প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদের বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নীতিকে আরো সম্প্রসারিত করে এবার ৩৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করেছেন। চলতি বছরের জুনে শুরু হওয়া নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার পর ১৬ ডিসেম্বর তা আরো বিস্তৃত করা হয়। যেসব দেশকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে, সেসব দেশের আরো ২০টির নাগরিকদের জন্য বৈধ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় অনির্দিষ্টকালীন ‘হোল্ড’ বা স্থগিতাদেশ আরোপ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস (ইউএসসিআইএস) পরিচালিত নাগরিকত্ব ও ন্যাচারালাইজেশন আবেদন, ওয়ার্ক পারমিট, স্বামী-স্ত্রীর আবেদনের প্রক্রিয়া, স্ট্যাটাস অ্যাডজাস্টমেন্ট, প্যারোলসহ বিভিন্ন ধরনের অভিবাসন সুবিধা গুরুতরভাবে প্রভাবিত হতে পারে। পাশাপাশি, তালিকাভুক্ত ৩৯টি দেশ থেকে আসা বৈধ স্থায়ী বাসিন্দাদের (গ্রিনকার্ডধারী) জন্য নাগরিকত্ব গ্রহণের আনুষ্ঠানিক শপথ অনুষ্ঠানও স্থগিত রাখা হয়েছে। এর ফলে তাদের যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার পথ অনিশ্চিতভাবে বিলম্বিত হচ্ছে। চলতি বছরের জুন মাসে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের ধারা ২১২(এফ) অনুযায়ী ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম দফায় ১৯টি দেশের নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সে সময় হোয়াইট হাউস জানায়, জাতীয় নিরাপত্তা ও ভিসা যাচাই প্রক্রিয়ার দুর্বলতার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ফেডারেল কর্মকর্তাদের আরো কিছু দেশের নাম প্রস্তাব করতে বলা হয়, যাদের ওপর ভবিষ্যতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নতুন করে আরো ২০টি দেশের নাগরিকদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। পাশাপাশি আগের নিষেধাজ্ঞায় থাকা কিছু ব্যতিক্রমও বাতিল করা হয়। নতুন এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর মোট ৩৯টি দেশের নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ও অ-অভিবাসী ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুতর বাধার মুখে পড়েছেন। জুন মাসে জারি হওয়া নিষেধাজ্ঞায় মোট ১৯টি দেশকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। আফগানিস্তান, মিয়ানমার, চাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, হাইতি, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। এ ১২টি দেশের নাগরিকদের ওপর সব ধরনের অভিবাসী ও অ-অভিবাসী ভিসা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে বুরুন্ডি, কিউবা, লাওস, সিয়েরা লিওন, টোগো, তুর্কমেনিস্তান ও ভেনেজুয়েলার নাগরিকদের জন্য অভিবাসী ভিসা এবং পর্যটক, শিক্ষার্থী ও এক্সচেঞ্জ ভিসায় আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
সেই সময় কিছু ব্যতিক্রম রাখা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী বাসিন্দা (গ্রিনকার্ডধারী), বৈধ ভিসাধারী ব্যক্তি, মার্কিন নাগরিকের নিকট আত্মীয়, আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী অ্যাথলেট এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী আফগান নাগরিকদের জন্য বিশেষ অভিবাসী ভিসা-এসব ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য ছিল না। তবে ১৬ ডিসেম্বরের নতুন ঘোষণায় পরিস্থিতি আরো কঠোর হয়ে ওঠে। নতুন তালিকায় বুরকিনা ফাসো, লাওস, মালি, নাইজার, সিয়েরা লিওন, দক্ষিণ সুদান ও সিরিয়ার নাগরিকদের ওপর সব ধরনের ভিসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি অ্যাঙ্গোলা, অ্যান্টিগুয়া ও বারবুডা, বেনিন, বুরুন্ডি, কোট দিভোয়ার, কিউবা, ডোমিনিকা, গ্যাবন, গাম্বিয়া, মালাউই, মৌরিতানিয়া, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, তানজানিয়া, টোগো, টোঙ্গা, ভেনেজুয়েলা, জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের অভিবাসী ভিসা এবং পর্যটক, শিক্ষার্থী ও এক্সচেঞ্জ ভিসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে কেবল তুর্কমেনিস্তান কিছুটা ছাড় পেয়েছে। দেশটির নাগরিকদের জন্য অভিবাসী ভিসা নিষিদ্ধ থাকলেও অ-অভিবাসী ভিসায় নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হয়েছে। নতুন নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে বিতর্কিত দিক হলো-আগে থাকা বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম বাতিল করা। এর ফলে এখন ভ্রমণ নিষিদ্ধ দেশগুলোর নাগরিকদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বামী বা স্ত্রী, ২১ বছরের নিচের সন্তান, বিদেশে দত্তক নেওয়া শিশু এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীকে সহায়তাকারী আফগান নাগরিকরাও ভিসা পাওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমেও প্রতারণা বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ঝুঁকি থাকতে পারে।
নতুন নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হলো নাইজেরিয়া। গত এক দশকে (কোভিড মহামারি ব্যতীত) প্রতিবছর গড়ে প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার নাইজেরীয় নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী ও অ-অভিবাসী ভিসা পেয়েছেন। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল এ দেশ থেকে বৈধ অভিবাসন কার্যত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জনকারী সেনেগাল ও কোট দিভোয়ারের নাগরিকরাও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছেন। বৈধ ভিসা না থাকলে এসব দেশের সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত বিশ্বকাপ ম্যাচ সরাসরি দেখার সুযোগ হারাবেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এসব নিষেধাজ্ঞা জাতীয় নিরাপত্তা ও ভিসা ওভারস্টে রোধের জন্য প্রয়োজনীয়। তবে সমালোচকদের মতে, ছোট শিশু ও পরিবারের সদস্যদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের সঙ্গে নিরাপত্তার সরাসরি কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে অনেক দেশ রয়েছে যাদের ভিসা ওভারস্টে হার সমান বা বেশি হলেও তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে রয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর অভিবাসন অধিকারকর্মী ও মানবাধিকার সংস্থা এসব নিষেধাজ্ঞাকে বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক বলে অভিহিত করেছে। বিশেষ করে আফ্রিকান ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোকে লক্ষ্য করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে নতুন আইনি চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।যদিও এই ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিবাসীদের ওপর প্রযোজ্য নয়, তবে ইতোমধ্যে ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস নিষিদ্ধ দেশগুলোর নাগরিকদের সব ধরনের অভিবাসন আবেদন প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ এবং তাদের মার্কিন নাগরিক পরিবার ও নিয়োগকর্তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন।ইমিগ্রেশন অধিকারকর্মীদের মতে, ট্রাম্পের এই নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিকে আরো কড়া ও সীমাবদ্ধ করে তুলেছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ, অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর পড়তে পারে।