০২ মে ২০১২, বৃহস্পতিবার, ৬:৪০:১৭ অপরাহ্ন


নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি
আন্দোলন না সমঝোতায় বিএনপি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৪-২০২২
আন্দোলন না সমঝোতায় বিএনপি


আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে বিএনপিকে আবারো একটি বড় ধরনের সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি এসেছে সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ বলে পরিচিত একটি মহল থেকে। এব্যাপারে এখনই বিএনপি কিছু খোলাসা করে না বললেও বিষয়টির ব্যাপারে সময় নিচ্ছে বলে শোনা গেছে। খবর নির্ভরযোগ্য সূত্রের। 


বিএনপির ঐক্যের ডাক


নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে বিএনপি মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়তে চায়। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানে একদফা দাবিতে বড় ধরনের একটি ঝাকি দিতে আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নেয়ার কথাও জোরেশোরে আলোচিত হচ্ছে। নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর সময় বাকি থাকলেও এ নিয়ে নানামুখী তৎপরতার কথা শোনা যায় বিএনপির পক্ষ থেকে। এমন অভিন্ন দাবিতে বাম-ডানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে নিয়ে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’ গড়ার উদ্যোগের ফলাও প্রচার পায় বিএনপিরই পক্ষ থেকে।


আসলে হচ্ছে কি?

কিন্তু বাস্তব অবস্থা এখন ভিন্ন। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়তে চাওয়া বিএনপি কেমন জানি হঠাৎ চুপসে গেছে। যাদের সমমনা বলে বলে বলা হচ্ছে তাদের সাথে গত কয়েকমাস আগে যেভাবে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার একটা তৎপরতা দেখা গেছে, তা এখন নেই বললেই চলে। বৃহত্তর ঐক্যের চেয়ে বরং একধরনের লুকোচুরি খেলা করছে বিএনপির মধ্যে। বাম উদার গণতান্ত্রিক দলগুলিকে নিয়ে ঐক্যের কথা বলা হলেও ভেতরে ভেতরে জামায়াতের সাথে যোগাযোগ রাখা এমনকি নিজেদের ডাকা কর্মসূচিতে সংহতি জানাতে দাওয়াত দেয়াও হয়েছে। এর পাশাপাশি বাম উদার গণতান্ত্রিক দলগুলির সাথে বৈঠক করে একটি যুগপৎ আন্দোলনের ছক তৈরির প্রক্রিয়াও লক্ষ করা যাচ্ছে না বিএনপির মধ্যে। 


কিন্তু কেন?


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়তে চাওয়া বিএনপির হাঁকডাকে সরকারের মধ্যে একধরনের হ্রদকম্পন শুরু হয়ে যায়। কেননা সরকার ও তার দলের নেতাকর্মী এমনকি শরিকদের মধ্যে একটি অস্থিরতা দেখা দিয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে। সরকার একধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সরকার নানান ধরনের চাপের মুখে পড়ার পর থেকে এমনটা হচ্ছে বলে শোনা যায়। 

বিশেষ করে র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বিভিন্ন  ঘটনার পাশাপাশি বর্তমানে ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ সরকারের ওপর রাজনৈতিক ও স্নায়ুবিক চাপ পড়তে থাকে। এখন সব ঘটনার মধ্যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়ে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি গণআন্দোলনের ডাককে বর্তমান সরকার কোনোভাবেই হালকা করে নেয়নি। 

এসব পরিস্থিতিকে সামাল দিতে জানা গেছে, সরকারের একটি খুবই নির্ভরযোগ্য মহল বিএনপির একটি প্রভাবশালী অংশের শীর্ষনেতাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পাশাপাশি একটি ‘থিং ট্যাঙ্ক’ এ আলোচনায় শরিক হয়। একটি প্রতিবেশী দেশের রাজনৈতিক দলের নেতারা এ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে বলেও জানা গেছে। 


তারা বিএনপিকে বোঝাতে সক্ষম হয়, যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়া ও গণআন্দোলন বাদ দিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে একটি নির্বাচন করে এসরকারকে আরেকটি মেয়াদ রেখে দেয়ার ব্যবস্থা।
এতে বোঝানো হয় যে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়ে সরকার পতনের সুফল বিএনপি ভোগ করতে পারবে না। বরং এতে বিএনপি আরা কয়েক বছর পিছিয়ে পড়বে রাজনৈতিকভাবে।

নেতাকর্মীরা হতাশায় নিমজ্জিত হবে। অন্যদিকে সামনে যে কোনো পরিবর্তনে বিএনপির অপেক্ষাকৃত সিনিয়র এমনকি মাঝারি গোছের নেতারাও বিএনপির সে ধরনের আন্দোলনের কাছে কিছু ঘটে গেলে সটকে পড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির একটি বড়অংশ দলের সাথে থাকবে না বলেও বোঝানো হয়। তাই একটি সম্মানজনক সমঝোতায় এসে বিএনপি সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। এতে তাদের আম-ছালা দুই থাকলো বলে বোঝানো হয়। 


প্রস্তাবে যা যা থাকছে


জানা গেছে, সমঝোতার প্রস্তাবে বিএনপিকে সত্তরের অধিক আসন দিয়ে জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসানো। এমন প্রস্তাবের পক্ষে ইতিমধেই বিভিন্ন আলামতও দেখা গেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীই দেশে একটি শক্তিশালী (?) বিরোধীদল দেখতে ইচ্ছা পোষণ করেছেন। 

বর্তমানে জাতীয় সংসদে থাকার জাতীয় পার্টিকে তিনি একধরনের সমালোচনা করেই এর বিপরীতে একটি শক্তিশালী বিরোধীদল চান। বোঝাতে চেয়েছেন, বর্তমানে সংসদে থাকা জাতীয় পার্টি আসলে বিরোধী দল নয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে শক্তিশালী বিরোধী দল নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। 


গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধীদল অবশ্যই দরকার। কারণ আমরা গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন আক্ষেপকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অন্যভাবে দেখছেন। তাদের ধারণা এ যাত্রায় সরকার তাদের মনের মতো করে আরেকটি বিরোধীদল তৈরি করতে চান। সে ক্ষেত্রে তারা এবার বিএনপিকে বড় ধরনের ছাড় দিয়ে সে আসনটি দিতে চান।

কেননা দেশের ভেতরে এমনকি বিএনপিকেই বলা হয় প্রকৃতপক্ষে একটি বিরোধীদল। জানা গেছে, বিএনপিকে ছাড় দিয়ে আওয়ামী লীগ তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শরিকদেরও বঞ্চিত করতে কুণ্ঠা বোধ করবে না। 

আরেকটি প্রস্তাব সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাহলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আর তেমন উচ্চবাচ্য বা কটূক্তি করা হবে না। এর পাশাপাশি তারেক রহমান বাদে জিয়া পরিবারের কাউকে বিএনপির রাজনৈতিক হাল ধরার ব্যবস্থা করে দেয়া। আর চিকিৎসার নামে বেগম খালেদা জিয়া বাইরে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা। অন্য প্রস্তাব হচ্ছে চাইলে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব নিয়ে বিরোধীদলের চেয়ারে বসানো বিএনপি, যা হবে অনেকটা জাতীয় সরকারের আদলে। 


সন্দেহ যে কারণে প্রকট


নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়তে চাওয়া বিএনপির হঠাৎ নীরব নিথর হওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সন্দেহ প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়তে চাওয়া বিএনপি এবছর গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল ও উদার গণতান্ত্রিকমনা ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করেছিল।

এমনকি বিভিন্ন সময়ে টেলিফোনে মোবাইলে যোগাযোগ রাখতেন। যা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এসবের মাধ্যমে কোনো ঐক্য মঞ্চ গড়া ভিত্তি গড়ে ওঠেনি। তবে আলাপ আলোচনার দুয়ার বলা চলে খোলাই ছিলো। কিন্তু মার্চে তা দেখা যাচ্ছে না।

অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বিএনপির ১১ দিনের কর্মসূচিও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। শোনা গিয়েছিল এধরনের কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিএনপির সাথে মাঠে আন্দোলনরত জামায়াত বাদে সবার সাথে যুগপৎ আন্দোলন হবে। কিন্তু সব হঠাৎ থেমে যাওয়া সন্দেহ বাড়ছে।


বিএনপির জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে সন্দেহ


বিএনপির পক্ষ থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দলটি তাদের মিত্র জোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে তাদের নিয়েই জাতীয় সরকার করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো এসব প্রস্তাব বিএনপির।  একজন বাম নেতার সাথে এই প্রতিবেদনটি তৈরির সময় আলাপকালে বলতে শোনা যায়, জাতীয় সরকারের আওয়াজ বিএনপির ভাওতাবাজি।

সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, তাদের জয়লাভের সাথে দেখা নেই। এমনকি একটি শক্তিশালী জোট করার লক্ষণ নেই। কারা জোটে থাকবেন, তার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই, অথচ জাতীয় সরকারের ঘোষণা।


তাদের মতে, সরকারের সাথে তলে তলে সমঝোতা হয়েছে বিএনপির। তাই তারা এসব বক্তব্য দিচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপি এখনো কোনো কিছুই পরিষ্কার করেনি। আগামীতে তারা জামায়াত এবং যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে কি সিদ্ধান্ত নেবে তা স্পষ্ট নয়।

তাই তাদের মুখে জাতীয় সরকারের গঠনের নেপথ্যে অন্যকিছু আছে। 

এমনকি সম্প্রতি সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোটে জামায়াত থাকবে কি-না এ নিয়ে যখন হিসাব-নিকাশ চলছে, সেই সময়ে বিএনপির কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলের উপস্থিতি ও বক্তব্য দেয়া নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন, চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। সন্দেহ দেখা দিয়েছে বিএনপি আসলেই বাম প্রগতিশীল উদার গণতান্ত্রিকদের নিয়ে আগামী আন্দোলনে নামবে কি-না? নাকি তারা একটি সিট ভাগাভাগির নির্বাচনে অংশ নেবে? 


রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করে বিএনপির সাথে সরকারের কোনো না কোনো সমঝোতা হয়েছে এবং এমন প্রক্রিয়ায় জামায়াতও আছে। বিএনপির কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলের উপস্থিতি ও বক্তব্য তারই ইঙ্গিত করে। তাদের ধারণা বিএনপির কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলের উপস্থিতি ও বক্তব্য দেয়াতে বামরা এক মঞ্চে আসবে না নিশ্চিত। এতে আন্দোলনে ভাটা পড়বে। 

বাম প্রগতিশীলরা দূরে সরে যাবে। এমনটা জেনেই করা হয়েছে।

অনেকে মনে করে বিএনপির যে অংশটির সাথে সমঝোতা হয়েছে তাদের ইঙ্গিতেও সে বিএনপির কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলের উপস্থিতি ও বক্তব্য দেয়া হয়েছে। 

এদিকে একজন বাম নেতা এই প্রতিনিধি জানান, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠায় দাবি আদায়ে মাঠে বৃহৎ ঐক্য গড়তে চাওয়ার কথা কললেও বিএনপির পক্ষ থেকে এখন তেমন সারা মিলছে না। তিনি বলেন, বাম গণতান্ত্রিক জোট কি করবে না করবে, তার জন্য কারো মুখ পানে চেয়ে থাকেনা।


শেয়ার করুন