মামদানির সমর্থনে অনুষ্ঠিত সমাবেশ বিশাল জনসমুদে বক্তব্য রাখছেন জোহরান মামদানি
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলীয় পদপ্রার্থী জোহরান মামদানি গত ২৬ অক্টোবর কুইন্সের ফরেস্ট হিলস স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বিশাল সমর্থক সমাবেশে তার শক্তিশালী অবস্থান প্রদর্শন করেছেন। নিউইয়র্ক ইজ নট ফর সেল শীর্ষক এই সমাবেশে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ অংশ নেন। সমাবেশে সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স এবং কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও কর্টেজ উপস্থিত ছিলেন এবং মামদানিকে সমর্থন জানিয়েছেন। এছাড়া নিউইয়র্কের গভর্নর ক্যাথি হোচুলও প্রথমবারের মতো র্যালিতে অংশ নিয়ে মামদানির জন্য ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। তার এই আহ্বান প্রগতিশীল এবং মধ্যপন্থী ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সংহতি সৃষ্টি করার চোর অংশ হিসেবে দেখা যায়। মামদানি তার ভাষণে সিটির নাগরিকদের জন্য সাশ্রয়ী বাসস্থান, বিনামূল্যে শিশুসেবা এবং রেন্ট ফ্রিজের মতো নীতি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি ধনী ও করপোরেটদের ওপর কর বৃদ্ধি করার পরিকল্পনাও ঘোষণা করেন। এই র্যালি এবং মামদানির সমর্থকরা দেখিয়েছে যে নিউইয়র্কের প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি কেবল আলাদা আন্দোলন নয়, বরং প্রধান ধারা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করছে।
সমাবেশে মামদানিকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন নিউইয়র্ক সিটি কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার, শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে এসইআইইউ প্রেসিডেন্ট এপ্রিল ভারেট, পিএসসি-কিউনির আর্তুরো এন্নামোরাডো, ৩২বিজে-এর ক্ল্যারিসা বেইনেস এবং সিআর সিইউর ডা. অ্যালেক্স গ্রাফ। এছাড়াও ১১৯৯ সিইউর ডেবি ফিউয়ারম্যান, ইউএডব্লিউ রিজিয়ন ৯এ-এর জাজিব উদ্দিন, ডিসি ৩৭-এর জুন লেই, স্টারবাকস ওয়ার্কার্স ইউনাইটেডের কাই ফ্রিটজ এবং এইচটিসির কার্টিস বড্ডি শ্রমিক অধিকার ও সংগঠনের ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। রাজনৈতিক এবং সমাজসেবামূলক নেতাদের মধ্যে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর জুলিয়া সালাজার, অ্যাসেম্বলি সদস্য ক্লেয়ার ভালদেজ, মার্সেলা মিতায়নেস, সারাহানা শ্রেষ্ঠা এবং এমিলি গ্যালাঘার, সিটি কাউন্সিল সদস্য আলেক্সা আভিলেস ও টিফানি কাবান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ইমাম খালিদ লতিফ, রাবি শারন ক্লেইনবাম এবং রেভারেন্ড চার্লস গালব্রেথ শান্তি, সম্প্রদায় ও নৈতিক দিক থেকে সমাজকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাংস্কৃতিক ও সংগীত ক্ষেত্রে রেড বারাত, স্টেফানি প্যাচেকো এবং আর্তুরো এন্নামোরাডো সমাজের সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে। এই নেতৃবৃন্দ একত্রে রাজনৈতিক, শ্রমিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিউইয়র্ককে সমন্বিত ও শক্তিশালীভাবে পরিচালনার জন্য অবদান রাখছেন।
নিউইয়র্কের ফরেস্ট হিলস স্টেডিয়াম যেন সেদিন এক রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্মক্ষণের সাক্ষী ছিল। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে শরতের সন্ধ্যা, স্টেডিয়ামের প্রতিটি সিট পূর্ণ, উচ্ছ্বসিত মানুষের ঢল চারদিকে। অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিল এই র্যালিতে, যেখানে মূল মঞ্চে একসঙ্গে দাঁড়ালেন আমেরিকার প্রগ্রেসিভ রাজনীতির তিন প্রজন্মের প্রতীক-সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ, এবং নিউইয়র্ক সিটির মেয়র প্রার্থী অ্যাসেম্বলিম্যান জোহরান মামদানি। অনুষ্ঠানটির নামই যেন সময়ের দাবি ঘোষণা করল-নিউইয়র্ক ইজ নট ফর সেল। এই সমাবেশটি ছিল শুধু একটি প্রচার র্যালি নয়, বরং আমেরিকান শহর রাজনীতিতে এক নতুন যুগের সূচনা চিহ্নিত করা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। ভোটের দিন তখন মাত্র আট দিন দূরে, আর নিউইয়র্ক জুড়ে শুরু হয়েছে রেকর্ড সংখ্যক আগাম ভোট। জোহরান মামদানি যিনি কেবল কয়েক বছর আগেও ছিলেন কুইন্সের এক তরুণ সংগঠক ও প্রগ্রেসিভ আন্দোলনের মুখ এখন মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে নিউইয়র্ক সিটির ভবিষ্যৎ রাজনীতির কেন্দ্রে।
ফরেস্ট হিলসের এই বিশাল সমাবেশটির আবহ ছিল একেবারে উৎসবমুখর। মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণীদের হাতে ছিল ফ্রিজ দ্য রেন্ট, মেক বাসেস ফ্রি, ইউনিভার্সাল চাইল্ডকেয়ার নাউ! লেখা প্ল্যাকার্ড। স্টেডিয়ামজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল নট মি, আস সেই বার্নি স্যান্ডার্সের বিখ্যাত স্লোগান, যা এখন মামদানির প্রচারণার মূলমন্ত্র। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেত্রী সারাহ শারম্যান, যিনি শুরুতেই মজার ছলে বললেন, আজ নিউইয়র্কে টাকার রাজনীতি নয়, মানুষের রাজনীতি জয়ী হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্ক রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রায় অর্ধেকই। গভর্নর ক্যাথি হোচুল, অ্যাসেম্বলি স্পিকার কার্ল হেস্টি, এবং স্টেট সেনেটের মেজরিটি লিডার আন্দ্রেয়া স্টুয়ার্ট-কাজিনস। এমন এক মুহূর্ত, যখন স্টেট ও সিটি নেতৃত্ব একত্রে একটি প্রগ্রেসিভ প্রার্থীকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, সাম্প্রতিক নিউইয়র্ক রাজনীতিতে বিরল দৃশ্য।
গভর্নর হোচুল তার বক্তব্যে বললেন, আমি শুধু একজন গভর্নর নই, আমি নিউইয়র্কের প্রথম মা গভর্নর। তাই জানি চাইল্ডকেয়ার কেবল নীতি নয়, এটি এক জরুরি প্রয়োজন। জোহরান মামদানি সেই নেতা, যিনি নিউইয়র্কের প্রতিটি পরিবারকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারেন। তার এই উক্তি শুনে দর্শকরা করতালিতে ফেটে পড়ে।
অ্যাসেম্বলি স্পিকার কার্ল হেস্টি বলেন, আমাদের শহরের রাজনীতি বহু বছর ধরে কয়েকজন প্রভাবশালী করপোরেট দাতার হাতে বন্দি ছিল। আজ আমরা দেখছি, সেই দেওয়াল ভেঙে একজন তরুণ মুসলিম প্রার্থী মানুষের স্বপ্নকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। জোহরানই সেই নেতৃত্ব, যিনি সিটি হলকে আবার মানুষের কণ্ঠে ফিরিয়ে দেবেন।
এরপর মঞ্চে আসেন সেনেট মেজরিটি লিডার আন্দ্রেয়া স্টুয়ার্ট-কাজিনস। তার কণ্ঠে দৃঢ়তা: কখনো ভাববেন না যে আপনার ভোটের কোনো মূল্য নেই। আজ থেকে ঠিক আট দিন পর, নিউইয়র্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে আপনার হাতের সেই এক ভোট।
তারপর স্টেডিয়াম উত্তাল হয়ে ওঠে বার্নি স্যান্ডার্সের প্রবল উপস্থিতিতে। তার কণ্ঠ যেন এখনো সেই একই আগুনে ভরা যা এক দশক আগে মার্কিন রাজনীতিতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছিল। বার্নি বলেন, আমাদের প্রতিপক্ষের আছে অর্থ, মিডিয়া এবং বিলিয়নিয়ার দাতাদের প্রভাব। কিন্তু আমাদের আছে মানুষ। আপনি যদি মনে করেন আমরা পাঁচ পয়েন্ট এগিয়ে আছি, তাহলে আপনি ইতিমধ্যেই হেরে গেছেন। মনে রাখবেন আমরা কেবল জিততে নয়, একটি শহরের আত্মা পুনরুদ্ধার করতে লড়ছি।
আসেন আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ। তার বক্তৃতা ছিল এক আবেগঘন ও দার্শনিক আহ্বান। তিনি বলেন, আমাদের শহর প্রতিদিন স্বাধীনতার প্রতীক মূর্তিকে দেখিয়ে বলে যে এটাই আমেরিকার চেতনা। কিন্তু স্বাধীনতা বিক্রি করা যায় না, কেনা যায় না। আজ আমরা সেই স্বাধীনতাকেই রক্ষা করতে দাঁড়িয়েছি।
সবশেষে স্টেডিয়াম আলোয় ভরে ওঠে, এবং স্লোগানে স্লোগানে জোহরান মামদানি মঞ্চে ওঠেন। মুহূর্তটি ছিল এমন, যেন এক তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি পুরো শহরের আশা-ভরসা বহন করে মঞ্চে দাঁড়িয়েছে। তার প্রথম বাক্যেই দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যখন আমরা এই প্রচারণা শুরু করেছিলাম এক বছর আগে, কোনো টেলিভিশন ক্যামেরা ছিল না, কোনো সমর্থন ছিল না। আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একটাই কথা বলতে চাই-নিউইয়র্ক বিক্রির জন্য নয়।
মামদানি তার বক্তৃতায় নিজের যাত্রাপথের কথা বলেন। কিভাবে তিনি একসময় কুইন্সের মুসলিম ও অভিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছিলেন রাজনীতি কেবল ক্ষমতার জন্য নয়, এটি মানুষের মর্যাদা ফেরানোর সংগ্রাম। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন তার ২০২১ সালের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সঙ্গে করা ১৫ দিনের অনশন আন্দোলনের কথা, যা ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ঋতমুক্তি এনে দিয়েছিল শ্রমজীবী ট্যাক্সি চালকদের জন্য। সেদিন যেমন আমরা জিতেছিলাম, নির্বাচনেও আমরা জিতবো, কারণ নিউইয়র্কের আত্মা এখনো বিক্রি হয়নি। এরপর তিনি তার নীতিগত প্রতিশ্রুতিগুলো স্পভাবে তুলে ধরেন। আমরা ভাড়াটিয়াদের জন্য ভাড়া স্থগিত করব, প্রতিটি বাসকে বিনামূল্যে করবো এবং নিউইয়র্কে সর্বজনীন চাইল্ডকেয়ার নিশ্চিত করবো। কীভাবে? ধনীদের ওপর কর বাড়িয়ে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের কাজ মানুষের জীবনকে সহজ করা। স্টেডিয়াম তখন আলোকিত হাজারো মোবাইল ফ্ল্যাশলাইটে, মানুষ একসঙ্গে উচ্চারণ করছে-ফ্রিজ দ্য রেন্ট! মেক বাসেস ফ্রি! ইউনিভার্সাল চাইল্ডকেয়ার!
মামদানি তার বক্তৃতায় সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতার কথাও তুলে ধরেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর নিউইয়র্কের কিছু এলাকায় রিপাবলিকান প্রভাব বেড়েছে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের বলা হচ্ছিল যুবকরা, এশিয়ান ভোটাররা, অভিবাসীরা ডানদিকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু যখন আমরা তাদের কাছে যাই, তারা বলে যে তারা বাম বা ডান নয়, তারা শুধু এমন এক সরকার চায় যা তাদের জন্য কাজ করবে।
তিনি প্রতিপক্ষ অ্যান্ড্রু কুমো এবং এরিক অ্যাডামসের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তাদের কাছে ভবিষ্যতের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি নেই। আছে কেবল ইসলামভীতির পুরোনো অস্ত্র। তারা জানে না, ঘৃণার রাজনীতি শেষ পর্যন্ত নিজেদেরই গ্রাস করে। মামদানি যখন বলেন, তারা আমাদের বোঝাতে চায় যে আমরা কম স্বপ্ন দেখি, কম চাই। কিন্তু আমি বলি এই শহর মহাবিশ্বের মতো, ক্রমাগত প্রসারিত। আমরা কম নয়, আরো বেশি চাই, কারণ প্রতিটি নিউইয়র্কারের মর্যাদা পাওয়ার অধিকার আছে, তখন পুরো স্টেডিয়াম গর্জে ওঠে করতালিতে। তার বক্তৃতায় ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের বিখ্যাত উদ্ধৃতি টেনে এনে মামদানি বলেন, আমি চাই যেন একদিন বলা হয়, আমাদের প্রশাসনে লোভ ও ক্ষমতার নেশা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হয়েছে। এবং আমি চাই সিটি হলে তারা তাদের পরাজয়ের স্বাক্ষর রাখুক।
তিনি সতর্ক করেন, অনেকে এখনই আমাদের জয় নিশ্চিত ধরে নিচ্ছে। কিন্তু আমি বলছি অবহেলা করবেন না। শেষ নয় দিনই নির্ধারণ করবে নিউইয়র্কের ভবিষ্যৎ। তাই আমি আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ রাখি- আরও পরিশ্রম, আরো দরজায় কড়া নাড়া, আরো মানুষকে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া। র্যালির শেষ অংশে দর্শকদের মামদানি বলেন, যার হাতে টর্চলাইট আছে তারা যেন জ্বালিয়ে দেখায় যে কে দরজায় দরজায় যাবে, কে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নেবে। মুহূর্তেই হাজারো আলো জ্বলে ওঠে, যেন শহরজুড়ে এক নতুন সূর্যোদয়ের ইঙ্গিত। এই র্যালি শুধু একটি রাজনৈতিক প্রচার নয়, এটি ছিল এক প্রজন্মের বিশ্বাসের ঘোষণা যে নিউইয়র্ক এখনো মানুষের শহর, করপোরেট দাতাদের নয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মামদানির এই প্রচারণা আমেরিকান শহর রাজনীতিতে এক ব্যতিক্রমী শক্তির উত্থান নির্দেশ করছে। মুসলিম, অভিবাসী ও শ্রমজীবী ভোটারদের যে অভূতপূর্ব সংহতি তিনি সৃষ্টি করেছেন, তা নিউইয়র্কের নির্বাচনী মানচিত্রে এক নতুন রূপ দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি মামদানি জয়ী হন, তবে এটি আমেরিকার প্রথম বড় শহর হবে যেখানে একজন খোলামেলা সমাজতান্ত্রিক মুসলিম প্রার্থী সিটি হলের নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন যা সারা দেশের প্রগ্রেসিভ আন্দোলনের জন্য এক ঐতিহাসিক মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
র্যালির পরের দিন ২৭ অক্টোবর সোমবার নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ফরেস্ট হিলস স্টেডিয়াম টার্নড ইনটু দ্য বিটিং হার্ট অব আ মুভমেন্ট। সত্যিই, সেই রাতটি যেন ছিল এক স্বপ্নের প্রতীক, এক তরুণ প্রজন্মের সাহস, এক শহরের পুনর্জন্ম এবং এক নতুন রাজনীতির সূচনা।
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফরেস্ট হিলস র্যালির সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো যে এটি মামদানির প্রচারণাকে শুধু বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং এটি এখন এক বিস্তৃত জনগোষ্ঠীর আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। সেখানে আছেন শ্রমজীবী, অভিবাসী, তরুণ শিক্ষার্থী, এমনকি কিছু পুরনো মধ্যবিত্ত ভোটারও, যারা বলছেন আমরা আর করপোরেট রাজনীতি চাই না। এই প্রচারণার সবচেয়ে অনুপ্রেরণামূলক অংশ হলো এর স্বেচ্ছাসেবী শক্তি। প্রায় ৯০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক এখন কাজ করছে মামদানির জন্য। তাদের অনেকেই আগে কখনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। কেউ ক্যাব চালক, কেউ কলেজ ছাত্র, কেউ নার্স, কেউ আবার শিক্ষক। তারা বলছেন, আমরা রাজনীতিতে এসেছি কারণ আমরা বিশ্বাস করি-রাজনীতি কেবল ধনীদের খেলা নয়।
ফরেস্ট হিলস র্যালির পর স্পষ্ট যে, এই প্রচারণা এখন কেবল এক নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, এটি এক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এটি এমন এক আন্দোলন, যা বলছে-নিউইয়র্ক আর বিক্রির জন্য নয়; এটি মানুষের জন্য, পরিশ্রমের জন্য, মর্যাদার জন্য। যে শহর একসময় দ্য সিটি দ্যাট নেভার স্লিপস নামে পরিচিত, আজ সে আবার জেগে উঠেছে-এই তরুণ নেতার আহ্বানে। আর যেমন মামদানি বলেছিলেন তার বক্তৃতার শেষ অংশে, আমাদের কাজ শেষ হয়নি। নভেম্বরের ৪ তারিখে আমরা শুধু ভোট দেবো না, আমরা নিজেদের মুক্ত করব। এই শব্দগুলোই যেন বিরোধীরা এখনো চেষ্টা করছে তার নীতিগুলোকে ‘অবাস্তব’ প্রমাণ করতে, কিন্তু বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। ফরেস্ট হিলসের র্যালির পর থেকে তার সমর্থন এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে, নিম্নআয়ের পরিবার, তরুণ ভোটার এবং অভিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে মামদানির প্রতি আস্থা ক্রমেই বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন এক মুহূর্ত এসেছে যখন নিউইয়র্ক হয়তো আবার আমেরিকান প্রগ্রেসিভ রাজনীতির রাজধানী হয়ে উঠবে-যেমনটি একসময় ছিল ১৯৩০-এর নিউ ডিল যুগে। যদি মামদানি জয়ী হন, তাহলে এটি শুধু একটি শহরের নয়, বরং পুরো দেশের জন্য এক বার্তা হবে: সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এখন আর প্রান্তিক নয়, এটি মূল স্রোতে ফিরে এসেছে। তবে ফলাফল যাই হোক, জোহরান মামদানি ইতিমধ্যেই জিতেছেন এক বড় যুদ্ধ-মানুষের হৃদয়ের যুদ্ধ। তিনি দেখিয়েছেন, যে রাজনীতি একসময় ক্লান্তি, অবিশ্বাস ও অর্থের খেলায় পরিণত হয়েছিল, সেটিকে আবার নৈতিকতা ও আশার মঞ্চে ফিরিয়ে আনা যায়। ফরেস্ট হিলস স্টেডিয়ামের সেই রাতে, যখন হাজারো মানুষ মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে একসঙ্গে উচ্চারণ করেছিল, টুগেদার, উই উইল ফ্রিজ দ্য রেন্ট, মেক বাসেস ফ্রি, অ্যান্ড ডেলিভার ইউনিভার্সাল চাইল্ডকেয়ার। তখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এটি শুধু একটি প্রতিশ্রুতি নয়, এটি এক জনতার ঘোষণা।
সম্ভবত কয়েক দশক পর, ইতিহাস যখন ফিরে তাকাবে, তখন এই র্যালিকে দেখা হবে এক নতুন যুগের সূচনা বিন্দু হিসেবে, যেখানে নিউইয়র্ক প্রমাণ করেছিল, রাজনীতি এখনো মানুষের হতে পারে। আজ নিউইয়র্কের রাস্তায় বাতাসে মিশে আছে সেই বিশ্বাস-
এই শহর বিক্রির জন্য নয়,
এই শহর জীবনের জন্য।