্ত বিকালে এমন কনসার্ট আর ড্যান্সের ফাকে ফাকে চলে র‌্যাফেল ড্র। এমন আয়োজনের পুরোটা পরিচালনা করে বন্ধু বৎসল যে কি-না বলা হয়ে থাকে ডিসি কেইভ-৮৫ অন্যতম প্রাণ। যার কারনেই এমন একটা মিলনমেলা সার্থকভাবে সম্পন্ন করা গেছে সেই ফারুক। ডিসি কেইভ-৮৫ এই বন্ধু হচ্ছে মোহাম্মদ ফখরুল আলম -ফারুক। বিশিষ্ট ব্যবসায়ি ও সমাজসেবক সে। বন্ধু বৎসল ফারুক কখনো নিজ চোখ বন্ধু করে , বারবার র‌্যাফেল ড্র-বাক্্রটা নাড়াচাড়া- বলা যায় কঠোর ভাবে সে একাই টিকিট তুলেছে। আর পুরস্কার প্রাপকের নাম ঘোষণা করেছে। নানান ধরণের পুরস্কারে ভরা র‌্যাফেল ড্র-তে নাম ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় ডিসি কেইভ-৮৫ বন্ধুদের অপেক্ষার দৃশ্যও ছিল মধুর। 

সব শেষে বিষাদের কন্ঠু..রিপন গুরুতর অসুস্থ..

সবই চলছিল ভালো। হাসি তামাশায় কেটে যাচ্ছিল মিলনমেলা..কিন্তু সব শেষে মিলনমেলার জন্য তৈরি করা স্টেজে উঠে ধীরে ধীরে নিউরো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার খুরশিদ মাহমুদ বাবু তুলে ধরে ডিসি কেইভ-৮৫ এক বন্ধু রিপনের গুরুতর অসুস্থতার কথা। তার জন্য প্রাণভরে দোওয়া চাইলো সে সবার কাছে। পুরো আয়োজনে নিরবতা নেমে এলো। ডাঃ কাজী সাজ্জাদ হোসেন (রিপন) একজন প্রখ্যাত দন্ত চিকিৎসক। বি.ডি.এস. (ঢাকা), পি.জি.টি. (নিগাতা ইউনিভার্সিটি),  পি.এইচ. ডি.(ওরাল এন্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারী) জাপান। রিসার্চের জন্য জাপানের ওসাকা থেকে এশিয়ান ট্রাভেল এওয়ার্ড পেয়েছে সে।  আমেরিকান জার্নাল অব মাইক্রোস্কোপিক রিসার্চে তার পাবলিকেশন আছে । সৌদী আরবের রিয়াদ থেকে নিয়ন্ত্রিত সৌদী কাউন্সিলএ  সম্পন্ন করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশে  ডাঃ কাজী সাজ্জাদ হোসেন (রিপন)এর জায়গা হয়নি, স্বীকৃতি মেলেনি। জানা গেছে, তার বাম পাশ্বের কিডনি ক্যানসারে আক্রান্ত ছিল। ২০১৯  সালের ১৭ ই ডিসেম্বর ফেলে দেওয়া হলো সেটি।  বর্তমানে বলা হচ্ছে এখন সেটা ছড়িয়ে পড়লো মাথা এবং ফুসফুসে।  এখন ক্যান্সার  সারভাইবার সে। মুম্বাই গেছে ভালো চিকিৎসা পেতে! কিন্তু এমন চিকিৎসারতো সাধ্য নেই তার। তাই বাবু বন্ধুদের আহবান জানালো দেশের এই মেধাবী সন্তান প্রিয় বন্ধুর পাশে দাড়াতে। ডাক্তার বাবুর এমন কথা শুনে অনুষ্ঠানে অবশ্য কেউ স্থির হয়ে বসে থাকেনি। জোড়ালো দৃপ্ত কন্ঠে  ঢাকা কলেজ' ৮৫ ব্যাচের বন্ধুরা বলে উঠলো.. রিপনের পাশে আছি আমরা...


শেয়ার করুন