২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৫:২৮:৬ অপরাহ্ন


উত্তাল মার্চ
সশস্ত্র যুদ্ধের দিকেই বাংলাদেশ
ফকির ইলিয়াস
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২৩
সশস্ত্র যুদ্ধের দিকেই বাংলাদেশ


ছাব্বিশে মার্চের পরেই ঘোরে সব রাজনৈতিক চাকা। ঢাকা তখন পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর নগরী! এতো পাকিস্তানি সৈন্য এর আগে কখনো দেখা যায়নি ঢাকায়। ন্যক্কারজনক গণহত্যা শুরু করে দিয়েছে তারা। রক্তের প্লাবনে ভাসছে বাংলাদেশ। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার খবর বিশ্ববাসী মূলত জানতে পারে একাত্তর সালের ২৭ মার্চ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব দিয়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।  

২৫ মার্চ রাতের গণহত্যায় ঢাকা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপ আর লাশের নগরীতে। ২৭ মার্চ সকালেও বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনে রমনা কালীমন্দিরে ২৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। ধারণা করা হয়, সেখানে শহিদদের বেশির ভাগই বাঙালি ইপিআর সদস্য। এদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করে সামরিক কর্তৃপক্ষ।

শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে লিখেছেন, ‘নিউমার্কেট কাঁচাবাজারের সামনে পৌঁছেই রুমী হঠাৎ ‘ও গড!’ বলে ব্রেক কষে ফেললো। সামনেই পুরো কাঁচাবাজার পুড়ে ছাই  হয়ে রয়েছে। এখনো কিছু কিছু ধোঁয়া উঠছে। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মানুষও পুড়েছে। ঐ সে পোড়া চালের ফাঁক দিয়ে রুমী জোরে গাড়ি চালিয়ে-, ‘আম্মা তাকায়ো না ওদিকে’ বলে ডান দিকে মিরপুর রোডে মোড় নিলো।’ ‘হাসপাতালের আউটডোরে গেটে ঢোকার আগে রুমী আরেকবার ‘ও গড!’ বলে ব্রেক কষে ফেললো। পাশেই শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো গোলার আঘাতে ভেঙে দুমড়ে মুখ থুবড়ে রয়েছে। আমার দু’চোখ পানিতে ভরে গেল। এ কি করেছে ওরা!’

অসংখ্য মানুষকে হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই বেঁধে নিয়ে রিকশায় বা পায়ে হেঁটে ঢাকা শহর ছেড়ে যেতে দেখা যায়।

এদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য দেন। এদিনই বাঙালিদের আশ্রয় দিতে সীমান্ত খুলে দেয় ভারত। আকাশবাণীতে সীমান্ত খুলে দেওয়ার খবর জানার পর জনস্রোত ধাবিত হয় সীমান্ত অভিমুখে।

ঢাকায় টানা ৩৪ ঘণ্টার হত্যাকাণ্ড শেষে করে এদিন পাকিস্তানের সেনারা ব্যারাকে ফেরে। পাকিস্তানের কোনো খবরে বাংলাদেশের ওপর এই বর্বরতার কথা প্রকাশ হয়নি। আর ঢাকায় কোনো পত্রিকাই প্রকাশিত হয়নি। ২৭ মার্চ বিবিসির খবরে বলা হয়, ‘কলকাতা থেকে প্রচারিত সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।’

ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, ‘ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের কাছে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।’

দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’

দ্য গার্ডিয়ানের ২৭ মার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘...২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তার এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’

এছাড়া ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর প্রচার করা হয় এদিন। আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেস হেরাল্ডের ২৭ মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘বেঙ্গলি ইনডিপেনডেন্স ডিক্লার্ড বাই মুজিব।’

নিউইয়র্ক টাইমসেও শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। শিরোনাম লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’

বার্তা সংস্থা এপি লেখে, ‘ইয়াহিয়া খান আবার সামরিক শাসন জারি করায় এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’

আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমসের শিরোনাম ছিল- ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা’, সঙ্গে ছিল শেখ মুজিবের ছবি।

ব্যাংকক পোস্টের খবরে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”

এদিন ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থানরত বিদেশি সাংবাদিকদের জোর করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করিয়ে নেওয়ার পর বাঙালি শ্রমিকদের হত্যা করা হয়।

২৮ মার্চ ঢাকায় সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। হাজার হাজার সন্ত্রস্ত মানুষ আগের দিনের মতোই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে শহর ছাড়তে শুরু করে। এর পাশাপাশি দেশের নানা স্থানে বাঙালিরা পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালায়। এই দিনেও শহরের রাস্তার পাশে পড়েছিল নিহতদের লাশ। রাতে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের জন্য আবারও বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়। পাকিস্তানি নৌবাহিনী চট্টগ্রামের নানা অঞ্চলে এই দিন প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। শুভপুর ব্রিজে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সারাদিন যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানিরা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। নৌবন্দর এলাকায় পাকিস্তানি নৌবাহিনী বাঙালি নৌসেনাদের নিরস্ত্র করে হত্যা করে।

পিটিআই জানায়, নিউইয়র্কে বাঙালিরা পাকিস্তানের কনস্যুলেট জেনারেলের অফিস দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তানের কনস্যুলেট ও জাতিসংঘের মিশন ছিল পাশাপাশি বাড়িতে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বাঙালিদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানে মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান গণহত্যার সাফাই গেয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি এবং সুস্পষ্টভাবে দেশদ্রোহী প্রস্তাব। ঢাকা সম্প্রতি যা ঘটেছে তা উন্মুক্ত বিদ্রোহ। সামরিক বাহিনীর পদক্ষেপ অত্যন্ত সঠিক, সময়োপযোগী ও ন্যায়সংগত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করা হয়েছিল ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে। বস্তুত তখন ২৬ মার্চের প্রথম প্রহর। ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় তাকে সেনানিবাস থেকে তেজগাঁও বিমানবন্দরে এনে রাতে সামরিক বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে করাচিতে নিয়ে যাওয়া হয়।

২৯ মার্চ তাদের বর্বরতা চরমের দিকে এগোতে থাকে।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাইরে এসে দিনভর মেডিকেল কলেজ এবং আশপাশের পাহাড়ে সমবেত হয়ে সন্ধ্যায় আক্রমণ শুরু করে। ইপিআর সেনাদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী সে আক্রমণ প্রতিহত করে। পাবনায় ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা একদল পাকিস্তান সেনাকে আক্রমণ করে। ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর আসলাম ও ক্যাপ্টেন ইশফাকসহ ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা তাতে নিহত হয়। জীবিতরা রাজশাহীর দিকে যাওয়ার পথে জনতার হাতে প্রাণ হারায়। লালমনিরহাটে বাঙালি-অবাঙালি ইপিআর সেনাদের মধ্যে যুদ্ধে লুৎফর রহমান শহিদ হন।

সুনামগঞ্জে ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। যুদ্ধে ইপিআর সেনা আবদুল হালিম পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে শহিদ হন। প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে আটক প্রায় ১০০ জন বাঙালি ইপিআর সদস্যকে তিন ভাগে রাতের বেলা রমনা কালীবাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা তাদের হত্যা করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ব্যাটালিয়ন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর কে এম সফিউল্লার নেতৃত্বে ২৮ মার্চ জয়দেবপুরে বিদ্রোহ করে ময়মনসিংহের উদ্দেশে রওনা দেয়। ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তা ও সৈনিকেরা টাউন হলে এক সমাবেশে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন। সকালে ময়মনসিংহের রাবেয়া মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে ইপিআর বাহিনী এবং হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।

রাতে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের বাঙালি ইপিআররা বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। বিদ্রোহে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় সাংসদ এম আবদুর রহিম মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের কথ্য ইতিহাস প্রকল্পে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, কুঠিবাড়িতে দিনাজপুরে ইপিআর সেক্টরের অবাঙালি কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল কোরেশি।

২৯ মার্চ আবদুর রহিম কয়েকজন বাঙালি ইপিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। যোগাযোগের পরে বিদ্রোহ করে। তারা গোলাগুলো শুরু করলে পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা পাল্টা হামলা চালায়। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা এর পর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে আসে। বিদ্রোহে তাদের নেতৃত্ব দেন ইপিআর বাহিনীর প্রবীণ বাঙালি সুবেদার মেজর এ রব। রাতের অন্ধকারে সেখানকার সার্কিট হাউজ থেকে পাকিস্তানি সেনারাও পালিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়।

৩০ মার্চ রাতে পাকিস্তান বিমানবাহিনী চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ওপর বোমা বর্ষণ করে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কর্মীরা নিরাপদ স্থানে চলে যান। সেখানে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও পিছু হটে যান। বোমা বর্ষণের আগে সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে আবারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকার ও জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আবেদন জানানো হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর কামান দিয়ে বোমা বর্ষণ করে। রাতে নগরীর আশপাশে ছত্রী সেনা নামায়। ভোর পর্যন্ত ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিরোধ করে। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে এই দিন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, তাঁতীবাজার ও শাঁখারীবাজার এলাকা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। সেনাবাহিনী দেশজুড়ে বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করছে।

৭ মার্চ বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে বের করে দিলেও কৌশলে থেকে গিয়েছিলেন। ডেইলি টেলিগ্রাফ এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং। তিনি ঢাকায় পাকিস্তানের সেনাদের হত্যাযজ্ঞের প্রমাণ দেখতে পান। ব্যাংককে গিয়েই তিনি তা নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী প্রথম বিশদভাবে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও বর্বরতা সম্পর্কে জানতে পারে। প্রতিবেদনটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল- ‘বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তানে ট্যাংক আক্রমণ : ৭ হাজার নিহত, ঘরবাড়ি ভস্মীভূত’। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা এখন ধ্বংস ও আতঙ্কের নগরী। ২৩ ঘণ্টা ধরে অবিরাম শেল বর্ষণ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় সাত হাজারের বেশি লোক হত্যা করেছে। সেনা অভিযানে ঢাকাসহ সব মিলিয়ে ১৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে।

সেনানিবাসে ফেরার পর ৩০ মার্চ তাদের প্রায় নিরস্ত্র করা হয়। তারা লক্ষ করেন, নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের ঘিরে রেখেছে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনারা। তাদের বুঝতে বাকি থাকে না, কী ঘটতে চলেছে। রেজাউল জলিল কোনো সিদ্ধান্ত দিতে ব্যর্থ হলে বাঙালি সেনারা হাফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে। তারা অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে গুলিবর্ষণ করতে করতে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে আসে। এই সময় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারসহ বহু বাঙালি সেনা শহিদ ও আহত হয়। আর প্রায় ২০০ জন বাঙালি সেনা বেরিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়।

৩০ মার্চ ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী তিন দিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনারা হতচকিত হয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক তুমুল যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পুলিশ লাইনস ও ওয়্যারলেস কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি সেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে জেলা স্কুলের দিকে তাদের সদর দপ্তরে পালিয়ে যায়। কিছু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। জেলা স্কুল এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ছাড়া গোটা শহর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

৩১ মার্চ ১৯৭১। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে চুয়াডাঙ্গা হয়ে ৩০ মার্চ সন্ধ্যার পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে পৌঁছান। সেখানে থেকে তারা স্থানীয় বিএসএফের মাধ্যমে ভারত সরকারের কাছে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তারা জানান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নেতা হিসেবে ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার করার জন্য ভারতে প্রবেশ করতে চান। ভারত সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানালে তারা ভারতে প্রবেশ করতে রাজি আছেন।

বার্তা পাঠানোর পর ঘণ্টা কয়েক পর স্থানীয় বিএসএফ কমান্ডার এসে তাদের বিএসএফের ছাউনিতে নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার। তিনি তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে যান কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরে।

গভীর রাতে তারা যখন কলকাতায় গিয়ে পৌঁছান, তখন ৩১ মার্চের প্রথম প্রহর। সেখানে বিএসএফের সর্বভারতীয় প্রধানকে এফ রুস্তমজীর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। তিনি তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

 ৩১ মার্চেই দিল্লিতে লোকসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার নিজের, ভারতের জনগণ ও সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভূখ-ের একেবারে সন্নিকটে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চালানো হচ্ছে, আমাদের জনগণ তার তীব্র নিন্দা না জানিয়ে পারে না।’ বিবৃতিতে ইন্দিরা গান্ধী অবিলম্বে পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবি জানান। এ জন্য পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জরুরি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সারা বিশ্বের জনগণ ও সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। ভারতের লোকসভা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি প্রকাশ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস করে। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ববঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনায় লোকসভা গভীরভাবে দুঃখিত ও উদ্বিগ্ন। ভারতের সীমানার এত কাছের ন্যক্কারজনক বিয়োগান্ত ঘটনায় লোকসভা উদাসীন থাকতে পারে না। নিরীহ ও নিরস্ত্র জনগণের ওপর যে নির্মম অত্যাচার চলছে, ভারতের জনগণ দ্বিধাহীন ভাষায় তার নিন্দা করছেন।

একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য পূর্ববঙ্গের জনগণের সূচিত সংগ্রামের প্রতি লোকসভার অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহানুভূতি রয়েছে। গণহত্যার শামিল এ সুপরিকল্পিত হত্যা অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য লোকসভা বিশ্ববাসী ও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের কাছে পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার আহ্বান জানায়। লোকসভা আশ্বাস দিয়ে বলে, বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ও ত্যাগ ভারতের জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সহৃদয় সহানুভূতি পাবে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশের অধিকাংশ সেনানিবাস ও ছাউনি ৩১ মার্চ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সরে যান। এই দিনটিতেও বহু জেলা ও মহকুমা শহর মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। বিপুলসংখ্যায় মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে।

৩০ মার্চ গভীর রাত থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে মুহুর্মুহু আক্রমণ করতে শুরু করে। তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের তীব্র আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে ৩১ মার্চ পশ্চিমবঙ্গজুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল হয়। কোনো ট্রেন চলেনি। বিমানও নয়। শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটিকে শোক দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।

কুষ্টিয়ায় আগের দিন শুরু হওয়া যুদ্ধ এই দিনও অব্যাহত ছিল। দিনভর যুদ্ধ শেষে জীবিত পাকিস্তানি সেনার সংখ্যা ছিল ৪০-৪৫। রাতের আঁধারে তারা দুটি জিপ ও একটি গাড়িতে করে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপার সেতুর গোড়ায় গর্ত খুঁড়ে পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। তাদের প্রথম দুটি জিপ সেই গর্তে পড়ে মেজর শোয়েবসহ কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। বাকিরা আশপাশের গ্রামে পালিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ জনতা শত্রুসেনাদের নিশ্চিহ্ন করে। তাদের হাতিয়ার মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়।

রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট আতাউল্লাহ শাহ জনতার হাতে ধরা পড়েন। তাকে ঝিনাইদহে পাঠানো হয়। পরদিন ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি যোদ্ধাদের প্রথম এই গুরুত্বপূর্ণ বীরত্বগাথা নিয়ে ড্যান কগিন ১৯ এপ্রিল সংখ্যা টাইম ম্যাগাজিন-এ প্রচ্ছদকাহিনি লেখেন।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রেস মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলে, ইসলামাবাদে দূতাবাসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পদস্থ কর্মকর্তার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ তারা জানতে পেরেছেন যে মার্কিন সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের বৈধ কার্যক্রমে অসংগতভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে।

এভাবেই গোটা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় করে একাত্তরের মার্চ মাস। বাঙালি জাতি যুদ্ধকেই নিয়তি করে এগোতে থাকে সামনে। কত দিন লাগতে পারে এই যুদ্ধে জিততে! কবে স্বাধীন হতে পারে বাংলাদেশ! এমন অনে অনিশ্চয়তা নিয়েই গ্রামে গ্রামে মানুষ সংঘবদ্ধ হতে থাকেন। ‘যার যা কিছু আছে’- তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে জাতি তখন ঐক্যবদ্ধ বঙ্গবন্ধুর ডাকে।

শেয়ার করুন