সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন নাগরিক অধিকার আইনজীবী প্যাট্রিসিয়া শ্নেল
যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম শিক্ষার্থীরা তাদের অমুসলিম সহপাঠীদের তুলনায় দ্বিগুণ হারে বুলিং বা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এমনই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (কেয়ার) পরিচালিত এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায়। ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলগুলোতে পড়ুয়া মুসলিম শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ নিয়মিতভাবে হয়রানি, অপমান, এমনকি শিক্ষকদের নেতিবাচক আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে। সমীক্ষাটি ২০১৪ সালে পরিচালিত হয়েছিল এবং এতে ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৬০০-এরও বেশি মুসলিম আমেরিকান শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। গত ১২ বছর ধরে প্রতি দুই বছর অন্তর স্টেটব্যাপী মুসলিম শিক্ষার্থীদের ওপর বুলিং সম্পর্কিত সমীক্ষা পরিচালনা করছে। এই দীর্ঘমেয়াদি গবেষণায় দেখা গেছে, ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সী মুসলিম শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪০ থেকে ৫৫ শতাংশ নিয়মিতভাবে বুলিং বা হয়রানির শিকার হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা তাদের শ্রেণিকক্ষে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, অনলাইনে হয়রানি, হিজাব পরার কারণে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, ধর্মীয় সুবিধা চাওয়ার পর বৈষম্যমূলক আচরণ-এমনকি ৯/১১ হামলার পর থেকে বাড়তি নজরদারি এসব অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছে।
সান দিয়েগো অফিসের নির্বাহী পরিচালক হানিফ মোহেবি বলেন, ‘আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য কাজ করা এখন সবচেয়ে জরুরি। যদি আমরা তাদের পাশে না দাঁড়াই, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। সমীক্ষায় দেখা যায়, ক্যালিফোর্নিয়ার ২৩টি কাউন্টির মধ্যে সান দিয়েগো কাউন্টি থেকে প্রায় ১৭০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। সমীক্ষাটি মূলত সরকারি ও বেসরকারি (অমুসলিম) স্কুলে অধ্যয়নরত মুসলিম শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিচালিত হয়েছিল।
ফলাফল অনুযায়ী, ৫৫ শতাংশ মুসলিম শিক্ষার্থী জানিয়েছে তারা কখনো না কখনো বুলিং বা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এ সংখ্যা জাতীয় গড়ের তুলনায় দ্বিগুণ। ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী যারা হিজাব পড়েন, তারা জানিয়েছেন যে তাদের হিজাব টেনে ধরা বা অশোভনভাবে স্পর্শ করা হয়েছে। এছাড়া ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তারা স্কুলের কর্মচারী বা শিক্ষকের কাছ থেকেও বৈষম্যমূলক আচরণের মুখোমুখি হয়েছে। যদিও ৭৬ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তারা ইসলাম বা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ নিয়ে শ্রেণিকক্ষের আলোচনায় অংশ নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তবুও এ সংখ্যা ২০১২ সালের তুলনায় ৪ শতাংশ কম। এক শিক্ষার্থী প্রতিবেদনে বলেন, আমাদের অস্তিত্বকেই বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
ধর্মীয় নেতারা বলছেন, গত ১৫ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বেড়েছে, বিশেষ করে ‘রেডিক্যাল ইসলাম’-এর ধারণা ছড়িয়ে পড়ায় সব মুসলিমকে সন্দেহের চোখে দেখার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। মোহেবি সতর্ক করে বলেন, এটা বিপজ্জনক প্রবণতা। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
সান ডিয়েগো ইউনিফায়েড স্কুল ডিস্ট্রিক্টের অ্যান্টি-বুলিং প্রোগ্রাম সংক্রান্ত কর্মকর্তারা এখনো প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করেননি। জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ বা অন্য কোনো কারণে বৈষম্য বা হয়রানি করা নিষিদ্ধ এবং কেউ এমন ঘটনা দেখলে তাৎক্ষণিকভাবে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক। সান দিয়েগোর ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক ও ইমাম তাহা হাসান জানান, তার চার মেয়েই সরকারি স্কুলে পড়ে এবং তারা প্রায়ই ক্লাসে ইসলাম নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য শোনার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। তিনি বলেন, আমি আমার সন্তানদের বলি, এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সহপাঠীদের ইসলাম সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে যাতে ভুল ধারণা ভাঙে। তাহা হাসান আরো বলেন, বুলিংয়ের ঘটনা অনেক সময় অব্যাহত থাকে কারণ অভিভাবকরা স্কুল প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করতে দ্বিধাবোধ করেন। আমাদের অনেক সদস্য অভিবাসী। তারা এমন সংস্কৃতি থেকে এসেছেন যেখানে অভিযোগ করা বা প্রশাসনের কাছে যাওয়া সাধারণ নয়। মোহেবি জানান, স্কুলে মুসলিম শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বুলিংয়ের ঘটনার পর্যাপ্ত রেকর্ড না থাকায় কেয়ার এই সমীক্ষা চালু করেছিল।
সংস্থাটি প্রথম সমীক্ষা চালায় ২০১২ সালে, যেখানে প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী জানিয়েছিল তারা ধর্মের কারণে লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এ সমীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় সহনশীলতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকে নতুনভাবে সামনে এনেছে। মুসলিম শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে।