২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৬:৪৯:২১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


বিএনপিকে মোকাবেলায় শক্ত অবস্থানে আ. লীগ
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১২-২০২২
বিএনপিকে মোকাবেলায় শক্ত অবস্থানে আ. লীগ


মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগে ছিল কোন্দলে ঠাসা। কথায় কথায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বলা যায় বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছিল দলটির সাংগঠনিক কর্মকান্ড। কিন্তু এমন বিপর্যয়কর অবস্থার অনেক পরিবর্তন এসেছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে কোন্দল-কাদাছোড়াছুড়ি থেমে গেছে। আর এর পিছনে বেশি কাজ করেছে রাজপথে বিএনপি’র হুঙ্কার আর একের পর এক অংহিস কর্মসূচি। এসব কারণে আওয়ামী লীগ এখন অনেক সর্তক হয়ে গেছে। বিএনপিকে রাজপথে মোকাবেলা করে সামনে দিনে পথ চলতে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রেখে সব ভেদাভেদ ভুলে দলকে শক্তভাবে তৈরি করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। এসবব খবর জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে একান্তে কথা বলে। 

যেমন ছিল আওয়ামী কোন্দল......

খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই নিয়ে কোন্দলের বিষয় একটি মুখরোচক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাজনীতির পাশাপাশি গণমাধ্যমে। দেশের রাজনীতিতে প্রায়ই আলোচনায় দুই ভাইয়ের নাম উঠে আসে। নোয়াখালীর বসুরহাটের মেয়র নির্বাচনের প্রচারে নেমে নানা কথার মাধ্যমে আলোচনায় উঠে আসা আবদুল কাদের মির্জা এবার তার ভাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকেও হুঁশিয়ার করে দেন । আবার নোয়াখালীর বসুরহাটে ছোট ভাই কাদের মির্জার বিতর্কিত মন্তব্যের পর সতর্ক করেন বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বললেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে ছাড় পাবে না কেউ। অথচ বলতে শোনা গেছে আবদুল কাদের মির্জার মুখ থেকে যে ওবায়দুল কাদের সাহেব আমাকে এগোতে দেননি। ঢাকায় ভর্তি হতে গেলে তিনি আমাকে চট্টগ্রামে ভর্তি হতে বলেন। ঢাকায় ভর্তি হলে যদি আমি বড় নেতা হয়ে যাই। কিন্তু এনিয়ে বর্তমানে কোন্দল মন্তব্য পাল্টা মন্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে নোয়াখালী-৪ আসনের সাংসদ মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীকে জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। এখন তাকে মাফ করে দেয়া হয়। সম্প্রতি সম্মেলনে একরামুল করিম চৌধুরীর বক্তব্যের পরই প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন ওবায়দুল কাদের। এ সময় তিনি বলেন, ‘একরাম দীর্ঘদিন আমার সঙ্গে কাজ করেছে। কিছু ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে। সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কাছে ক্ষমা চেয়ে তার পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দিলেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরী। এ সময় তিনি ওবায়দুল কাদের ও শেখ হাসিনার পক্ষে শ্লোগান দেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন এমন ঘটনার নেপথ্যে হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন কারণ। 

এই তো গেলো শুধু একটি এলাকার ঘটনা। খোদ রাজধানীতেও নানান ধরনের ঘটনা আওয়ামী লীগকে অনেক বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। বিশেষ করে  ঢাকেশ্বরী পূজা মন্ডপে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের বিশৃঙ্খলা দেখে চটেছিলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আবার চট্টগ্রাম নগরীর লালদীঘি মাঠে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন শুরুর আগে দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে চেয়ার ছোড়াছুড়ি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন উদ্বোধনের পরপরই কর্মীদের মধ্যে চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনায় একজন আহত হন। অতি সম্প্রতি ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথ বার্ষিক সম্মেলনে বিশৃংলা দেখে ক্ষুব্ধ হয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যেরে উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে ওবায়দুল কাদের বলেই ফেলেন, এটাই কি ছাত্রলীগ... কোনো শৃঙ্খলা নেই... পোস্টার নামাতে বলছি, নামায় না, শ্লোাগান থামায় না.. ওবায়দুল কাদের বলেন, এটাই কি ছাত্রলীগ.. কোনো শৃঙ্খলা নেই..পোস্টার নামাতে বলছি, নামায় না, শ্লোাগান থামায় না! এই ছাত্রলীগ আমার চাই না। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, কথা শুনবে না এই ছাত্রলীগ আমাদের দরকার নেই। অপকর্ম করবে এই ছাত্রলীগ চাই না। দুর্নামের ধারা থেকে সুনামের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাই আজকের অঙ্গীকার। দলে ও অংগ সংগঠনের এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড বলা চলে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।  

আওয়ামী লীগে হানাহানি বেড়েছে..

এক হিসাবে দেখা গিয়েছে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের ৭৩টি সংঘর্ষে আটজন নিহত এবং ৮৯৫ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে চারটি সংঘর্ষে তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে ও ছয়জন আহত হয়েছেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এ বছরের রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতদের একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। এদের হিসাবেও দেখা গেছে চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের অন্তঃকোন্দলে ৭৩টি সংঘর্ষ হয়েছে। এতে আটজন নিহত এবং ৮৯৫ জন আহত হয়েছেন। অবশ্য আসকের হিসাবে একই সময়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ ১৭টি সংঘর্ষে একজন নিহত এবং ২১১ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে বছরের প্রথম ৯ মাসে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ৬১ সংঘর্ষে ছয়জন নিহত ও ৮০১ জন আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুবলীগের একটি সংঘর্ষে তিনজন আহত, ছাত্রলীগের একটি সংঘর্ষে একজন নিহত ও তিনজন আহত হয়েছেন। যুবলীগের নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ একটি সংঘর্ষে তিনজন আহত হয়েছেন। যুবলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের তিনটি সংঘর্ষে ৩৮ জন আহত হয়েছেন। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ ছয়টি সংঘর্ষে একজন নিহত ও ৪৭ জন আহত হয়েছেন। আসকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এবছর জানুয়ারি থেকে গত ৯ মাসে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৪৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। তাঁদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষগুলোর পেছনেও দলীয় কোন্দলই বড় কারণ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা।  এমাসে আওয়ামী লীগের যে জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা তাকে কেন্দ্র করেই জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও অধীন শাখা কমিটিগুলোর সম্মেলন জোরালোভাবে শুরু হয়েছিল। এসব সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে উঠে। 

ইউপি নির্বাচনে হানাহানিতেও আওয়ামী লীগ এগিয়ে..

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা হয়েছে নিজেদেরই মধ্যে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে। এই দুই ধাপে যথাক্রমে ৩০ ও ২৬ জন নিহত হয়েছেন। প্রথম ধাপে দুই ভাগে নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের নির্বাচন সারা দেশে নির্বাচন ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়। প্রথম ধাপে ৫ জন, চতুর্থ ধাপে ১০, পঞ্চম ধাপে ২৩ ও ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে। এসবের পেছনে আওয়ামী লীগের নিজেদেরই কোন্দল। 

তৃণমূলে কোন্দল

এদিকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলে নাকাল তৃণমূল আওয়ামী লীগ। গ্রুপিং, পাল্টাপাল্টি কমিটি ঘোষণা ও বহিষ্কার, মুখোমুখি সংঘর্ষ এবং হামলা-মামলা লেগেই আছে। আর এসবে পেছেনে নেতৃত্বে রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের শীর্ষ নেতারা। তাদের বিরোধ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্র। বারবার নির্দেশনার পরেও বিভেদের রাজনীতির কারণে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব ঘটনা। 

এখন থমকে গেছে কোন্দল...

টানা প্রায় ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটিতে এখন এসে আওয়ামী লীগের ভেতরে নানারকম সংকট বেড়েই চলেছিল। অভ্যন্তরীণ কোন্দল, হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী সব ছাপিয়ে আওয়ামী লীগ নানান সঙ্কটেই ছিল। কিন্তু বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের আন্দোলন নানামুখী চাপে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এখন থমকে গেছে। বিশেষ করে গত ১০ ডিসেম্বরের বিএনপি’র ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন শরিকদের মধ্যেও দেখা দেয় হতাশা আতঙ্ক। কেননা মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ধরে নিয়েছে যে ১০ ডিসেম্বরের একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে। ধরেই নিয়েছিলো তাদের দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী এধরনের সঙ্কটকে মোকাবেলা করতে পারবে না। ফলে ১০ ডিসেম্বরের দেশে এক গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। আর এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী পড়বে বেকায়দায়। আর ক্ষতিগ্রস্থ হবে লাখ লাখ আওয়ামী কর্মী। এমন পরিস্থিতির আশঙ্কা থেকে বলা যায় আওয়ামী লীগে নানান ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। শুধু প্রশাসনের ওপর নির্ভর না করে আওয়ামী লীগ ১০ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে বলা যায় ঘুরে দাঁড়ায়। নিজেদের কোন্দল অহমিকা ত্যাগ করে নিজ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি জনগণের কাতারে নেমে আসার চেষ্টা করে। আর এতে ফল দেয়। ক্ষমতার মোহে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া আওয়ামী লীগ এখন বেশি বেশি রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করেছে বলে দলীয় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে। আওয়ামী লীগে এখন এমন কথা বলা হচ্ছে যে বিএনপি আওয়ামী লীগের ঘুম ভাঙ্ঘিয়ে দিয়েছে। বিএনপিকে রাজপথে মোকাবেলা করতে গিয়ে উল্টো সামনে দিনে পথ চলতে নিজেদের শক্তভাবে তৈরি করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। আর এসব কারণেই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীসহ দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত আওয়ামী লীগের শতাধিক নেতা-কর্মীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সভায় এ ঘোষণা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের মতে, দলের রাজপথে বিএনপিকে মোকাবেলায় নিজেদের ঐক্য অক্ষুন্ন রাখতে দলের হাইকমান্ড এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে দলের ভিত্তি আরো শক্তি পাবে বলেই তারা মনে করেন। আর মাত্র দু’দিন পর পর আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। ধারণা করা হচ্ছে এ কাউন্সিল থেকেই বিএনপি’ক মোকাবেলায় দলকে ঐক্যবদ্ধ থাকার ডাক আসবে। কারণ আওয়ামী লীগ মনে করে বিএনপি’কে রাজনৈতিকাব্যে মোকাবেলা করা তাদের জন্য এখন জরুরি।

শেয়ার করুন