০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:৪৭:১৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১২-২০২২
কথার কথকতা


অনেক আগে আমার কোনো এক লেখায় লিখেছিলাম যে, একজন মানুষ তার পুরা জীবনে একটি অসমাপ্ত বাক্য উচ্চারণ করে। বাক্যটি শেষ হবার আগেই তার পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় এসে যায়। আগমনের মতোই কখন সে বিদায় নেবে তার জানা থাকে না আর কথা শেষ করার সুযোগও হয় না। জীবনের সমান লম্বা বাক্যটি আর শেষ হয় না। দেখার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। দেখাও শেষ হয় না। তাহলে বিষয়টি এ রকমই দাঁড়ালো যে, মানুষের বলা এবং দেখা কখনো শেষ হয় না। এই তৃষ্ণা নিয়েই মানুষকে বিদায় নিতে হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, মানুষ এভাবে চিন্তাই করে না। করলে পৃথিবী এবং মানবসমাজ অনেক সুখে-শান্তিতে ভরে যেতো। যা-ই হোক, মানব জাতিকে উদ্ধার করা বা উপদেশ বাণী প্রদানের জন্য আমি এ বিষয়ের অবতারণা করছি না। বাস্তব অবস্থায় নিজেই এ রকম একটি পরিস্থিতির ভেতর এসে গেছি। দরকারি কথাতো বলা হলো না, ভালো করে দেখাতো সম্পন্ন হলো না, সঠিক করে বোঝাও তো হয়ে উঠলো না-এই অবস্থায় উপনীত হলে মানুষ কিইবা আর করতে পারে! এটাতো ক্ষমতা বা সক্ষমতার বিষয় নয়, এটাতো সৃষ্টিরই নিয়ম, ব্যক্তি বা সমষ্টির এতে করার কিছু নেই। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার প্রচেষ্টায় আমি জীবনের পুরো স্মৃতিভা-ার থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু স্মৃতিচারণ করে দেখি বিষয়টি বাস্তবতার আলোকে বিশ্লষণ করা যায় কি না।

যে কোনো বয়সেই একটা মানুষ চিরবিদায় নেয়ার সময় এক অসীম তৃষ্ণা এবং হাহাকার নিয়ে আশপাশের সবার দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কিছুই বলতে পাওে না। আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব যারা পাশে থাকে তারাও করুণ চোখে চেয়ে থাকে, করার কিছুই থাকে না। চিরবিদায়ের বিষয়টি খুবই মর্মস্পর্শী, তাই এদিকে দৃষ্টি দেয়া থেকে আপাতত সাধারণ সময়ের বিষয়গুলোর দিকে একটু তাকানো যাক, দেখি কি পাওয়া যায়।

কে বিজ্ঞানের কোন সূত্র আবিষ্কার করতে গিয়ে গবেষণা সমাপ্ত করতে পারেনি অথবা কে মহাশূন্যে উড়তে চেয়েছিলো কিন্তু একটু উঠেই ল্যান্ড করতে হয়েছে- এ রকম ভারী বিষয়ে আমরা যাবো না, চেষ্টা করবো মনছোঁয়া বিষয়গুলো টানতে। আপনারা জানেন যে, আবেগ হচ্ছে সবকিছুর প্রধান চালিকাশক্তি। অনেকে হয়তো বলবেন যে, আবেগ নয় ঐকান্তিকতাই হচ্ছে প্রধান চালিকাশক্তি। ঠিক আছে, আমরা এটাও গ্রহণ করলাম।

এবার আমরা মানব জীবনের বিভিন্ন স্তর থেকে কিছু অতৃপ্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করবো। কাজটা কিন্তু অনেক কঠিন!

আমাদের এক বন্ধু, পঞ্চাশ বছর আগে এক মেয়ের সাথে অল্প সময়ে একটা গভীর ভাব হয়েছিলো। মেয়েটির মা তাকে নিষ্ঠুরের মতো বিতাড়িত করেছে। ওই মেয়েটিকে একটিবার দেখার সীমাহীন আকুতি কাজ করতো ছেলেটির মনে। পঁচিশ-ত্রিশ বছর পর সে স্বপ্নে দেখলো মেয়েটি তার বিভিন্ন বয়সী দুটো শিশু সন্তানকে পাশে বসিয়ে রান্নার কাজ করছে আর সে বাড়ির দেয়ালের ওপর দিয়ে ওদেরকে দেখছে। কি করুণ প্রচেষ্টা!

আরেকজন চেনা সমবয়সী মানুষ, বর্তমানে সত্তরেরও বেশি বয়স। এ রকম কোনো তৃষ্ণা বা হৃদয়ের হাহাকার আছে কিনা জানতে চাইলে বললো এক অজানা ছোট্ট কাহিনি। কলেজ জীবনের শুরুর দিকে ঘটনাক্রমে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যেতে হয়েছে। আত্মীয়ের ঘরের পাশের ঘরে একজন অসুস্থ মানুষকে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, শয্যাশায়ী মানুষটির এক অপার সুন্দরী স্ত্রী আছে। পরিচয় হলো, বউটি একে খুব পছন্দ করে ফেললো। ছেলেটিকে শরমিন্দা প্রকৃতির দেখে আড়ালে ডেকে এনে বউটি বললো, ‘আমি আপনারে ভালোবাসি ফালাইছি।’ এর অনেক দিন পর একদিন দুটো বাস বড় রাস্তা দিয়ে যাবার সময় ওই বউটি এক বাস থেকে জানালা গলিয়ে চিৎকার দিয়ে ডাকলো, ‘সেলিম ভাই!’ অন্য গাড়িতে ছিলো পছন্দের মানুষটি। জীবনের শেষপ্রান্তে সেই ছেলেটি এখনো ভাবে, ‘ওকেও যে আমার পছন্দ হয়েছিলো সেই কথাটি অন্তত একবার তাকে বলতে পারলেও ভালো হতো!’

মনের মানবিক ঝড়-তুফানের আরো কতো কাহিনি রয়েছে মানব জীবনে।

আরেক চেনা মানুষের কাহিনি। এটা হবে কমপক্ষে পঞ্চান্ন বছরেরও বেশি আগের ঘটনা। ছেলেটি কৈশোর পার হয়ে তারুণ্যে প্রবেশের কাল চলছে। এক কাজিনের সাথে বেড়াতে গিয়েছে ওর এক আত্মীয়ের বাড়িতে। মেহমান হিসেবে অনেক কারণেই ওদের কাছে কাজিনের চেয়ে এই মেহমানটি ছিলো বেশি গুরুত্ববহ। খাওয়া-দাওয়ার পর একটা বিছানায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো ছেলেটি। হঠাৎ এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো। এই পরিবারের একটি কিশোরী মেয়ে হঠাৎ করে ছুটে এসে লম্বা হয়ে ছেলেটির বুকে শুয়ে পড়ে তাকে জাপটে ধরে রাখলো। ছেলেটিতো ঘটনার আকস্মিকতায় কাষ্ঠবৎ হয়ে পড়েছে। এক মিনিটের মতো থেকে মেয়েটি আস্তে করে উঠে চলে গেলো। পরবর্তী সময়ে মেয়েটির কোথায় বিয়ে হয়েছে, তাও জেনেছে ছেলেটি। এই বয়সে এখনো ছেলেটির মনে হয়, ওকে যদি একবার দেখতে পেতাম!

কতো কাহিনি মানুষের, থেকে যায় অজানা এবং অকথিত, অপ্রকাশিত!  এরকম আরেকটি অপ্রকাশিত কাহিনি বলবো। একটি সহজ, সরল, বোকা ছেলেকে এক কাজিন সিস্টারকে প্রাইভেট পড়ানোর রিকোয়েস্ট করা হলো। ছেলেটির প্যারেন্টসও চাচ্ছেন, মেয়েটিকে পড়ানো হোক, একটু পড়ালেখা করলে ভালো একটা পাত্রে সংস্থাপন সহজ হবে। মনোযোগ দিয়ে না পড়লে ছাত্রছাত্রীকে বেত মারার সিস্টেম ছিলো তখনো। ছেলেটি পড়াতে রাজি হলো, কিন্তু শাস্তি দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিলো। এরপর পৃথিবী অনেক বছর ধরে ঘুরলো। মেয়েটির বিয়ে হলো। তারপরও কয়েক যুগ কেটে গেলো। একদিন গ্রামের বাড়ি থেকে এক আত্মীয়ের ফোন এলো। ফোনদাতা বললো, বুইজা (আপা) আপনার সাথে কথা বলবেন। সেই মেয়েটি, এখন মহিলা! কুশলাদির পর পড়ানোর সময় শাস্তি দিতে না চাওয়ার বিষয়টির স্মৃতিচারণ করলেন বয়স্কা মহিলাটি। ছেলেটি বলতে পারেনি যে, মেয়েটিকে তার ভালো লেগেছিলো এবং বহু বছর পর স্বপ্নে একবার তার সাথে সম্মিলনও ঘটেছিলো!

পিতৃহারা এক পুত্রের হৃদয়ের হাহাকার শুনেছিলাম একজনের কাছে। এতো সমীহ করতো পিতাকে যে, ওনার চোখের দিকে কখনো তাকানো হয়নি। এখন সত্তরোর্ধ্ব বয়সে তার মনে পড়লো, পিতা তাঁর পিতাকে হারিয়েছিলেন দুই বছর বয়সে আর মাতাকে হারিয়েছেন পাঁচ বছর বয়সে। তাহলে এই কঠিন অবস্থায় তিনি বড় হলেন কি করে আর পড়াশোনা করলেন কেমনে, এগুলো তো জানা হলো না! পিতার জীবনের এই করুণ ও কঠিন অংশটি কেউ তো আপনের মতো ওনার পাশে বসে জানতে চায়নি! ছেলের যখন এই উপলব্ধি তার অনেক আগে পিতা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন!

আরেক চেনাজানা লোকের মাতৃকাহিনি-বিষয়ক হাহাকার শুনলাম। মানুষের লুকানো কষ্টের খোঁজখবর নিতে গিয়ে এই অধমের অবস্থাও কাহিল। এই মানুষটির মা অনেক জীবনযুদ্ধ জয় করার পরও যখন নিজের বিশাল বাড়িতে নিরাপদবোধ করলেন না, তখন তিনি শহরে তাঁর বড় ছেলের কাছে চলে গেলেন। কিন্তু গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো মাকে সে নিজের কাছে রাখতে পারলো না। সার্বিক অবস্থাটা এমন ছিলো যে, কাউকেই দোষ দেয়া যাচ্ছে না, কিন্তু নিরাপদবোধ করার মতো স্থানও পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষকে নিয়ে যাওয়ার আগে বিধাতা কি সবার জন্য পৃথিবীটাকে পর করে দেন? তিনি গ্রামে ফিরে গেলেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে ওনার আরেক পুত্র তাঁর কাছ থেকে কিছু সম্পত্তিও লিখে নিলো। একদিন বড় ছেলে খবর পেলো, তার মা ঘরের বাইরে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ছেলেটি যখন বাড়ি যাবার জন্য গাড়িতে উঠলো তখন সে নিশ্চিত যে, মা আর নেই। ছোট ভাইয়ের কথায় পরোক্ষভাবে তা-ই মনে হয়েছে। একসময় দেখা গেলো, বড় ছেলেটি মৃত মায়ের বক্ষে কান রেখে একটু শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে চাচ্ছে আর সবাই করুণ চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটি এখন একজন প্রায় বুড়ো মানুষ। বাড়ির উঠানে বসে সে তখন ভাবছে, ‘হায়, আমরা এতো অসহায়!’

প্রিয় পাঠক, এতো এতো করুণ কাহিনি মাথায় নিয়ে আমি কেমন আছি তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। মানুষের আরো অনেক হাহাকার কাহিনি আমার কাছে জমা আছে। আমার যেগুলো সেগুলো আরো অনেক করুণ! লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে তাই সেগুলো আপাতত থাক। আন্তরিকতার সাথে লেখাটি পড়বার জন্য সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তো সুধীম-লী, আপনাদের কারো মনে কি লুকানো এবং না বলা কোনো কাহিনি আছে? না না, অস্থির হবার দরকার নেই। বলতে হবে না, কারণ আমরা জানি ‘হৃদয়ের হাহাকার, নাই বলো আহা কার!’

শেয়ার করুন