০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:১৬:৫৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


প্রসঙ্গ পদ্মা সেতু
‘চুবানি ও টুস’ টক অব দ্যা কান্ট্রি
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৫-০৫-২০২২
‘চুবানি ও টুস’ টক অব দ্যা কান্ট্রি


দেশে এ মুহূর্তে আলোচ্য বিষয় পদ্মা সেতু। ডলারের দাম রেকর্ড একশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় তোলপাড় হওয়াটাও পেছনে ফেলেছে পদ্মা। কারণ এটা খুলে দেয়ার দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তাপ ছড়াচ্ছে দেশের মানুষের মধ্যে। অনেক চ্যালেঞ্জ পার হয়ে বাস্তবতায় এ আলোচিত সেতু। দক্ষিণবঙ্গের মানুষের প্রাণের দাবি পূরণ হতে চললো। এ সেতু হওয়ায় বরিশাল,খুলনা,ফরিদপুরের একাংশ,মাদারীপুর,শরীয়তপুরসহ ওই অঞ্চলের মানুষকে ফেরিঘাটের বিড়ম্বনা পোহাতে হবেনা।

সরাসরি পার হয়ে যাবে প্রমত্ত পদ্মা মুুহূর্তে। যেমনটা বঙ্গবন্ধু সেতুর মাধ্যমে শত লঘু-লাঞ্চনার অবসান ঘটেছে উত্তরবঙ্গের মানুষের। সারাদেশেও এর সুফল মিলছে। মুহূর্তেই উত্তরবঙ্গে আবাদ করা বিভিন্ন ফলফলাদি,শাকসব্জি সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে রাজধানীসহ দেশের সকল প্রান্তে। যেখানে ফেরিঘাটে আটকা পড়ে ওইসব জিনিষপত্র প্রতিনিয়ত নষ্ট হয়ে যেত আগে।   

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সেতু জনগণের ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়ার দিনক্ষণ চূড়ান্ত করবেন। যদিও জুন মাসের শেষ নাগাদ এটা খুলে দেয়ার কথা সেতু ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বার বার বলে আসছেন। এ সেতুর আলোচনা ঘিরেই কিছু কথাও একই সঙ্গে তোলপাড়। সেটা প্রধানমন্ত্রীর। প্রধানমন্ত্রীর সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে। সেতুতে যে স্প্যানগুলো বসাচ্ছে, এগুলো তার কাছে ছিল, জোড়াতালি দেওয়া। বলেছিল, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানাচ্ছে, ওখানে চড়া যাবে না। চড়লে ভেঙে পড়বে। আবার তার সঙ্গে কিছু দোসরাও। তাদেরকে এখন কী করা উচিত? পদ্মা সেতুতে নিয়ে গিয়ে ওখান থেকে টুস করে নদীতে ফেলে দেওয়া উচিত।’ 

পাশাপাশি আরেকজনকে উদ্দেশ্য করেও তিনি বলেন, তিনি হলেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডক্টর মুহাম্মাদ ইউনুস। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি এমডি পদের জন্য পদ্মা সেতুর মতো সেতুর টাকা বন্ধ করেছে, তাকে পদ্মা নদীতে দুইটা চুবানি দিয়ে তোলা উচিত। মরে যাতে না যায়, পদ্মা নদীতে একটু চুবানি দিয়ে সেতুতে তুলে দেওয়া উচিত। তাহলে যদি শিক্ষা হয়। পদ্মা সেতুর অর্থ বন্ধ করাল ড. ইউনূস। কেন? গ্রামীণ ব্যাংকের একটি এমডি পদে তাকে থাকতে হবে।’ 

গত ১৭ মে (বুধবার) আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় সেতু প্রসঙ্গে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও প্রফেসর মুহাম্মাদ ইউনুসের পাশাপাশি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামেরও সমালোচনা করেন। 

মূলত ওই অনুষ্ঠানটা ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৪২তম স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের। ১৯৮১ সালের ১৭ মে নির্বাসিত জীবন থেকে তিনি দেশে ফেরেন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলীয় কার্যালয়ে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক উপকমিটি। এতে গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে দেয়া তাঁর ওই বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রচার করেছে। যা পরবর্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রচার পায়। 

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম গ্রামীণ ব্যাংকের উপদেষ্টা হতে। উপদেষ্টা হিসেবে থাকা আরও উচ্চ মানের। তার এমডিই থাকতে হবে। সেটা সে ছাড়বে না। কিন্তু তার বয়সে কুলায় না।’ বিষয়টি নিয়ে ইউনূস মামলা করেছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোর্ট আর যাই পারুক, তার বয়স তো ১০ বছর কমিয়ে দিতে পারবে না। কারণ, গ্রামীণ ব্যাংকের আইনে আছে ৬০ বছর পর্যন্ত এমডি পদে থাকতে পারবে। তখন তার বয়স ৭১ বছর। বয়সটা কমাবে কীভাবে? সে মামলায় হেরে যায়। কিন্তু প্রতিহিংসা নেয়।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা শুনেছি, সে (ইউনূস) আর মাহ্ফুজ আনাম আমেরিকায় যায়। স্টেট ডিপার্টমেন্টে যায়। হিলারি ক্লিনটনকে ইমেইল করে। মি. জোয়েলিক সে সময় বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁর শেষ কর্মদিবসে, কোনো বোর্ডসভায় নয়, পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দেন।’

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের ফলে শাপেবর হয়েছে বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ যে নিজের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারে, সেটা আজকে আমরা প্রমাণ করেছি। কিন্তু আমাদের এখানে একজন জ্ঞানী লোক বলে ফেললেন, পদ্মা সেতুতে যে রেললাইন হচ্ছে, তাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে, তা তো ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে। এ ঋণ কীভাবে শোধ হবে?’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বড় বড় অর্থনীতিবিদ, ‘জ্ঞানী-গুণী এই ধরনের অর্বাচীনের মতো কথা বলেন কীভাবে? মেগা প্রজেক্টগুলো করে নাকি খুব ভুল করছি। তারা আয়েশে বসে থাকে আর আমার তৈরি করা সব টেলিভিশনে গিয়ে কথা বলে।’ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সমালোচনা হচ্ছে জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘এত টাকা দিয়ে স্যাটেলাইট করে কী হবে এ প্রশ্নও কিন্তু তুলেছে তারা। অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করলে তাদের গায়ে লাগে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পদ্মা সেতু হয়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশের জনগণের অর্থ দিয়ে এ পদ্মা সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব তারই। এটা সর্বজন সমাদৃত। কিন্তু একই প্রসঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সেতুতে তুলে ‘টুস’ করে ফেলে দেয়া ও প্রফেসর ইউনুসকে চুবিয়ে আবার নদী থেকে তোলা এ জাতীয় ভাষা কতটা শোভনীয় এটা নিয়ে তোলপাড়। একজন প্রধানমন্ত্রী তিনি দেশের সকলের প্রধানমন্ত্রী,অভিবাবক। তিনি কী এভাবে কাউকে বলতে পারেন কি-না সেটা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা। 

সেটা শুধু বিএনপি বা সরকার বিরোধী অণ্যদলের লোকই যে করেছেন তা নয়। সরকার পন্থী দলের অনেককেই প্রধানমন্ত্রীর অমন কথায় বিব্রতবোধ করতে দেখা গেছে। যদিও কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী আবেগের বসবতি হয়ে এমনটা বলে ফেলেছেন বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এরপরও একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে গোটা বিশ্বে যিনি একজন সম্মানিত ব্যাক্তি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস। নোবেল বিজয়ী। তাকে ‘চুবানো’র বিষয়টা লজ্জাজনক।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ইস্যুতে শুক্রবার (২০ মে) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জেসিডি সভাপতি আসম আব্দুর রব কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে পারাপারের জন্য, জনগণকে ফেলে দেওয়ার জন্য নয়। এটা একটা সেতু, ফায়ারিং স্কোয়াডের মত শাস্তি প্রয়োগের কোন স্থাপনা বা বধ্যভূমি নয়। দেশের নাগরিককে টুস করে নদীতে ফেলে দেওয়া বা পানিতে চুবনি উচিত এই ‘মূল্যবোধ’ এবং রাজনৈতিক দর্শন সরকার ও দেশের জন্য চরম সর্বনাশ ডেকে আনবে। জিঘাংসার উপকরণ যোগানো সরকারের কর্তব্য নয়, এতে সমাজের মানবিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে।’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আপনারা গতকাল (বুধবার ১৭ মে) আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর একটা বক্তব্য শুনেছেন, যিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন; যেভাবেই আসুন না কেন। তিনি যে এভাবে এত অশালীন কথা বলতে পারেন এবং এভাবে এত অরাজনৈতিক কথা বলতে পারেন, এটা আমাদের ধারণার বাইরে। তাঁর কথার মধ্যে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকি ছিল। তিনি কী বলেছেন? পদ্মা সেতুতে নিয়ে তাঁকে (খালেদা জিয়া) টুপ করে ফেলে দিতে বলেছেন।’ একই অভিযোগ বিএনপি শীর্ষ নেতা ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন, রুহুল কবীর রিজভীও করেছেন। 

এছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর অমন উক্তিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লা ও বিভিন্ন আলোচনার টেবিলেও আলোচিত হচ্ছে।বিভিন্ন সময়ে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কঠিন সমালোচনা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াও বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগ সরকার বানাতে পারবে না।’ কোন প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন সে কথা সেটা তিনি জানেন। তবে টানা তিন টার্ম ক্ষমতায় থাকার ফলে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব প্রতিকূল পরিবেশ পেরিয়ে বাস্তবতার আলোকে নিয়ে আসতে পেরেছেন সেতু সেটাও  সত্যি। কিন্তু দিন শেষে এক সমালোচনার জবাব সমালোচনা দিয়ে হয়তো দেয়া যায় রাজনীতির মাঠে। কিন্তু এভাবে বলা সেটা সাবেক তিনবারের একজন জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেলায় কতটা শোভনীয় সেটাই আলোচিত হচ্ছে সর্বস্তরে। 

যমুনা সেতু বা বঙ্গবন্ধু সেতুও কিন্তু বাস্তবায়নে বিভিন্ন সরকারের অবদান ছিল পর্যায়ক্রমে। জাতীয় পার্টি,বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু সেতু তৈরি নিয়েও পক্ষ-বিপক্ষ কম কথা হয়নি। যমুনা সেতু স্থাপনের জন্য প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৪৯ সালে। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রথম এ উদ্যোগ নেন। কিন্তু তখন তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ১৯৯৪ সালের ১০ এপ্রিল পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।

সেদিন তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দেশ ব্যাপী সকাল সন্ধা হরতাল আহ্বান করেছিল। ফলে ঢাকা থেকে সব রাষ্ট্রদূত, বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের হেলিকপ্টারে করে যমুনা সেতু এলাকায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। এরপরের দিন থেকে অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর এর কাজ শুরু হয় এবং ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ফলে যমুনা পরবর্তিতে বঙ্গবন্ধু সেতু নামকরণ হওয়া ওই সেতুতেও জাতীয় পার্টি (যেহেতু প্রাথমিক কাজ হুসাইন মুহাম্মাদ এরশাদ শুরু করেছিলেন) বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তিন দলেরই কৃতিত্ব দিতে হয়।


শেয়ার করুন