৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ১০:৬:৪১ অপরাহ্ন


পরিবেশদূষণের ভয়াবহতা কাউকে রেহাই দেবে না
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৬-২০২৫
পরিবেশদূষণের ভয়াবহতা কাউকে রেহাই দেবে না সেমিনার মঞ্চে অতিথিরা


‘প্লাস্টিক পলিথিনদূষণ প্রতিরোধ, বর্জব্যবস্থাপনা ও ভূমিকম্প সুরক্ষা প্রস্তুতি’ বিষয়ক এক বিশেষ সেমিনার আলোচকরা বলেছেন, উন্নয়নের নামে বিগত সরকার ঢাকা শহরের গাছ, মাঠ-পার্ক, জলাধার এবং খাল-বিল ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। পরিবেশদূষণের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ধনী-গরিব কাউকে রেহাই দেবে না। বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) উদ্যোগে গত ২১ জুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তন হলে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বাপার সভাপতি, অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং বাপার নির্বাহী সদস্য ও কোষাধ্যক্ষ জাকির হোসেনের সঞ্চালনায় সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।

সেমিনারে প্লাস্টিক ও পলিথিন প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার সহ-সভাপতি, অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ, শিল্প ও মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার যুগ্ম সম্পাদক, অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার এবং ভূমিকম্প ও প্রস্তুতি বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার নগরায়ণ ও নগর সুশাসনবিষয়ক প্রোগ্রাম কমিটির সদস্য সচিব, পরিকল্পনাবিদ তৌফিকুল আলম।

অনুষ্ঠানে নির্ধারিত আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেন, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, বাপার সহ-সভাপতি, অধ্যাপক ড. এম শহীদুল ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আইনবিষয়ক সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসানুল বান্না।

এতে উপস্থিত ছিলেন বাপার যুগ্ম সম্পাদক, আমিনুর রসুল, হুমায়ুন কবির সুমন, ফরিদুল ইসলাম ফরিদ, ড. হালিমদাদ খান, জাতীয় পরিষদ সদস্য হাজি শেখ আনছার আলী, আরিফুর রহমান, শাকিল কবির, তরিকুল ইসলাম রাতুলসহ আয়োজক সংগঠনের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন পরিবেশবাদী এবং সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও গ্রিন ভয়েস বিভিন্ন শাখার প্রতিনিধিরা। 

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, আমাদের অভ্যাসের পরিবর্তন জরুরি। দেশে পরিবেশ আইন আছে কিন্তু এটাকে মানার প্রবণতা লক্ষণীয় নয়। দেশের বাজারগুলো পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্যে সয়লাব হয়ে গেছে। এর ফলে মাছের পেটে, মানুষের শরীরে ও মায়ের বুকের দুধে প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। এ থেকে বের হয়ে আসতে হলে সর্বস্তরে সচেতনা প্রয়োজনের পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগ দরকার বলে মনে করেন।

স্বাগত বক্তব্যে আলমগীর কবির বলেন, উন্নয়নের নামে বিগত সরকার ঢাকা শহরের গাছ, মাঠ-পার্ক, জলাধার এবং খাল-বিল ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার ২০০২ ইং সালে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু পলিথিন ও টিস্যু ব্যাগ বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। আইনের নির্মোহ ও কঠোর ব্যবহারের অভাবই এর প্রধান কারণ বলে তিনি মনে করেন। 

 অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ, তার লিখিত প্রবন্ধে বলেন প্লাস্টিক মূলত তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। সুতরাং পরিবেশের ওপর এর একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে যায়। এছাড়া প্লাস্টিক পলিথিনের মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় যেগুলোর প্রায় প্রতিটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৪৮০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন হয়। ওয়ান টাইন প্লাস্টিক পরিবেশের ওপর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকের সঙ্গে জিডিপির একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যে দেশের জিডিপি যত বেশি সেই দেশ তত বেশি পরিমাণ প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন করে। উল্লেখ্য প্লাস্টিক বর্জ্য বিভিন্ন নদী অববাহিকা অতিক্রম করে সাগরে গিয়ে পড়ে। সূর্যের রশ্মি এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রো প্লাস্টিকে পরিণত হয়, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। মানবদেহে মাইক্রো প্লাস্টিক প্রবেশের পর এটি দেহকোষে প্রবেশ করে কোষের ক্ষতি সাধন করে। বর্তমানে বিশ্বে মাইক্রো প্লাস্টিক উৎপাদনের পরিমাণ বছরে প্রায় ০.৮৫ মিলিয়ন টন। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৯৭৭ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয় যা বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে থাকে। প্লাস্টিক পলিথিন বন্ধে বাংলাদেশে আইন রয়েছে। পূর্বে হাতলযুক্ত পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে পরবর্তীতে হাতলবিহীন পলিথিন এর প্রচলন শুরু হয়। 

অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জমান মজুমদার তার লিখিত প্রবন্ধে বলেন, শিল্প এবং স্বাস্থ্য খাতে যেসকল বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার সিংহভাগই হচ্ছে প্লাস্টিকের। আমাদের জীবন বর্তমানে প্লাস্টিকময় হয়ে উঠেছে। শিল্পায়নের প্রয়োজন বিশ্বে সব দেশেই রয়েছে। তবে এই শিল্পায়ন বর্তমানে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। কারণ শিল্পে ব্যবহৃত কাঁচামাল ব্যবস্থাপনা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। আমরা একদিকে যেমন দূষণের মধ্যে আছি, অন্যদিকে আমাদের পণ্যগুলোকে দূষণ থেকে রক্ষা করার জন্য প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলছি এবং এই মোড়কগুলোর ব্যবস্থাপনায় আমাদের যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্প এবং চামড়াশিল্প পানিদূষণের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। চামড়া শিল্পের দূষণ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীকে রক্ষার জন্য চামড়া কারখানা হাজারীবাগ থেকে ঢাকার সাভারে স্থানান্তর করার পর আরো ব্যাপকভাবে নদীদূষণ শুরু হয়েছে। 

পরিকল্পনাবিদ তৌফিকুল আলম তার লিখিত প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ঢাকা শহরের প্রায় ৯৫ শতাংশ ভবনই অননুমোদিত। একটি ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে ঢাকা শহরের প্রায় ৫১ শতাংশ ভবন ধসে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি হ্রাসে তিনি কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ উপস্থাপন করেন। 

অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, মেডিকেল বর্জ্য সমস্যা একদিনে সমাধান করা সম্ভব। শুধু সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যস্থাপনা সঠিকভাবে অনুসরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রিজম সংস্থা কানাডা সরকারের আর্থিক সহায়তায় কয়েকটি হাসপাতালে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রকল্পের কাজ শুরু করে। কিন্তু সঠিক মনিটরিং এর অভাবে অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। 

অধ্যাপক ড. এম শহীদুল ইসলাম বলেন, সমুদ্রের তলদেশে প্লাস্টিকের সন্ধান করার জন্য আমরা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সমুদ্রের তলদেশে ডাইভিং করে প্লাস্টিকের স্তূপ দেখতে পেয়েছি। সরকার পলিথিন বন্ধে অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। প্রথমে সর্বত্র পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ থেকে সর্বশেষ সুপারশপগুলোতে পলিথিন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু পলিথিন এখনো বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন বন্ধে জীবন দর্শন পরিবর্তনের আহ্বান জানান। করপোরেট কালচার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা কঠিন। ভৌগোলিকভাবে আমরা যতটা ঝুঁকির মধ্যে আছি তার চেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছি আমাদের সামাজিক আচরণের কারণে। সুতরাং আমাদের সামাজিক আচরণ পরিবর্তন করা জরুরি। আমাদের ভূমিকম্প ব্যবস্থাপনার জন্য কন্টিনজেন্সি পরিকল্পনা অত্যন্ত জরুরি। পলিসি পরিবর্তনে পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময় এবং বাপা এক্ষেত্রে একটি কার্যকর প্ল্যাটফর্ম বলে তিনি মন্তব্য করেন।

 গাউস পিয়ারী, বলেন ১৯৯৮ সাল থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগের উৎপাদনে তার সংস্থা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি ওয়ান টাইম প্লাস্টিক পণ্য একদম কমিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, প্লাস্টিকে প্যাকেট করা খাবার খুবই ক্ষতিকর কারণ সেই প্লাস্টিকের মোড়কের লেখায় যে কালি ব্যবহার করা হয় তা থেকে ক্যানসারের মত মারাত্মক রোগের সৃষ্টি হতে পারে। প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। 

হাসানুল বান্না বলেন, ২০০২ সালে আইনের মাধ্যমে পলিথিন বন্ধকারী বাংলাদেশ প্রথম দেশ। আইন করা হলেও বাংলাদেশে পলিথিনের ব্যবহার অদ্যাবধি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। জুট পলিথিনের ব্যবহার উৎসাহিত করা হলেও দাম বেশি হওয়ার কারণে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব হয়নি।

শেয়ার করুন