০৪ মে ২০১২, শনিবার, ১১:০৫:৩১ পূর্বাহ্ন


পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি উইন রোজারিও হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার কমিউনিটি
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৪-২০২৪
পুলিশের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি উইন রোজারিও হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার কমিউনিটি প্রতিবাদ সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা


নিউইয়র্ক সিটির পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন বাংলাদেশি উইন রোজারিও। গত ২৭ মার্চ নিজ বাসায় উইর রোজারিওকে মায়ের উপস্থিতিতে গুলি করা হয়। গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে উইর রোজারিও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো মাত্র ১৯ বছর। এদিকে উইন রোজারিও হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশি কমিউনিটি সোচ্চার। তারা এই ঘটনাকে হত্যা হিসেবে অভিহিত করেছেন। রোজারিও হত্যাকারীর শাস্তির দাবিতে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হত্যাকারীদের বিচার না হাওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ সমাবেশ চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রব মিয়া।

জানা গেছে, রোজারিও মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। জানা গেছে, ঘটনার সময় রোজারিও পুলিশ সদস্যদের দিকে কাঁচি নিয়ে যেতে চাইলে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল।

ছেলে হারানোর শোকে ভালো করে কথাও বলতে পারছেন না বাবা ফ্রান্সিস রোজারিও। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ছেলে আমার নিউইয়র্কের জন অ্যাডাম স্কুল থেকে থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছিল। তাকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিল!’ মানসিক সমস্যার কারণে দুইবার জ্যামাইকা হসপিটালে ভর্তি ছিলেন উইন। এ সমস্যার জন্যই আমাদের কাছে বেশি আদরের ছিল সে। আর সে ছেলেই হারিয়ে গেল মায়ের কোলে গুলিবিদ্ধ হয়ে।

উইনের ছোট ভাই উৎস রোজারিও বলেন, পুলিশ গুলি ছোড়ার আগে পুরোটা সময় তার মা ভাইকে জাপটে ধরে রেখেছিলেন। এমনকি ভাইকে ধরে রাখা অবস্থায়ই গুলি ছোড়ে পুলিশ। এই গুলি ছোড়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না। 

মর্মন্তুদ ঘটনার সাক্ষী মা ইভা ডি কস্তার আর্তনাদ যেন থামার নয়। ক্রমাগত কেঁদেই চলেছেন ছেলের কথা বলতে বলতে। বাঙালি কমিউনিটির আইনি পরামর্শকেরা এসেছেন তাদের সান্ত¦না দিতে এবং মামলার বিষয়ে পরামর্শ করতে। কমিউনিটির নেতাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন ফ্রান্সিস রোজারিও।

রোজারিও পরিবারর সঙ্গে দেখা করতে যান আইনজীবী মঈন চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পরিবারের অনুমতি নিয়ে আমরা পুলিশের কার্যক্রম তদন্ত করছি। তাদের কোনো ত্রুটি থাকলে আমরা নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বিরুদ্ধে শিগগির মামলা করবো।’

নিহত উইনের দূরসম্পর্কের আত্মীয় সুখেন জোসেফ গোমেজ। তিনি বলেন, উইনের মায়ের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জ আর বাবার বাড়ি পূবাইলে। আমার মা এবং উইনের মা বাংলাদেশ থেকেই পরিচিত। এছাড়া রোজারিও পরিবারের সঙ্গে অন্য কারো খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।’ সুখেন বলেন, রোজারিও পরিবার এখানে আসার পর গুটিকয়েক পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে খুব একটা দেখা যেত না। তাদের বাসায় যতবার গিয়েছি, উইনকে দেখেছি পড়ালেখা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে।

উইনের ভাই উৎস রোজারিও বলেন, ‘ভাই ছিলেন খুবই অন্তর্মুখী স্বভাবের। খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সবসময়। আমেরিকার মেরিনে (নৌবাহিনী) যোগ দেওয়ার স্বপ্ন ছাড়াও তার ইচ্ছা ছিল বড় অ্যাথলেট হওয়ার। বাসায় চর্চাও করতেন। খুব একটা বন্ধুবান্ধব ছিল না তার। আমিই ছিলাম তার বন্ধু।’

এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উদ্যোগে গত ২৯ মার্চ এবং ১ এপ্রিল গাজীপুর অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায়। সুখেন গোমেজেন পরিচালনায় বিক্ষোভ সমাবেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকীর রহমান, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব এ এফ মিসবাজউজ্জামান, কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট সৈয়দ আল আমিন রাসেল প্রমুখ। গাজীপুর জেলা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এমডি এ জুয়েলের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ইসহাক মোল্লা বাবুর পরিচালনায় প্রতিবাদ বিক্ষোভে প্রধান অতিথি ছিলেন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রব মিয়া, সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সিদ্দিকী, জেবিবিএর সভাপতি গিয়াস আহমেদ, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ডা. মাসুদুল হাসান, গাজীপুর জেলা অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান উপদেষ্টা মনসুর খান প্রমুখ। এছাড়াও বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সোসাইটির সিনিয়ন সহ-সভাপতি ফারুক চৌধুরী, সহ-সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক রিজু মোহাম্মদ, কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট সৈয়দ আল আমিন রাসেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মশিউর রহমান, এজি জাহাঙ্গীর হাসাইন, ইয়েলো সোসাইটির সাবেক সভাপতি আউয়াল ভুইয়া, শরিফ আহমেদ লস্কর, সাবেক সভাপতি মোডলসহ-সাজীপুর জেলা অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা।

বিক্ষোভ সমাবেশে তারা বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। সেই সঙ্গে তারা বিভিন্ন ধরনের প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা তার বক্তব্যে বলেন, আমরা আমেরিকার মতো একটি উন্নত দেশে বসবাস করছি। এই দেশে এভাবে হত্যাকাণ্ড কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আশা করি আমরা ন্যায়বিচার পাবো। এই ন্যায় বিচারের দাবিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থেকে আন্দোলন করতে হবে।

বাংলাদেশ সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রব মিয়া বলেন, এটা হত্যাকা-। পুলিশ ইচ্ছা করলে তার পায়ে গুলি করতে পারতো। তাহলে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। তিনি বলেন, রমজানের মধ্যে যদি এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করা না হয় তাহলে আমরা বড় ধরনের প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজক করবো।

গিয়াস আহমেদ বলেন, আমি মনে করি এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, এটা যদি সাদা চামড়ার মানুষ হতো তাহলে পুলিশ এভাবে গুলি করতো পারতো না। আমাদের চামড়ার কারণেই আমাদের সন্তান বা আমাদের হত্যা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, খুনির বিচার না হাওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।

রুহুল আমিন সিদ্দিকী বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময়ে পুলিশের ভিডিওটি যেন প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তা না হলে আমরা কেউই নিরাপদ থাকবো না।

বাংলাদেশের সোসাইটির নিন্দা

গত ২৭ মার্চ ১:৪০ মিনিটের দিকে ওজোনপার্ক ১০৩ স্ট্রিট, ১০১ অ্যাভিনিউয়ের নিজ বাসায় মা আর ছোট ভাইয়ের সামনেই নিউইয়র্ক পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারালো মানসিক ভারসাম্যহীন বাংলাদেশি তরুণ উইন রোজারিও। তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। তার মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ গোটা কমিউনিটি। বাংলাদেশ সোসাইটি এই ঘটনারে তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছে। একই সঙ্গে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছে।

এ ঘটনার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে সোসাইটির কর্মকর্তারা নিহতের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বাংলাদেশ সোসাইটির পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।

এদিকে কমিউনিটির অন্যান্য সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ সোসাইটি এই ঘটনার প্রতিবাদে একটি প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পুলিশের গুলি করে হত্যার তদন্ত দাবি ঐক্য পরিষদের

গত ২৭ মার্চ বুধবার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ওজন পার্কের বাসিন্দা ১৯ বছরের তরুণ উইন রোজারিও ফোন করে পুলিশের সহায়তা চাইলে পুলিশ ওদের বাসায় আসে। কিন্তু পুলিশের দাবি ছেলেটি কাঁচি হাতে তাদের দিকে তেড়ে এসেছিল বলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ওকে গুলি করে হত্যা করে। সম্ভাব্য কাঁচির আক্রমণ প্রতিহত করতে শক্ত সামর্থ পুলিশ অফিসারদের উইনকে গুলি করে হত্যা করার একান্ত প্রয়োজন ছিল কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন; পুলিশের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের ফলে মৃত্যুর ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে থাকে বলে এটা কমিউনিটির অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না, উইনের পরিবারের কারো কাছে তো নয়ই। যাইহোক, পুলিশের বডি-ক্যাম দেখে এবং নিহত উইনের মা ও ভাইয়ের বক্তব্য শুনে অবিলম্বে এই করুণ ঘটনার নিষ্পত্তি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদ পুলিশ কমিশনার এডওয়ার্ড ক্যাবান, কুইনস বরো প্রেসিডেন্ট ডোনাভান রিচার্ডস জুনিওর, ও মেয়র এরিক অ্যডামকে অনুরোধ জানাচ্ছে, যা লিখিতভাবেও জানানো হচ্ছে। ঐক্য পরিষদ উইনের আত্মার শান্তি কামনা করে এবং ওর মা-বাবাসহ পরিবারের শোকাহত সবার প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করে।

শেয়ার করুন