০২ অক্টোবর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৭:১৭ অপরাহ্ন


মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যেরও বিচার সম্ভব
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৯-২০২৫
মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যেরও বিচার সম্ভব চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম


চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, সশস্ত্র বাহিনীর কোনো সদস্য মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হবে। এ ধরনের অপরাধের বিচার কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালত বা দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে সম্ভব নয়। ১৪ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি। 

এদিন আশুলিয়ায় ছয় হত্যা মামলার প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্য শেষে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানতে চান, ডিফেন্সের (সশস্ত্র বাহিনী) উচ্চপদে যারা আছেন, তাদের বিচার এ ট্রাইব্যুনালে হবে, নাকি অন্য আদালতে হবে? জবাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, ১৯৭৩-এর বিভিন্ন ধারা-উপধারা তুলে ধরে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘এই বিতর্ক অহেতুক ও অপ্রাসঙ্গিক। মূলত আইনটি তৈরিই করা হয়েছিল এ অপরাধে যুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্য। এর মধ্যে সম্প্রতি আইনটি সংশোধন করে আরো কিছু উপাদান যুক্ত করা হয়েছে।’ এ পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘আমরা রায়ের সময় এটা উল্লেখ করে দেবো।’ 

পরে ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ট্রাইব্যুনাল নানা বিষয় জানার জন্য প্রশ্ন করতেই পারেন। তবে এটা জাজমেন্টের মধ্যে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, এ আইন এতোটাই স্পষ্ট, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। আইনের প্রতিটি ধারা-উপধারায় স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, এ আইন আর্মড ও অক্সিলিয়ারি ফোর্সের (সশস্ত্র ও সহযোগী বাহিনীর) বিচারের জন্য। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী, যেমন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন অংশ এদের মাধ্যমে সংঘটিত ওয়াইড স্প্রেড (বিস্তৃত পরিসরে) এবং সিস্টেমেটিক (পদ্ধতিগত) সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার একমাত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনেই হতে পারে, অন্য কোথাও নয়। সেটা (মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার) কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালতে নয়, বাংলাদেশে প্রচলিত যেসব ফৌজদারি আদালত রয়েছে, সেখানেও এটা করা সম্ভব নয়। এ আইনটি খুবই সুস্পষ্ট।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি ও ১০ মে দুটি আলাদা অধ্যাদেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা হয়েছে। এই সংশোধনীর ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কোনো অভ্যন্তরীণ সামরিক আদালতে কিংবা দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে সম্ভব নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই হতে পারবে।

আশুলিয়ার মামলা সূচনা বক্তব্যে

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, গত বছর ৫ আগস্ট ঢাকার আশুলিয়া থানার সামনে গুলি চালিয়ে ছাত্র-জনতাকে হতাহত করার পর জীবিত ও মৃতদের লাশ পুলিশ ভ্যানে পোড়ানো হয়েছিল শুধু আলামত ধ্বংস বা অন্যদের ওপর দায় চাপানোর জন্য। তদন্তে পাওয়া গেছে, আগুনের তীব্রতা বাড়াতে জলন্ত লাশের ওপর আসামিরা শুকনো কাঠের টুকরা নিক্ষেপ করে। একজন আসামি তার হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট ওই আগুনে নিক্ষেপ করে। 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীর লাশ পোড়ানোর ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে-২ গত ১৪ সেপ্টেম্বর রোববার সূচনা বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। এর মাধ্যমে মামলাটির আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো। গত সোমবার মামলার প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। 

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অপরাধগুলো ছিল পূর্বপরিকল্পিত, পদ্ধতিগত ও ব্যাপকমাত্রায় সংগঠিত। উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের কণ্ঠরোধ করা, ভয় সৃষ্টি করা এবং জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খাকে দমন করা। এসব অপরাধ শুধু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি জাতির স্বপ্ন ও অস্তিত্বের ওপর আঘাত হেনেছে। 

তিনি বলেন, আশুলিয়া থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ২৯ জনকে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শিশুসহ বহু মানুষকে গুরুতর আহত করা হয়। চরম অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে পাঁচটি লাশ এবং একজন জীবিত ও গুরুতর আহত ব্যক্তিকে পুলিশ ভ্যানে উঠিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। 

এদিন সূচনা বক্তব্যে বলা হয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি, বেআইনি আটক ও নিপীড়নমূলক গ্রেফতার, নির্যাতন, অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর ধ্বংসের যে কফিন ফ্যাসিস্ট সরকার প্রস্তুত করেছিল, তার শেষ পেরেকটি মেরে দেয় গত বছর ৫ আগস্ট। 

ফ্যাসিস্টদের পরিণতি-প্রেক্ষিত জুলাই বিপ্লব

চিফ প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, বিশ্বের দেশে দেশে ফ্যাসিস্টদের জন্ম হয়েছে। অ্যাডলফ হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, পিনোশে, মার্কোসের নাম শুনেছি। এসব ফ্যাসিস্ট এবং হিটলারদের স্বৈরশাসকদের অনেকেই বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। এ ফ্যাসিস্টদের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন শেখ হাসিনা। আমরা তার দোসরদের বিরুদ্ধেই এই ট্রাইব্যুনালের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি।

তিনি বলেন, নীলনকশার নির্বাচন, লাইলাতুল ইলেকশন আর আমি-ডামির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে ধরে গত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলার মাটিতে খুন, গুম, রাজনৈতিক নিপীড়নের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল তার চির অবসানের প্রয়োজনে একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ বিচার জাতির ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকুক এবং দেশে এমন এক দৃষ্টান্ত হোক যাতে ভবিষ্যতে কেউ মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে না পারে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশে দেখেছি স্বৈরাচার পালিয়েই শুধু যায়নি, তার ৩০০ এমপি, তার মন্ত্রিসভা, পুলিশ বাহিনী, দলীয় নেতাকর্মী এমনকি মসজিদের ইমাম এবং নিজেদের শপথবন্ধ রাজনীতিবিদ বলে দাবি করা উচ্চ আদালতের বিচারকরাও পালিয়েছেন।

তিনি বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে এই ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপিত প্রমাণগুলো অস্পষ্ট তথ্যের বিচ্ছিন্ন টুকরা নয়। বরং একটি অবিচ্ছিন্ন ও সুদৃঢ় প্রমাণশৃঙ্খল। যার প্রতিটি অংশ পরবর্তী অংশকে আরো দৃঢ়তর করে। এ প্রমাণের সামগ্রিকতা হচ্ছে, চাক্ষুষ সাক্ষ্য, ডিজিটাল রেকর্ড, সরকারি যোগাযোগ ও ফরেনসিক প্রতিবেদন।

এ মামলায় মোট আসামি ১৬। তাদের মধ্যে আট আসামি গ্রেফতার আছেন। তারা হলেন সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক ও সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। সাবেক এমপি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামসহ এ মামলার আট আসামি পলাতক।

শেয়ার করুন