আহসান নাসিবের সঙ্গে নওরীন নাহার তুলি
ক্রিসমাস ডে ২০২৩-এ নিজের গর্ভবতী স্ত্রী নওরীন তুলিকে গলা চেপে হত্যা করার অভিযোগে ৩৫ বছর বয়সী স্বামী নাসিব আহসানকে টেক্সাসের কলিন কাউন্টি ২১৯তম জুডিশিয়াল জেলা আদালতের বিচারক জেনিফার এডজওর্থ সম্প্রতি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। নওরীন তুলি ছিলেন একজন মডেল ও সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে ফ্যাশন, লাইফস্টাইল এবং বিউটি সম্পর্কিত কনটেন্ট শেয়ার করতেন। কলিন কাউন্টি ক্রিমিনাল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি গ্রেগ উইলিস এই হত্যাকাণ্ডকে ‘একটি নির্মম, পূর্বপরিকল্পিত পারিবারিক সহিংসতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, হত্যাকান্ডটি নিজের গর্ভবতী স্ত্রী এবং তার গর্ভে থাকা সন্তানের জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে। আমাদের টিম নিশ্চিত করেছে যে সে আর কখনো কোনো মহিলাকে ক্ষতি করতে পারবে না। এই যাবজ্জীবন সাজা আমাদের প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো, দুর্বলদের সুরক্ষা এবং পরিবারের ওপর মামলা চাপানো ছাড়াই ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করা।
পুলিশ জানায়, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ দুপুর ১টার দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে নওরীন মৃত অবস্থায় ছিলেন এবং গলার চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। আহসান ফোনে পরিবারের সদস্যদের স্বীকার করেন যে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে বিবাদ করে হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছেন। পরিবারের সদস্যরা তখনই ৯১১-এ কল করে পুলিশকে জানান। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে নওরীনকে বেডে মৃত অবস্থায় পান এবং নাসিবকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করেন।
প্রসিকিউটররা উল্লেখ করেছেন, নিহত নওরীন কয়েক মাসের গর্ভবতী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের দুই মাস আগে আহসানকে গর্ভবতী ব্যক্তির ওপর সহিংসতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যদিও নওরীন পুলিশকে বলেছিলেন তিনি তাকে গ্রেফতার করতে চান না, পুলিশ আইন অনুযায়ী তাকে গ্রেফতার করেছিল। নাসিব আহসানকে দেওয়া যাবজ্জীবন রায়, অর্থাৎ বাকি জীবন সাধারণত টেক্সাসের কারাগারে কাটাতে হবে। যেহেতু রায় ‘লাইফ উইদাউট প্যারোল’ নয়, তাই ৩০ বছর কারাভোগের পর তিনি প্যারোল বা শর্তসাপেক্ষ মুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন, যদি বিচারক তা গ্রহণ করেন। তবে যদি রায় ‘লাইফ উইদাউট প্যারোল’ হতো, তাহলে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা থাকতো না।
ঘটনার বিবরণ
ঘটনার পর নওরীনের বড় ভাই ঢাকা থেকে সাব্বির আহমেদ সজল দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, ‘আমার বোন নওরীন নাহার তুলি আমাদের সবার ছোট। তাকে আমরা সবাই আদর করতাম। কিন্তু তার কপালে সত্যিই সুখ ছিল না। নওরীন খুব মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তিনি পড়াশোনা শেষ করে ঢাকার বিআইটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। প্রায় ১৫ বছর তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে মহৎ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
২০১৬ সালে পারিবারিকভাবে তার প্রথম বিয়ে হয় আকিব খন্দকার রাফির সঙ্গে। রাফির বাবা-মা তখন আমেরিকায় থাকতেন এবং তাদের গ্রিন কার্ড ছিল। এক সময় আমরা তাদের দাদার বাড়িতে ভাড়া থাকতাম। সেই সূত্রেই আমাদের পরিচয়। পূর্ব পরিচিতির ভিত্তিতে আকিবের বাবা-মা পারিবারিকভাবে তার ছেলের জন্য আমার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন, আমরা রাজি হয়ে যাই।
বিয়ের কয়েক মাস পর ২০১৭ সালে আকিব স্টুডেন্ট ভিসায় আমেরিকায় চলে যান। তার বাবা-মা যে টেক্সাসে থাকতেন সেখানে। আমার বোন তখনো শিক্ষকতা করছিলেন। এরই মধ্যে তিনি আমেরিকায় ভিসার জন্য চেষ্টা শুরু করেন এবং ২০২২ সালে ভিসা পান। সব কিছু গুছিয়ে ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নওরীন আমেরিকায় চলে যান এবং স্বামীর বাসায় ওঠেন। সেখানে তাদের মধ্যে বনিবনা হয়নি এবং নানা বিষয়ে ঝগড়া হতো। এক পর্যায়ে আকিব আমার বোনকে ডিভোর্স দেন।
আমেরিকায় আসার কয়েকদিনের মধ্যেই নওরীন একটি স্কুলে চাকরি পান, পাশাপাশি ওয়ালমার্টেও পার্টটাইম কাজ করতেন। আকিবের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি আলাদা থাকতেন। এরই মধ্যে অনলাইনে আরেক বাংলাদেশি, আহসান নাসিবের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সম্পর্কটি গভীর হয় এবং এক পর্যায়ে নাসিবের বাবা-মা ঢাকার আমাদের বাসায় বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে আসেন। আমরা তুলিকে বলেছিলাম আরো সময় নিতে, কিন্তু সে নাসিবকে বিয়ে করতে চাইল। ২০২৩ সালের জুনে তাদের বিয়ে হয়।
বিয়ের দুই মাস তাদের সংসারে ভালোই চলছিল। কিন্তু দুই মাস যেতে না যেতেই নাসিব তুলি নির্যাতন শুরু করেন। তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেন, এমনকি ফোন করলেও সন্দেহ করতেন। নাসিব তুলি কারো সঙ্গে মিশতে দিতেন না। যদিও আমার বোন সবকিছু আমাকে বলতেন না, আমি অন্যদের কাছ থেকে জানতাম। কখনো কখনো আহসান ভয়ংকর হয়ে উঠতেন, যা আমার অন্য বোনেরা আমাকে জানিয়েছে।
আমার বোন তুলিকে নাসিব যখন গলাটিপে হত্যা করেন, তার আগের দিন তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। বাড়ির সিঁড়িতে নাসিব যখন তুলির ওপর নির্যাতন করছিলেন, পাশের একজন তা দেখে পুলিশে কল করেন। পুলিশ এসে নাসিবকে গ্রেফতার করেন। একদিন পর তিনি ৬ হাজার ডলারের বন্ডে বের হন এবং কোর্ট নির্দেশ দেয় নাসিব যেন আমার বোনের কাছে না আসে। কিন্তু তিন দিন পর নাসিব সেই নির্দেশ অমান্য করে আবারও বাসায় গিয়ে ২৭ ডিসেম্বর রাতে নওরীনের গলাটিকে হত্যা করেন।
উল্লেখ্য, নওরীন নাহার তুলির দেশের বাড়ি বরিশালে, বর্তমানের তাদের বাসা ঢাকার যাত্রাবাড়ী। তার তিন বোন এবং এক ভাই রয়েছে। অন্যদিকে আহসান নাসিবের দেশের বাড়ি টাঙ্গাইলে।