২৫ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ০৯:৫৯:০০ অপরাহ্ন


‘নো কিংস’ আন্দোলনে ৭০ লাখ মানুষের অংশগ্রহণ
ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে উত্তাল আমেরিকা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১০-২০২৫
ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে উত্তাল আমেরিকা ‘নো কিংস’ আন্দোলনে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ


যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের বিরুদ্ধে ১৮ অক্টোবর এক ঐতিহাসিক গণআন্দোলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘নো কিংস’ নামের এই আন্দোলনে আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ২ হাজার ৭০০টিরও বেশি শহরে প্রায় ৩ হাজার ৬০০টি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিবাদ। শুধু বড় শহর নয়, ছোট শহরগুলোতেও সমানতালে মানুষ রাস্তায় নামে। আন্দোলনকারীদের মূল বার্তা ছিল: ‘আমরা রাজতন্ত্র চাই না- প্রেসিডেন্ট রাজা নন।’ যুক্তরাষ্ট্র একটি গণতান্ত্রিক দেশ, এখানে কোনো স্বৈরশাসকের স্থান নেই।

বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহার, কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে একক সিদ্ধান্ত নেওয়া, রাজ্য সরকারের মত উপেক্ষা করে জাতীয় গার্ড মোতায়েন, বিচার বিভাগসহ অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ক্ষত্নু করা-এসব পদক্ষেপকে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বলে দেখছেন। তাদের মতে, ট্রাম্প একজন নির্বাচিত নেতা হলেও, তার আচরণ একজন একনায়কের মতো, যিনি নিজেকে জনগণের সেবক নয়, শাসক মনে করেন। ‘নো কিংস’ স্লোগানটি তাই প্রতীকী নয়, বরং স্পষ্ট বার্তা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জনগণের কর্মচারী, রাজার মতো সর্বময় ক্ষমতাধারী কেউ নন।

এই আন্দোলনের পেছনে আরেকটি বড় কারণ ছিল মার্কিন ফেডারেল সরকারের চলমান অচলাবস্থা। বাজেট বিল নিয়ে ডেমোক্র‍্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে চরম মতবিরোধের কারণে সরকার কার্যত বন্ধ রয়েছে, ফলে হাজার হাজার সরকারি কর্মচারী বেতন ছাড়া বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বিক্ষোভকারীরা এই অচলাবস্থাকেও ট্রাম্প প্রশাসনের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন কারণ রাজনৈতিক সমঝোতার চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্য তাদের ।

নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, ওয়াশিংটন ডিসির পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউ, লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, আটলান্টা ও অস্টিনসহ সব শহরেই মানুষের ঢল নামে। নিউইয়র্কে কয়েক কিলোমিটারব্যাপী বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীরা স্লোগান দেন : সংবিধান বিকল্প নয়, গণতন্ত্র ফেরত দাও, আমরা রাজা চাই না। অনেকেই মার্কিন পতাকা উল্টো ধরে ছিলেন, যা সংকটের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লস অ্যাঞ্জেলেসে বিক্ষোভ যেন এক উৎসবে রূপ নেয়। ইউনিকর্ন, কুকি মনস্টার, ডাইনোসর বা ব্যাঙের পোশাকে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। শহরের মেয়র ক্যারেন ব্যাস বলেন, আমরা জানি ট্রাম্প রাজা নন, কিন্তু আমরা দেখছি কিভাবে আমাদের গণতন্ত্র একনায়কতন্ত্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তিনি জানান, ট্রাম্প প্রশাসন এ বছর শুরুর দিকে গভর্নরের অনুমতি ছাড়াই শহরে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করে। ১৯৬৫ সালের পর প্রেসিডেন্ট কর্তৃক স্টেটে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের প্রথম ঘটনা এবার।

ওয়াশিংটন ডিসিতে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বহু বর্তমান ও প্রাক্তন ফেডারেল কর্মচারী। সরকারি বন্ধের কারণে বেতনহীন অবস্থায় থাকা কর্মীরা বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ‘দানবায়িত’ করেছে। মনিকা নামে এক কর্মী বলেন, সরকারি চাকরি বহু আফ্রিকান-আমেরিকানকে মধ্যবিত্তে উন্নীত করেছে, কিন্তু এখন সেই সুযোগটুকুও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এক তরুণী বিক্ষোভকারী বলেন, তিনি আমাদের গণতন্ত্র টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলছেন। আমরা যদি চুপ করে থাকি, তাহলে এর পরিণাম ভয়াবহ হবে। শিকাগোতে হাজার হাজার মানুষ ‘হ্যান্ডস অব শিকাগো’ প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নামে। আইসের অভিবাসন অভিযান, স্বাস্থ্যসেবা খাতে বাজেট কমানো এবং সামরিক উপস্থিতির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানায়। লস অ্যাঞ্জেলেসে দেখা গেছে ওয়ান পিস নামক জাপানি মাঙ্গা সিরিজের একটি পতাকা, যা আজকাল তরুণদের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

অস্টিন, টেক্সাসে স্টেট ক্যাপিটলের সামনে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ জড়ো হয়। চার্লট, সান ডিয়াগো, আটলান্টার মতো শহরগুলোতেও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ হয় এবং পুলিশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। যদিও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটে: সাউথ ক্যারোলিনার মার্টল বিচে এক নারী গাড়ি চালিয়ে অস্ত্র প্রদর্শন করেন; ম্যারিয়েটা, জর্জিয়ায় এক ব্যক্তি এক প্রতিবাদকারীর পতাকা কেড়ে নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান। আন্দোলন আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি করে। ইউরোপের বার্লিন, রোম, মাদ্রিদ এবং লন্ডনে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ হয়। লন্ডনে মার্কিন দূতাবাসের সামনে শত শত মানুষ জড়ো হন। টরন্টোতে দেখা যায় ‘হ্যান্ডস অব কানাডা’ লেখা ব্যানার।

আন্দোলনের জবাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি রাজা নই, আমি একজন প্রেসিডেন্ট। আমি দেশকে পুনর্গঠনের কাজ করছি।’ তিনি দাবি করেন, তার কড়া নীতিমালাই দেশকে নিরাপদ ও সংগঠিত করছে, আর যারা রাস্তায় নেমেছে তারা ভুল তথ্য বা চরম বামপন্থী গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত। তবে বিশ্লষকদের মতে, জনগণের এ প্রতিবাদ মার্কিন গণতন্ত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে এবং বাইরে লাখ লাখ মানুষ আজ বলছে, তারা কোনো একনায়ক মানে না, তারা চায় একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, সংবিধানসম্মত রাষ্ট্রযন্ত্র। নো কিংস আন্দোলন কেবল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নয়, এটি এক প্রজন্মের চেতনার বিস্ফোরণ এটি যেখানে জনগণ বলছে, আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি, এবং সেটিকে স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতেই আমরা রাস্তায় নেমেছি।

শেয়ার করুন