মিশা সওদাগর
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্রশিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু সময় কাটান। দেশে কাজের অভাব ও শিল্পীদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কীভাবে দেখছেন এই পরিবর্তন। দেশীয় চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা এবং মতামত শেয়ার করেছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত পাঠকপ্রিয় দেশ পত্রিকার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলমগীর কবির
প্রশ্ন: সম্প্রতি বেশ কিছু শিল্পী বিদেশে চলে যাওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন। আপনি নিজেও একসময় বলেছিলেন, কাজের অভাবে আমাদের অনেক শিল্পী দেশ ছাড়ছেন। আপনি কি মনে করেন, এ অবস্থা কেন সৃষ্টি হলো?
মিশা সওদাগর: দেখুন, এটা একটা বড় দুঃখজনক ব্যাপার। যদি আমাদের দেশে যথেষ্ট কাজ থাকত, তাহলে এই শিল্পীরা বিদেশে চলে যেত না। তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজের অপ্রতুলতা সবার জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময়, আমি নিজে দিনে চার-পাঁচটি সিনেমার কাজ করতাম। সকাল ৭টায় কাজ শুরু হতো, রাত ২টা পর্যন্ত চলত। এখন সেই দিনগুলো অনেকটাই চলে গেছে। এফডিসি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। আমার তো মনে হয়, শিল্পীদের বিদেশে যাওয়ার জন্য তাদের মন চায়নি। তারা দেশ ছাড়ার পেছনে কাজের অভাবই প্রধান কারণ।
প্রশ্ন: তবে অনেকেই বলছেন, শিল্পীরা তো ভালো রোজগার করে বিদেশে গেছেন। তাদের কিভাবে দেখেন?
মিশা সওদাগর: (হাসি) আমি একদম বুঝি। তারা তো ভালো রোজগারের জন্য বাইরে যাচ্ছেন না, তারা তো পরিবারের জন্য যাতায়াত করছেন। একটা সঠিক জীবনযাপন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রয়োজন। আমাদের শিল্পীদের কী পরিস্থিতি সেটা ভাবুন। কাজ থাকুক বা না থাকুক, আমাদের অনেক কিছু মেইনটেইন করতে হয়। চেহারার গেটআপ, গাড়ি, মোবাইল, ভালো পোশাক এসব কিছুই রাখতে হয়। আর আমরা তো কাজ করি পরিবারকে ভালো রাখার জন্য। কিন্তু যদি কাজ না থাকে, ইনকাম বন্ধ হয়ে যায়, তখন আমাদের কী অবস্থা হবে?
প্রশ্ন: অনেক জনপ্রিয় অভিনেতা, যেমন অমিত হাসান, মৌসুমী, ইমন, সাইমন সাদিক-এই সব শিল্পীরা বিদেশে চলে গেছেন। আপনি নিজেও বছরের অনেকটা সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটান। সেখানে জীবন কেমন?
মিশা সওদাগর: আমি তো বলব, যারা দেশের বাইরে গেছেন, তাদেরকে দোষ দেওয়া যাবে না। যেমন, আমার বন্ধু অমিত হাসান, যিনি একসময় নায়কের ভূমিকায় ছিলেন, সেও চলে গেছে। এটা তো আমার নিজের অবস্থাও। আমি নিজেও বছরের অর্ধেক সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকি। অভিনয়ের বাইরে আমি তো কিছু করতে পারি না, তাই আমি চাই, যেখানে কিছু সুযোগ পেতে পারি, সেখানে কাজ করব। যদি আমার দেশেই কাজ থাকত, আমি কখনোই দেশ ছেড়ে যেতাম না।
প্রশ্ন: আপনি কি মনে করেন, চলচ্চিত্র শিল্পের এই পতন কেবল কাজের অভাবের কারণে, নাকি অন্য কোনো কারণে হচ্ছে?
মিশা সওদাগর: এটা তো অনেক বড় প্রশ্ন। আমার মনে হয়, কাজের অভাবের পাশাপাশি আরও কিছু কারণ আছে। যেমন, আমরা প্রযুক্তির দিক দিয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছি। সিনেমার ক্ষেত্রে যে নতুন নতুন ট্রেন্ড আসছে, সেগুলো বাংলাদেশে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। ভালো গল্পের অভাব, নির্মাতাদের স্বল্প বাজেটের কারণে অনেক সিনেমা এখন দর্শকদের কাছে তেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে না। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, আমাদের চলচ্চিত্রের মানের উন্নতি হয়নি। যদিও এফডিসি ছিল আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র, কিন্তু তার পরও যদি ভালো নির্মাণ, মানসম্পন্ন গল্প এবং ভালো পরিচালনা না থাকে, তাহলে তো দর্শকরা সিনেমা দেখবেন না। আর ব্যবসা না হলে শিল্পী এবং কলাকুশলীরা কেন কাজ করবেন? এখন অনেক শিল্পী বিজ্ঞাপন, ওয়েব সিরিজ বা অন্য মিডিয়াতে কাজ করার দিকে ঝুঁকছেন। কারণ, এসব ক্ষেত্রে একটু হলেও কাজ থাকে। আমাদের যদি এফডিসি এবং চলচ্চিত্রের মান পুনরুদ্ধার করতে হয়, তাহলে টেকনিক্যাল দিক থেকেও অনেক উন্নতি করতে হবে।
প্রশ্ন: তাহলে, দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের ভবিষ্যত কী হবে বলে আপনি মনে করেন?
মিশা সওদাগর: আমি তো চাই, চলচ্চিত্র শিল্পের আবার একটা ভালো সময় আসুক। আমাদের শিল্পী এবং কলাকুশলীদের জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার। সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে, এফডিসি এবং চলচ্চিত্রের পরিবেশ সঠিকভাবে পুনর্গঠন করতে হবে। তবে, যদি কাজ না থাকে, তাহলে শিল্পীরা তো নিজেদের জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে হবে। আমি জানি, অনেকে হয়তো এটা বুঝবে না, কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের শিল্পীদের অনেকটা স্যাক্রিফাইস করতে হয়। বিদেশে গেলে অন্তত তারা নিজের পরিবারের জন্য কিছু করতে পারবে।
প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্রে কাজের পরিবেশ এবং শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা কেমন? আপনি কি মনে করেন, আমাদের দেশে এমন পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব?
মিশা সওদাগর: যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা আর মূল্য অনেক বেশি। আমরা যেভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে শিল্পীদের প্রতি অনেক সময় তাচ্ছিল্য দেখি, সেখানে সেটা হয় না। আমেরিকায়, বা পশ্চিমা দেশগুলিতে, শিল্পীদের কাজকে সম্মান করা হয়। তারা বিশ্বাস করে, শিল্পী ছাড়া কোনো শিল্প, সংস্কৃতি বা সিনেমা এগিয়ে যেতে পারে না। সেখানে, শিল্পীদের জন্য এক ধরনের সুরক্ষা এবং সুযোগ থাকে, যাতে তারা তাদের কাজ করতে পারে নির্ভয়ে। অর্থাৎ, তারা শুধু তাদের কণ্ঠ বা অভিনয় নিয়ে চিন্তা করে, অর্থনৈতিক বা ব্যক্তিগত ঝামেলায় তারা ভোগে না। আমাদের দেশে, যদি আপনি শিল্পী হন, আপনার অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায়-নিজের গেটআপ থেকে শুরু করে, সামাজিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হয়, পরিবারের জন্য অনেক কিছু করতে হয়। কিন্তু সেখানে, শিল্পীরা পুরোপুরি নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ দিতে পারে, কারণ তাদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। আমাদের দেশে যদি এমন পরিবেশ তৈরি করা যায়, তাহলে অনেক শিল্পী বিদেশে চলে যাবে না, এবং আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পও একটি নতুন পথ পাবে। তবে, এটা হতে অনেক সময় এবং নীতিগত পরিবর্তনের দরকার।
প্রশ্ন: ধন্যবাদ মিশা সওদাগর, আপনার সময় এবং মূল্যবান মতামতের জন্য।
মিশা সওদাগর: ধন্যবাদ আপনাকেও। আমার কথাগুলো যদি কেউ ভাবতে পারে, তাহলে হয়তো কিছু পরিবর্তন আসবে, এবং শিল্পীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হবে।