২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০২:১১:১২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


আ.লীগ-বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানে সংকটাপন্ন দেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৬-০৮-২০২৩
আ.লীগ-বিএনপির মুখোমুখি অবস্থানে সংকটাপন্ন দেশ


আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নিয়ন্ত্রিত বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধী ফ্রন্টের মুখোমুখি অবস্থানে দেশ, মহাসংকটের কিনারায়-এ কথা বহুদিন ধরেই বলা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায় থেকে। সতর্ক করা হচ্ছে সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, লেখক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক সব জায়গা থেকে। এমনকি বিদেশি নামকরা সংস্থাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকেও এ কথা বলে আসছে বারবার। সবারই পরামর্শ এক একটি রাজনৈতিক সমঝোতা। বিরোধী দল ও সরকারি দল যে যে অবস্থানে থাকুক না কেন, দেশের স্বার্থে এক টেবিলে আসা উচিত। আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে যাওয়া উচিত। দেশের উন্নয়ন ধারা অব্যাহত চান সবাই। সবারই প্রত্যাশা দেশ ও জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন। সেটাই যদি হয়, তাহলে এক প্ল্যাটফর্মে যেতে ক্ষতি নেই। কিন্তু এরপরও কেন যাওয়া যাচ্ছে না। সমস্যা কোথায় সেটাও কেউ খুঁজে বের করছে না দুই পক্ষের কেউই।

অথচ বৈষয়িক সংকটের প্রতিক্রিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য  লাগামহীন। মাফিয়া সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের সব কার্যক্রম। খাদ্য, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, যোগাযোগ সব ক্ষেত্রে গত ১৫ বছরে সরকারপ্রধানের সাহসী ভূমিকার কারণে বিশাল উন্নয়ন হলেও  দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খেয়েছে। উন্নয়নের কাক্সিক্ষত সুফল জনগণের দোরগোড়ায় সম্পূর্ণভাবে পৌঁছেনি। অরজিনালি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণে ধারণ না করা কতিপয় সুযোগসন্ধানী চাতুরতার সঙ্গে দীর্ঘসময় থাকা সরকারের শুভাকাক্সক্ষী সেজে সরকার সমর্থক গোষ্ঠীর নাম নিয়ে, দুর্নীতি করে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা নানা দেশে পাচার করেছে। অথচ যারা সত্যিকারের বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, দেশের স্বার্থে সামান্যতম সমঝোতা করে যাননি যে আদর্শিক নেতা, তার আদর্শ লালনকারী হলে কখনো এমন আওয়ামী লীগ আদর্শবহির্ভূত কাজে উৎসাহিত হতেন না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ছদ্মবরণ করা এসব লোকের কর্মকাণ্ডে এখন অতিষ্ঠ দেশ এ কথা প্রতিনিয়ত বের হচ্ছে। পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে বিদেশিরাও এ রহস্য উদ্ঘাটন শুরু করেছে। এটা এখন লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার। 

দীর্ঘদিন বিষয়গুলো দেশের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন দুই রাজনৈতিক ফ্রন্টের দ্বন্দ্বের কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রকাশিত। নিজেদের দেশের মানুষের মধ্যে ঐক্য না থাকলে যা হয়, প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজদের কর্মকাণ্ডের সংবাদ বিদেশি মাধ্যমে এখন প্রকাশিত হচ্ছে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশ বিরোধীশক্তি সত্য-মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে কিছু বিদেশি শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে।

অথচ সাধারণ মানুষের কাছে, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে থেকেও বিদ্যুৎ লাভ করেছেন। রাস্তাঘাটসহ সার্বিক উন্নয়নের সুফলভোগী সেসব তৃণমূলে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার এখনো বিপুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ মিলছে। সচেতন মহল জানে কেন সরকারপ্রধান তার আন্তরিক এবং জীবনপণ প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও দ্রুত পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারের মন্ত্রী এবং সাংসদরা তৃণমূলের সঙ্গে বিস্তর দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছেন। কারণ রাজধানী বা দেশের বাইরে বসে অনেকেই তৃণমূলে দুর্নীতিবাজ ও দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে প্রভাববিস্তারকারীদের সহায়তা দিয়েছেন লাঠিয়াল হাতে রাখার উদ্দেশ্যে। যেখানে আদর্শ ও উন্নয়ন মিলিয়ে জনগণের ভালোবাসা ও জনগণের পাশে থাকার কথা, সেখানে অনেক শীর্ষনেতাদের অদূরদর্শিতায় সাধারণ মানুষের কাছে একধরনের ভীতি কায়েম করার ফলে সাধারণ মানুষ ক্রমাগত সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমন না যে বিরোধী দলের ওপর জনগণের আস্থা আছে। এরপরও কেন এতো উন্নয়ন করার পরও সরকারি দলের প্রতি বিমুখ অনেক মানুষ। এমতাবস্থায় যে কোনোভাবে জনগণ ভোট প্রদানের সুযোগ পেলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় সরকারি দলের নির্বাচনে জয়লাভ সহজ না-ও হতে পারে। আর তাই সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অসম্মত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। অন্যদিকে নানাভাবে সরকারের সব পর্যায়ে নানাভাবে দলীয়করণ হওয়ায় বর্তমান সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে অনেক মহল আস্থাহীনতায় ভুগছে। এ পরিস্থিতি এক-দুই দিনে হয়নি। তিলে তিলে এমন অবস্থার তৈরি। অথচ যারা সরকারপ্রধানকে এ এব্যাপারে আরো অনেক আগেই সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেওয়ার কথা, তারা সম্ভবত এড়িয়ে গেছেন। এখন সরকারপ্রধান আপ্রাণ চেষ্টা করে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের কাছে ডেকে কথা বলছেন। আশ্বাস দিচ্ছেন। পরারর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু খোদ আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ রয়েছে, তাদের কি আশ্বস্ত করা গেছে? 

কয়দিন আগে বর্ধিতসভায় তৃণমূলের অনেক ত্যাগী নেতা তাদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। সবাই সময় স্বল্পতার জন্য পারেননি। তবে এমন ক্ষোভ যে অনেকেরই সেটা দলের শীর্ষ ব্যক্তি বুঝে গেছেন। তাদের সবার অভিযোগ ওইসব এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-এমপি কিংবা নেতাদের বিরুদ্ধে। অথচ দলের প্রধানের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। মনেপ্রাণে তারা চান বঙ্গবন্ধু কন্যার শুভকামনা। দলের শুভকামনা। প্রধানমন্ত্রী তাদের নিদের্শনা দিয়েছেন। কিন্তু ওইসব নেতৃত্ব যারা তৃণমূলের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা কী তাদের অধীনস্থদেও বোঝাতে সক্ষম হবেন? এটা এখন বিশাল প্রশ্ন। 

দুনিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ করোনা অতিমারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠলেও বাংলাদেশ কিন্তু এখনো তীব্র ডলার সংকটে। প্রতিনিয়ত আমদানি সংকুচিত, রফতানি আয়, রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় বিদেশি মুদ্রা সঞ্চয় মহামারি আকারে সংকট পর্যায়ে। ডলার সংকটে আমদানি নির্ভর জ্বালানি (কয়লা, তেল, এলএনজি) ক্রয়ের ক্ষমতা সংকুচিত। বিপিসি, বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা দেউলিয়া হবার পর্যায়ে। বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য নিম্নমুখী হয়ে এখন ক্ষেত্র বিষয়ে করোনা পূর্ববর্তী পর্যায়ে পৌঁছলেও ডলার সংকটের কারণে সরকারের সক্ষমতা প্রকাশে ব্যর্থ হচ্ছেন। সরকার মনেপ্রাণে চাচ্ছে পরিস্থিতির সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নিতে। কিন্তু ডলার সংকটে সেটা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না। এটা ভীষণ কষ্টদায়ক। নিজেদের কয়লাসম্পদ মাটির নিচে। গ্যাসসম্পদ অনুসন্ধান কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। ২০২৪-২০২৫ থেকে শুরু হবে ইতিমধ্যে সম্পাদিত বিপুল বৈদেশিক ঋণনির্ভর মেগা প্রকল্পসমূহের সুদসহ ঋণ পরিশোধ। ২০২৬ থেকে বাংলাদেশ নিম্নআয়ের দেশের জন্য এতোদিন সুযোগ থাকা সুবিধাদি থেকেও বঞ্চিত হবে। 

ধারণা করা যায়, এখান থেকে কত গভীর এবং ব্যাপক সংকট এগিয়ে আসছে বাংলাদেশে। এমতাবস্থায় দেশে বর্তমান রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা থেকে অরাজকতা সৃষ্টি হলে এতোদিনের অর্জনগুলো অচিরেই গলার কাঁটায় পরিণত হয়ে যেতে পারে। 

দেশপ্রেমিক গোষ্ঠীর উচিত বিবদমান গোষ্ঠীকে আলোচলার টেবিলে এনে সংকটের সমাধান করে জনগণকে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের সরকার নির্বাচনের সুযোগ করে দেওয়া। জনগণ নিজেরা বেছে নেবে তাদের ভবিষ্যত। এটাই এখন পারফেক্ট পথ। বাংলাদেশ লক্ষ প্রাণের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত। কথা বলার সুযোগ পান না বলে সাধারণ মানুষকে বোকা ভাবার সুযোগ নেই। তারা বোঝেন কোনটা সঠিক, কোনটা সঠিক নয়। কার দ্বারা উন্নয়ন সম্ভব, কার দ্বারা সম্ভব নয়। 

বর্তমানে প্রতিদিন বিদেশি শক্তি কারণে-অকারণে প্রভুর মতো দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। এটা দেশপ্রেমিক মানুষদের অহংকার আহত হওয়ার কথা। দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ স্বাধীনচেতা। জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকলে বিদ্যমান সংকট মুহূর্তে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করে উতরে যেতে পারবে।  

যা কিছু করার অচিরেই করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষও চায় না প্রিয় বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলোর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের থিয়েটারে পরিণত হোক। সংকট মুহূর্তে শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করার সুযোগ নেই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আপন বলে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যাক এ প্রত্যাশা ১৭ কোটি মানুষের। এটা বারবার বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না!

শেয়ার করুন