২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০১:৩৫:২৭ পূর্বাহ্ন


একটা অন্যায়কে ন্যায় করবো বলেই যা খুশি তাই বলি
মাহমুদ রেজা চৌধুরী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৬-২০২২
একটা অন্যায়কে ন্যায় করবো বলেই যা খুশি তাই বলি


আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সময়, এই গানটাও বেশ শুনতাম- ‘আমরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি..’। এখন নিজের মতো করে বলি, ‘একটা অন্যায়কে ন্যায় করবো বলেই যা খুশি তাই বলি’। এটা ব্যক্তিগত ৬ দশকের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম। দেখা থেকেও বলা, বোঝা থেকেও। আজকে মানুষের বাজারে সত্যিকারের মানুষ খুঁজে পাওয়াই কষ্ট। মানুষ আছে অসংখ্য, কোটি কোটি। তবু মনে হয় কোথাও যেন কেউ নেই। কারো জন্যই কেউ নেই। এরকম অবস্থা শুরুতে ছিল না, যখন আমাদের শৈশব এবং কৈশোর গেছে। এখন এটা ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। মানুষ এখন নিজের কাছেই নিজে বন্দি অথবা সে একা। 

গতকালকেই এক বন্ধু ফোন করে বলেছে, সারাদিন কাজের শেষে বাড়ি ফিরে ঘরে ওর তিন ছেলেমেয়ে থাকা সত্ত্বেও তবুও ও কাউকেই ওদের দেখতে পারে না। যদিও ওরা তখন ঘরেই থাকে। প্রত্যেকের রুমের দরজা থাকে বন্ধ, অথবা ভেজানো। যে যার ঘরের ভেতরে বসে কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। কারোর সাথে কেউ কথাও বলে না। কেউ ইন্টারনেটে ব্যস্ত, কেউ টেলিফোনে। কেউ অসময়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, কেউবা নিজের রুমের টেলিভিশনে নিজের পছন্দের কোনো চ্যানেল দেখছে একা একা। নো, ‘ইন্টারেকশন উইথ ইচ আদার’। আমাকে বললো, জানিস আমি সেদিন চিৎকার করে বলেছি, ঘরের সব রুমের দরজা আমি ভেঙে দেবো। কোনো রুমে আর দরজা থাকবে না এখন থেকে। সবাই যেন সবাইকে দেখতে পারি আমরা ঘরের ভেতরে যখন থাকি।

বর্তমান সময়টা এরকমই যাচ্ছে, খুব কাছে থেকেও যেন অনেক দূরেই আমরা একেকজন। এর নাম নাকি আধুনিকতা, প্রাইভেসি, ব্যক্তিস্বাধীনতা। পরিবার থেকেই তো এখন এরকম নিঃসঙ্গতা শুরু হয় আমাদের। বৃহত্তর সমাজ এবং রাষ্ট্রে এরই প্রতিফলন দেখেছি বিগত ৫০ বছর দেশে এবং বিদেশেও। এই একইভাবে চলছে। ব্যক্তি নিঃসঙ্গতা থেকে শুরু করে সামাজিক এবং রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতার ছবিগুলোও ক্রমশই আমাদের অন্ধকারের দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে, এসব আর আমরা এখন পরোয়াই করি না। জোনাকি পোকার আলোকে দূর থেকে দেখলে যতটা মৃদু বলে মনে হয়, জোনাকি পোকার কাছে গেলে অতটা হালকা মনে হয় না। চোখে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমাদের সামনের দিনগুলো খুব নিকট ভবিষ্যতে উজ্জ্বল হবার সম্ভাবনা কম, এই কমের গভীরতা কতটুকু যখন সেই দূরটা কাছে আসবে হয়তোবা আমরা বুঝতে পারবো, তার আগে বুঝবো বলে মনে হয় না।

ষাটের দশকে আমরা যারা বেড়ে উঠেছি, যাদের আমাদের এই সময়টা ছিল কৈশোর এবং শৈশবের, এখনকার কিশোর এবং শৈশব যাদের তাদের থেকে অনেক গুণগত বিচারে সেটা ‘মানবিক’ ছিল। জীবনের মূল্যবোধ এখনকার চাইতে অনেক বেশি সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। ভ্রাতৃত্ব এবং বন্ধুত্ববোধ নির্ভেজাল হতো। দার্শনিক Bertrand Russel তাঁর একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ১৯৫৩ সালে দেয়া সাক্ষাৎকার। রাসেল বলেন, কোনো ধরনের হিংসা নয়, মানবসমাজ এবং বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। এই বিশ্বাস এবং জীবনবোধ এখন অনেক বদলে গেছে আজকের সমাজ এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রেও। এটা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য, সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। যেটা দেখেছি এবং এখনো যা দেখছি সেটাই বললাম। বিচার করবেন পাঠক। 

ব্যক্তিগতভাবে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র। আমার কাছে সমাজের অর্থনীতি এবং রাজনীতিকে দেখবার যে দর্পণ সেটা ‘সমাজ দর্পণ’। সমাজের স্তরবিন্যাসের দর্পণ। একজন মানুষকে রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মানুষ হিসেবে ভাববার আগেই ব্যক্তিগতভাবে সামাজিক ও মানবিক মানুষ রূপেই দেখতে চেষ্টা করি। ইদানীং কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই দেখাকে ধরে রাখা। আমার এক সিনিয়র বন্ধু গতকালকেই আমাকে বলছিলেন, রেজা, আপনার সাম্প্রতিক লেখায় কোথায় যেন মনে হচ্ছে আপনার ভেতরে যে আশাবাদ ছিল সেটা ক্রমান্বয়েই একধরনের নিরাশা এবং কষ্টের দিকেই চলে যাচ্ছে যেন। বলেছি, ঠিক বলেছেন। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে আমি কোনো ব্যাপারেই খুব আশাবাদী হতে পারতেছি না। যতদূর সামনে দেখতে চেষ্টা করি, কেবলই অন্ধকার বেশি দেখি। জানি না এটা আমার বয়স অথবা অন্য কোনো সীমাবদ্ধতার কারণেই কিনা। 

আমার মতো এরকম একজন ‘আননোন’ ও অতি ‘অর্ডিনারি’ কেউ অটোবায়োগ্রাফি লিখতে উৎসাহবোধ করেন কিনা জানি না। কারণ সমাজ এখন hero-worship-দের দখলেই। ‘নন হিরো’ বা ‘নন অ্যাচিভারদের’ কথা আমরা কেনইবা শুনবো অথবা পড়বো। এসব ব্যাপারে সময় অপচয় করার তো কোনো যুক্তি নাই। এটা একেবারেই ঠিক কথা। তবু নিজের জীবনে চোখে দেখা অভিজ্ঞতার কিছু স্মৃতির কিছু কথা লিখতে চেষ্টা করি। 

বাংলাদেশে বিগত পাঁচ দশকে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অধিকাংশ পরিবর্তনগুলো অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে যুক্ত হলেও মানুষের মানবিক উন্নতির সাথে একেবারেই সেটা সাংঘর্ষিক। সমাজে অন্যায়ের বিভিন্ন কৌশল এবং এটার সংখ্যাও বাড়ছে। মিথ্যাচারিতা, ভন্ডামি, মানুষকে ঠকানো, নানান ‘অপসংস্কৃতির দাপট’, ব্যবসায় শঠতা, হিংসা প্রতি হিংসা, চুরি-ডাকাতি মহামারী, খুন, গুম, জিম্মি সংস্কৃতি। ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক চরম অসহিষ্ণুতা। জাতীয় ঐক্য, জাতীয় সংহতি এবং সৌহার্দ্য। এসব কিছু গত পাঁচ দশকে কিন্তু অনেকেই কমে গেছে। এটাকেও আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। 

অনেকেরই অভিমত, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের প্রবহমান ধারায় ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। পাশাপাশি যদি বলি ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ড, সেটাও কিন্তু আমাদের ইতিহাসের একটি নতুন ধ্বংসের মাইলফলক ছিল। স্বাধীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে প্রথম ‘ক্রসফায়ারে’ রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী একজনকে গুলি করে মেরে ফেলাও স্বাধীন বাংলাদেশে এক নতুন অপরাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাসে নতুন সংযোজনের সূচনাই ছিল। সেটাও কম গুরুত্বের না। এক রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জঘন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল সেটা। এর একটু আগে যদি ফিরে তাকাই, ১৯৭২-১৯৭৫ সেই সময়ের দিনগুলির দিকে। সেখানেও আমাদের হতাশা ছিল অনেক। সমাজ ও রাষ্ট্রে নানান দুর্নীতি এবং অন্যায়-অবিচারের শুরু, কিন্তু ১৯৭২ থেকেই। ইতিহাসের বিকৃতিকরণ সেখান থেকেই শুরু যা আজও অব্যাহত আছে।

আমরা যে জাতীয় সংহতি এবং গণতন্ত্রের জন্য মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম ১৯৭১-এ, আজকে পর্যন্ত সেই গণতন্ত্র এবং নাগরিক মুক্তি সার্বিক অর্থে অর্জন করতে পারি নাই। মনে আছে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল ছিল, ‘জাসদ’ অর্থাৎ ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’। দলটি গঠিত হয় ১৯৭৩-’৭৪ সালে। হাজার হাজার তরুণ এবং মেধাবী নাগরিক ও ছাত্রসমাজ তখন এই দলের সাথে গিয়ে যুক্ত হন। পাশাপাশি তখন ক্ষমতাসীন সরকার তাঁর বিরোধী প্রতিপক্ষ বিশেষ করে জাসদকে সম্পূর্ণভাবেই নির্মূল করে দেবার জন্য তৎকালীন জাসদের হাজার হাজার কর্মী এবং সমর্থকদেরও তৎকালীন সরকারের বিশেষ বাহিনী ‘রক্ষীবাহিনী’ দিয়েও নির্মমভাবে গুম এবং খুন করেন। কেন? কারণ স্বাধীনতার পরপরই যখন দেশের নাগরিক সমাজ দেখতে পারে, যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে এবং আমরা স্বাধীন হয়েছি, দুর্ভাগ্যক্রমে সেই স্বপ্নের পথে না হেঁটে আমরা এখন হাঁটছি সেই পুরোনো মনিবদের পথে, নতুন আধিপত্য বিস্তারের নতুন কৌশল নিয়ে। সমাজে মিশ্র এবং সাংঘর্ষিক পোলারাইজেশন বেড়েই যায়। অনেক পরিবার থেকেই শুরু হয় ’৭২-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতির সামাজিক স্তরবিন্যাসে উপনিবেশ চরিত্র এবং বৈষম্য। এই বৈষম্যের একটা শ্রেণি ছিল সিক্সটিন ডিভিশন মুক্তিযোদ্ধা। যারা রাতারাতিই নিজের পোশাক পরিবর্তন করে ছদ্মবেশে প্রবেশ করেছে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক বড় সুবিধাবাদী দলে। এই প্রবণতা আজকে মাকড়সার জালের মতোই বিস্তৃত সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরেও।

বিগত প্রায় পাঁচ দশক থেকেই কিছুটা সামাজিক দৃষ্টিকোণে বিশ শতকের বাংলাদেশকে যেভাবে বুঝেছি, এই শতকটা বেশ ঘটনাবহুল। যে সমস্ত ঘটনা বিশ শতকে ঘটেছে সবটাই পৃথিবীকে অনেকটাই বদলে দেয়। বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম না।  সমাজবিজ্ঞানে সমাজকে সামাজিক সম্পর্কসমূহের জাল বিশেষ বলে ধরে নেয়া হয়। সমাজ বিস্ময়করভাবে একটা জটিল সত্তা, যা ক্রমবিবর্তনশীল। সমাজবিজ্ঞানে বিবর্তন, প্রগতি, উন্নয়ন এবং পরিবর্তন। এই প্রত্যয়গুলোকে প্রায় সমার্থক বলেই ধরা হয়। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা পরিবর্তন প্রত্যয়টাকে অধিকতর নিরপেক্ষ বলে বিবেচনা করেন। কার্ল মার্কস তাঁর একটা রচনায় বলেছেন ‘ঈযধহমব রং ঃযব ড়হষু ঁহপযধহমরহম ড়িৎফ’.

এই কথা দিয়েও কার্ল মার্কস বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক ক্রিয়ার অর্থই হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন কিংবা সেটাই সামাজিক বিবর্তনের পথ সৃষ্টি করে। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে দেখেছি সমাজ স্তরবিন্যাসের বিভিন্ন স্তরে গত প্রায় পাঁচ-ছয় দশক আমাদের উন্নয়নের প্রকৃতি এবং সংহতিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য অনেকই বাড়ছে। এসবের ‘ডেফিনেশন’ এবং ‘কনসেপ্ট’গুলোতেও একের সাথে অন্যের মতামতে সাংঘর্ষিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে অথবা করা হয়েছে। এখন আমরা সবকিছুর সংজ্ঞা এবং ব্যাখ্যা পড়ি ও দেখি কেবলমাত্র সমাজের প্রভাবশালী এবং শাসকশ্রেণির বর্ণনা থেকে। এর বাইরে যা কিছু ঘটে তার সবকিছুকেই অনেকেই আমরা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ নাম দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখি অথবা তার নেতিবাচক সমালোচনায় মুখর হই।

উল্লিখিত কথাগুলো অনেক জায়গায় ব্যক্তিগত কিছু রাজনৈতিক দেখা বা বিশ্লেষণ হলেও সেটা ব্যক্তিজীবনের বাইরে থেকে দেখা বা জানা কিন্তু না। নিজের জীবনে যা কিছু দেখেছি বিগত অর্ধশত বছর এবং যার মুখোমুখিও হয়েছি, তারই কিছু অংশ এখানে বললাম। আমার দেখার সাথে অন্য কারোর দেখার মিল হবে অথবা সেটা হতে হবে, এরকম কোনো দুঃসাহসিক চিন্তাই করি না। প্রত্যেক মানুষই আমরা আলাদা। একইসাথে একই পাঠশালায় পড়ে, একই বিষয় নিয়ে পড়লেও সেই বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিটা কিন্তু আমাদের আলাদাই। কেবল লক্ষ রাখার চেষ্টা করি, নিজের কোনো অভিমত বা চিন্তাকে কোনো অর্থেই যেন অন্যের ওপর চাপিয়ে না দিই। অভিজ্ঞতা শেয়ার করার অর্থ এটা না যে, কোনো চিন্তাকেই জোর করে বলা অথবা ‘আমি’ বা ‘আমরাই’ কেবল সঠিক, এরকমের কোনো বোকার স্বর্গে থাকা।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

মে ১৭, ২০২২

শেয়ার করুন