০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৬:১৯ অপরাহ্ন


দেশকে সৈয়দ আব্দুল হাদী
নিজস্ব গায়কী ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৯-২০২৫
নিজস্ব গায়কী ছাড়া শিল্পী হওয়া যায় না সৈয়দ আব্দুল হাদী


বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী। গান গেয়ে পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছেন নানা পুরস্কার। এ পুরস্কারপ্রাপ্তিতে কতটা সন্তুষ্ট? গান ছাড়া পেশাগত জীবনে আর কী করেছেন তিনি। এসব নিয়ে তিনি বলেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির

প্রশ্ন: আপনি বাংলা গানের এক সোনালি সময়ের অংশ ছিলেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কি মনে হয়, সংগীতে সেই গৌরব আজও টিকে আছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়। সংগীত এমন এক শিল্প, যার সঙ্গে সময়, সমাজ এবং দর্শকের রুচির সরাসরি সংযোগ। আমি বড় হয়েছি এমন এক সময়, যখন গান শুধু বিনোদনের মাধ্যম ছিল না, বরং ছিল এক ধরনের শিল্পচর্চা, আত্মপ্রকাশের মাধ্যম। সেই সময় আমাদের গান শিল্প হয়ে উঠত, শ্রোতাদের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলত। এখন সময় বদলেছে। এখন গান প্রথমেই বিনোদন হয়ে উঠেছে, তারপর শিল্প। কেউ যদি শিল্পভাবনায় না গিয়েও মানুষকে আনন্দ দিতে পারে, তাহলেও তাতে কেউ আপত্তি করছে না। কিন্তু আমার মনে হয়, গানের আত্মা হলো তার শিল্পমান,সুর, কথা, গায়কি-সবকিছুর মধ্যে একটা নিখুঁত ভারসাম্য থাকা দরকার। আজকাল অনেক ভালো গলা পাওয়া যায়, কিন্তু নিজস্ব গায়কি তৈরি হচ্ছে না। কেউ যেন কারো মতোই গাইছে। এটা বড় দুঃখের বিষয়।

প্রশ্ন: বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই নিজের লেখা, সুর, গাওয়া গান ইউটিউবে প্রকাশ করছে। আপনি কি মনে করেন, এতে করে গান হারাচ্ছে তার মূল রূপ?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: দেখুন, এটা যুগের দাবি। প্রতিটি যুগই তার উপযোগী একটি মাধ্যম তৈরি করে নেয়। আগে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো শিল্পীকে তৈরি করতো, লালন করতো। গানগুলো যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে শ্রোতার কাছে পৌঁছাতো। এখন প্রযুক্তি অনেক সহজলভ্য হয়ে গেছে। একজন মানুষ নিজের ঘরে বসে গান লিখে, সুর করে, গেয়ে ইউটিউবে ছাড়ছেন। এতে একটা স্বাধীনতা এসেছে, কিন্তু সেই স্বাধীনতার সঙ্গে দায়বদ্ধতা আসেনি।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো-এ প্রক্রিয়ায় কেউ কারো সঙ্গে যুক্ত নেই। সবাই এক-একটা দ্বীপ হয়ে গেছে। আগে যেমন একান্নবর্তী পরিবারে সবাই একসঙ্গে থাকতো, কাজ করতো, এখন তা নেই। গানেও তাই হচ্ছে। একটা গানের দল থাকতো-গীতিকার, সুরকার, গায়ক, তাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ছিল। এখন সেটা নেই বলেই কোয়ালিটি অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

প্রশ্ন: গান গেয়ে আপনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এই অর্জনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: প্রথম তিনটি পুরস্কার পেয়েছিলাম এমন গানগুলোর জন্য, যেগুলো আমার নিজেরও খুব প্রিয়। তাই তখনকার অনুভূতি ছিল নিখাদ আনন্দের। মনে হয়েছিল, হ্যাঁ, এটা সত্যিই আমার প্রাপ্য। কিন্তু শেষের দুইটি পুরস্কার এমন গান থেকে এসেছে, যেগুলো আমি নিজেই পুরস্কারযোগ্য বলে মনে করি না। আমার এমন অনেক গান রয়েছে, যেগুলোর জন্য আমাকে অন্তত দশবার পুরস্কৃত করা যেত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরস্কারেও লবিং, তদবির ঢুকে পড়েছে। লবিং করতে হলে হয় আপনার লোক থাকতে হবে, নয়তো নিজেকেই তদবির করতে হবে। এ দুইয়ের কোনোটাই আমার পছন্দ নয়। তাই হয়তো অনেক কিছুই পাইনি। তবে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, শ্রদ্ধা পেয়েছি। সেই ভালোবাসা যদি শ্রদ্ধাশীল হয়, তাহলেই আমার কাছে তা মূল্যবান। শুধু ভালোবাসা নয়, সেই ভালোবাসার সঙ্গে যদি শ্রদ্ধা না থাকে, তাহলে আমি সেটিও গ্রহণ করি না।

প্রশ্ন: আপনার পেশাগত জীবন শুরু হয়েছিল কী দিয়ে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: গানই ছিল আমার প্রথম ভালোবাসা, আর সেই ভালোবাসা থেকেই জীবন শুরু। তবে পাশাপাশি আমি জগন্নাথ কলেজে শিক্ষকতা করতাম। লেকচার দিতে দিতে গলার অবস্থা এমন হয়ে যেত যে, গান গাইতে কষ্ট হতো। শিক্ষকতা পেশা হিসেবে খুব সম্মানজনক, কিন্তু আমার গানের জন্য সেটি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। গানের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা ছিল প্রবল। তাই একসময় সিদ্ধান্ত নিতে হলো, কোনটা আমার আসল পরিচয়। আমি শিক্ষকতা ছেড়ে দিলাম, গানকে পুরোপুরি গ্রহণ করলাম।

প্রশ্ন: আপনি বিটিভিতে প্রযোজক হিসেবেও কাজ করেছেন। সে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: হ্যাঁ, তখন ছিল পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশন (পিটিসি)। শুরু হলো ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে, আমি জয়েন করলাম ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে। তখন প্রযোজক হওয়াটা সহজ ছিল না। কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড, শিক্ষা, রুচি- সবকিছুর একটা যাচাই-বাছাই হতো। আমার প্রযোজনায় প্রথম অনুষ্ঠান ছিল ‘স্টুডেন্টস প্রোগ্রাম’। আমি তখন ইউনিভার্সিটি থেকে সদ্য বের হয়েছি, তাই ছাত্রদের নিয়ে অনুষ্ঠান করার দায়িত্ব পেলাম। ‘ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড’ নাটকটি প্রযোজনা করেছিলাম, নাট্যরূপ দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। এছাড়া অনেক গানের অনুষ্ঠান করতাম। রওশন আরা মুস্তাফিজ, হাসিনা মমতাজদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেছিলাম। সুচন্দার প্রথম অভিনয়ও আমার প্রযোজিত একটি নাটকে।

প্রশ্ন: আপনি একবার বলেছিলেন, অফিসে যাওয়ার আগে নিয়মিত রেওয়াজ করতেন। এখন কি সে অভ্যাস বজায় আছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: না, এখন আর সেইভাবে নিয়মিত রেওয়াজ করা হয় না। আগেও প্রতিদিন রেওয়াজ করতাম, এমন না। তবে যেদিন রেকর্ডিং থাকত, অনুষ্ঠান থাকতো, সেদিন অবশ্যই রেওয়াজ করতাম। গলায় একটা প্রস্তুতি থাকা জরুরি। এখন বয়সের কারণে কিছুটা সীমাবদ্ধতা এসেছে। তবে মন তো এখনো আগের মতোই গান ভালোবাসে। রেওয়াজ হয়তো কম হয়, কিন্তু গান শোনা, গান নিয়ে ভাবনা-এসব থেকে সরে যাইনি।

প্রশ্ন: এখনকার শিল্পীদের মধ্যে আপনি কাদের কাজ ভালো মনে করেন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: অনেকেই ভালো করছেন। অনেকেই চেষ্টা করছেন নতুন কিছু করার, তা আমি স্বীকার করি। তবে আমি যেটা খুঁজি, সেটা হলো নিজস্বতা। একটা শিল্পীর কণ্ঠ শুনে যেন বোঝা যায়, এটা অমুকের কণ্ঠ-এই স্বাতন্ত্র্য খুব দরকার। আজকাল অনেকেই খুব ভালোভাবে গান গাইছে, কিন্তু শুনে আলাদা করে মনে থাকে না। কারণ তাদের মধ্যে ‘নিজস্ব গায়কী’ তৈরি হয়নি। আবার অনেক সময় অটো টিউনারের কারণে গানের সেই আবেগও হারিয়ে যায়।

প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, সংগীত একদিন আবার তার পুরোনো রূপে ফিরে আসবে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আমার একটা প্রিয় উক্তি আছে এই বিষয়ে। আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হবে? তিনি বলেছিলেন, জানি না। তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে লাঠিসোঁটা আর ইটপাটকেল দিয়ে। মানে সভ্যতা আবার শূন্য থেকে শুরু করবে। সংগীতও তাই। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একসময় নিশ্চয়ই সে তার শিকড়ে ফিরবে। আবার শিল্প ভাবনায় সমৃদ্ধ গান ফিরবে, হয়তো ভিন্নভাবে, নতুন মাধ্যমে। তবে কবে ফিরবে, সেটা বলা মুশকিল।

প্রশ্ন: আপনার শিল্পীজীবনে কোনো আক্ষেপ আছে?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: আক্ষেপ নয়, বরং একটা ভ্রুক্ষেপ আছে। আমি কখনো আত্মমর্যাদা বিকিয়ে কিছু করিনি। জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে আমি আমার আত্মমর্যাদাকেই দেখি। সেটাকে বিসর্জন দিয়ে কিছু অর্জন করবো-এমন চিন্তা কোনোদিনও করিনি। আমি যা পেয়েছি, সেটাই আমার পরম প্রাপ্তি। কিছু না পাওয়ার জন্য আফসোস নেই, বরং যে ভালোবাসা মানুষ আমাকে দিয়েছে, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার।

প্রশ্ন: আপনার মতে, আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের কী সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন?

সৈয়দ আব্দুল হাদী: তাদের দরকার একাগ্রতা, দায়িত্ববোধ, আর নিজের কণ্ঠের প্রতি বিশ্বস্ততা। প্রযুক্তি আছে, ভালো কথা, তবে সেটার ওপর নির্ভর করলে নিজের গলায় আত্মবিশ্বাস জন্মায় না। গানের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে, কথা সুর আবেগ-সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে এক করে নিতে হবে। গান শুধু শোনানোর জন্য নয়, উপলব্ধি করানোর জন্য। শিল্পী হতে গেলে নিজের ভেতরের শিল্পীকে প্রথমে জাগাতে হয়।

শেয়ার করুন