১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৪:২০:০২ পূর্বাহ্ন


মোদির কারণেই বাংলাদেশে একদলীয় শাসনের সূত্রপাত
নিউইয়র্ক অফিস
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৫-২০২৪
মোদির কারণেই বাংলাদেশে একদলীয় শাসনের সূত্রপাত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি


২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে, নয়াদিল্লি তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একজন শীর্ষ কূটনীতিককে ঢাকায় পাঠিয়ে নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছিল। ভারতের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের প্রাক্তন সামরিক শাসক জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি করানো। নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠে যায়। সরকারের নেতৃত্বে ছিল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রীকে কার্যত গৃহবন্দি করা রাখা হয়েছিল, ঢাকায় তার বাড়ির চারপাশে পুলিশ মোতায়েন করে রাখা হয়েছিল। তার বাসার চারপাশের রাস্তা অবরোধ করে রাখা হয়। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধীদল নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিয়ে আসছিল। জাতীয় পার্টির প্রধান এরশাদকে একজন সম্ভাব্য কিংমেকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, তিনি বাংলাদেশের দুটি প্রধান দলের যে কোনোটিকেই ক্ষমতায় আনতে সক্ষম ছিলেন, তবে তিনি নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি পরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে, ভারতীয় কূটনীতিকের তার নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশে আসার কারণটি ছিল কট্টরপন্থী ইসলামি দল এবং বিএনপির মিত্র জামায়াতে ইসলামীর উত্থান রোধ করা। তবে ভারতের এই পদক্ষেপকে একতরফা নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়েছে।

এই পদক্ষেপকে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কারণ আওয়ামী লীগের মতো ভারতের পছন্দসই কৌশলগত রাজনৈতিক মিত্রকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ভারতের এই পদক্ষেপটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। অনেক বছর পর নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে এরশাদ জানান, ২০১৪ নির্বাচনে বয়কটের কারণে ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৪টিতে একক প্রার্থী ছিল, ফলে ভোট শুরু হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সেইসময় নয়াদিল্লির গদিতে ছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ), হাসিনা সেই সময়ে বাংলাদেশে নির্বাচন পরিচালনার প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেন। এর আগে বাংলাদেশ এমন একটি ব্যবস্থা অনুসরণ করছিল যেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনের সময় একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের রীতি ছিল। কিন্তু হাসিনা ২০১১ সালে এটি বাতিল করে দেন। নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার পর কার্যত বিরোধীদল ছাড়াই আওয়ামী লীগ দীর্ঘায়িত শাসনের সূচনা করে।

২০১৪ সালে ভারতে ইউপিএর হাত থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএর হাতে ক্ষমতার হস্তান্তরের পরে নয়াদিল্লির বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তনের প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও হাসিনার প্রতি ভারতের সমর্থন অবিচল ছিল। বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির অধীনে হাসিনার প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন ১০ বছর ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে তাদের মধ্যে আদর্শগত মিল এবং মুজিব ও গান্ধী পরিবারের মধ্যে দৃঢ়বন্ধন থাকা সত্ত্বেও, গত এক দশকে ভারতে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। মোদি এবং হাসিনা তাদের সম্পর্কের গভীরতা এবং সহযোগিতাকে অতুলনীয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং অন্যদের অনুকরণের জন্য এটিকে একটি মডেল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ‘হিন্দুত্ব নীতি’ নিয়ে চলা বিজেপি এবং দৃশ্যত ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের মধ্যে আদর্শগত বাধা অতিক্রম করে সেই ২০১৪ সাল থেকে, মোদির ভারত এবং হাসিনার বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কেবল গভীরই হয়নি বরং প্রসারিত হয়েছে।

কিন্তু কিছু সমালোচক দীর্ঘকাল ধরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাবের দিকটি নিয়ে সমালোচনা করে আসছেন। তারা উল্লেখ করেছেন যে হাসিনা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্্যাপনে মোদিকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের দেশে রক্ষণশীল মুসলমানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন। বিশেষ করে এই বছরের শুরুতে হাসিনা পুনর্নির্বাচিত হওয়ার পর বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে এবং তীব্র হয়েছে। আবারও নির্বাচনটি অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল, বিরোধীদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন এবং সরকারি পক্ষপাতিত্বের ব্যাপক অভিযোগ সামনে এসেছে। নয়াদিল্লি নির্বাচনের আগে হাসিনা সরকারের ধারাবাহিকতার জন্য লবিং করেছিল এবং ভোটের পরে তার ম্যান্ডেটকে সমর্থন করেছিল। এটি ভারতের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়াকে উসকে দেয় এবং দুই দেশের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর দ্বারা হত্যা, পানির অসম বণ্টন এবং ভারতের শক্তিশালী অস্ত্র বাণিজ্য কৌশল নিয়ে বাংলাদেশে পুরোনো ক্ষতকে জাগিয়ে তোলে। হাসিনার সরকারের প্রতি অসন্তোষ ক্রমেই অন্য ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযান। বেশিরভাগ ভারতীয় পণ্য বয়কটের আহ্বান জানানো হয়েছে অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে। নির্বাচনের পর থেকে পাঁচ মাসের মধ্যে হাসিনা এবং ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের একটি গভীর ও আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। কারণ স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পাশাপাশি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ভারতের বড়ধরনের প্রভাব রয়েছে। এই শক্তিশালী বন্ধন সত্ত্বেও ভূরাজনৈতিক গতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ মাঝেমধ্যে ধাক্কা খেয়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে, দক্ষিণ এশিয়ায় এবং তার বাইরে চীনের প্রভাব বিস্তার বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি অপ্রত্যাশিত আঙিনায় পরিণত করেছে, যার সঙ্গে শুধু ভারত ও চীনই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও জড়িত।

ভারতবিরোধী মনোভাব

হাসিনার ২০২৪ সালের নির্বাচনী বিজয় এতোটাই বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল যে, দ্য ইকোনমিস্ট এটিকে একটি ‘প্রহসন’ হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সরকারগুলো এটিকে অবাধ বা ন্যায্য বলে মনে করেনি। সরকারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে দমন করার পর বিরোধীরা মূলত নির্বাচন বয়কট করে। বিএনপির নেত্রী তথা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, সন্দেহজনক অভিযোগে ২০১৭ সাল থেকে গৃহবন্দি। আওয়ামী লীগ সরকার হাজার হাজার বিরোধী কর্মী ও নেতাদের আটক করে। ভোটে পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ভোটারদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষকরা মনে করেন এটি ১০ শতাংশেরও কম। আনুমানিক ৪১ শতাংশের সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে এই পরিসংখ্যান মেলে না। সরকারি হিসাবে গত নির্বাচনের ভোটের হার ২০০৮ সালে বাংলাদেশে শেষবার সত্যিকারের প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনে দেখা ভোটের অর্ধেকেরও কম। ২০২৪ সালের নির্বাচনটি ছিল বাংলাদেশে টানা তৃতীয় নির্বাচন যা বয়কট এবং ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত। চীন ও রাশিয়া ২০২৪ সালের নির্বাচনে হাসিনার সরকারকে সমর্থন দেওয়ার জন্য ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে। প্রকৃতপক্ষে, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কূটনৈতিক সমর্থনের কারণে বাংলাদেশ তার অন্যায্য ভোটের প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। এটি ২০১৮ এবং ২০১৩ সালে হাসিনার আগের দুটি নির্বাচনী বিজয়ের প্রতি ভারতের সমর্থন প্রতিফলিত করে, যেগুলো অত্যন্ত বিতর্কিত ছিল।

অসংখ্য অভিযোগের কারণে বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে শক্তিশালী ভারতবিরোধী মনোভাব ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) দ্বারা সীমান্তে বেসামরিক নাগরিকদের অব্যাহত হত্যাকা-গুলো এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। বিএসএফ বলছে যে, আন্তঃসীমান্তে চোরাচালান, বিশেষ করে গরু ও মাদক পাচারের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে অনেক সাধারণ মানুষ যারা সীমান্ত এলাকায় নো-ম্যানস ল্যান্ডে চলে যায় কারণ তাদের বাড়ি এমনভাবে দ্বিখ-িত হয়েছে যাতে এরকমটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক সীমান্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করে। মানবাধিকার সংস্থার সাম্প্রতিক তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে শুধু ২০২৩ সালে সীমান্তে কমপক্ষে ৩১ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন এবং তাদের মধ্যে ২৮ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমান্তের বেশির ভাগ অংশে তারের বেড়া স্থাপনের মতো সীমান্তকে আরো ভালোভাবে সুরক্ষিত করার জন্য ভারতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই হত্যাকা-গুলো অব্যাহত রয়েছে।

২০১৫ সালে নয়াদিল্লিতে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার স্থলসীমান্ত চুক্তির জন্য সংসদীয় অনুমোদনের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন দাবি করে। এর অংশ হিসেবে সীমান্ত উত্তেজনা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত ছিটমহল বিনিময় করতে সম্মত হয়েছিল। সব মিলিয়ে ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে এবং ৫১টি ভারতে স্থানান্তর করা হয়েছে, এই ছিটমহলে বসবাসকারীরা যে কোনো একটি দেশে বসবাস ও নাগরিকত্ব বেছে নিতে পারবেন। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই ১৯৭৪ সালে এই চুক্তিটি অনুমোদন করেছে এবং ভারত তা স্বাক্ষর করার জন্য চার দশকেরও বেশি সময় নিয়েছে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও আজও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। আরেকটি দীর্ঘস্থায়ী বিরোধ হলো ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ৫০টিরও বেশি নদীর পানি বণ্টন, বিশেষ করে তিস্তা নদীর ইস্যুটি তীব্রতর হচ্ছে। ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি বাংলাদেশকে অসন্তুষ্ট করেছে, বিশেষ করে ভারত যখন প্রতিশ্রুতিমতো শুষ্ক মরশুমে নদীর পানির অংশ ছেড়ে দিতে ব্যর্থ হয়, এর ফলে একশ্রেণির মানুষ উল্লেখযোগ্য প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েন। 

তৃতীয় পয়েন্ট হলো অভিবাসন। ভারত বাংলাদেশ থেকে তার উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গে কথিত বড় আকারের অভিবাসনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, উভয়ই বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী। এই সমস্যাটি মূলত বিজেপি এবং তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী মিত্রদের দ্বারা চালিত, যারা মুসলিম বিরোধী মনোভাবকে সমর্থন করে। আসাম এবং পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ বাংলাভাষী ভারতীয় মুসলমানকে ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে গণ্য করে জোরপূর্বক নির্বাসনের হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং বিজেপির একজন সিনিয়র নেতা তথা ভারতের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাদের ‘উইপোকা’ বলে উল্লেখ করেছেন। উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলার আরেকটি কারণ হল ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, যার অধীনে বিজেপি সরকার বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে নিপীড়িত হিন্দুদের নাগরিকত্ব এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ দেওয়ার আইন প্রতিষ্ঠা করেছে। আইনটি ব্যাপকভাবে মুসলিম বিরোধী বলে ধরা হয় কারণ এটি মুসলিম ব্যক্তিদের একই অধিকারকে স্পষ্টভাবে অস্বীকার করে।

মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে জোরপূর্বক অভিবাসনের খবর পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশি অভিবাসন নিয়ে বিজেপির অসামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য এই অঞ্চলে মুসলিম বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলে। বিপরীতে দক্ষ শ্রমের ঘাটতির কারণে ভারত থেকে শ্রমিকদের বাংলাদেশে অভিবাসনের ঘটনাটি নিয়ে খুব কম সমস্যাই দেখা দিয়েছে কারণ এর জেরে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুষ্ট হয়েছে। ঢাকাভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ২০১৫ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় ৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করে এবং তাদের বার্ষিক রেমিট্যান্স ৪ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়নের মধ্যে থাকে। এই পরিসংখ্যান সম্ভবত আজ অনেক বেশি।

নিরাপত্তা উদ্বেগগুলো দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককেও জর্জরিত করেছে, বিশেষ করে যখন ভারত থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নয়, তখন নয়াদিল্লির আশঙ্কা বেড়ে যায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের মধ্যে হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রথম মেয়াদে এই ধরনের উত্তেজনা বজায় ছিল। ২০০৪ সালে, চট্টগ্রাম বন্দরে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসার পরে এবং আসামের ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্টসহ ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার পরে উত্তেজনা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের কথিত রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অবশ্য একতরফা ব্যাপার নয়। অতীতে, ভারত বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে শান্তিবাহিনী নামে পরিচিত উপজাতীয় বিদ্রোহীদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। এই দলটি প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। ১৯৯৭ সালে বিদ্রোহের অবসান ঘটে, যখন হাসিনা বিদ্রোহীদের সঙ্গে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছান এবং একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। যদিও উভয় দেশে বিদ্রোহ হ্রাস পেয়েছে, ভারতের উত্তর-পূর্বে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনো ভঙ্গুর-মণিপুরে চলমান সহিংসতাই তা প্রমাণ করে। অনেক বাংলাদেশি নয়াদিল্লিতে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে বিরোধিতা জানায়, তাদের মতে ভারত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার আড়ালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। ভারতের ভবিষ্যৎ গতিপথ এবং বাংলাদেশের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে, বিশেষ করে হিন্দু জাতীয়তাবাদের ওপর বিজেপির জোর এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে আরো বেশি করে জাহির করার আকাক্সক্ষার কারণে।

বাণিজ্যের কৌশল

বিগত ১৫ বছরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে সীমান্ত হাটের মতো বাণিজ্য প্রায় চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৭ সালে অর্থনীতিবিদ জয়শ্রী সেনগুপ্ত অনুমান করেছিলেন যে এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য থেকে এসেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ভারতের জন্য উল্লেখযোগ্য ভোক্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বিশেষ করে পর্যটন ও চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে। ২০১৬ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্যুরিজম অ্যান্ড ট্রাভেল ম্যানেজমেন্টের একটি সমীক্ষা প্রকাশ হয় যাতে দেখা যায় বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন বাজার, ২০১৬ সালে পর্যটক আগমন ১.৩৮ মিলিয়ন বেড়েছে, যা ১৯৮১ সালে ২ লাখের কম ছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই পর্যটকদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ পর্যটক ভিসায়, ৭.৩ শতাংশ মেডিকেল ভিসায় এবং ৫.৯ শতাংশ ব্যবসায়িক ভিসায় এসেছে। মাথাপিছু খরচ গড়ে ৫২ হাজার টাকা ৷ হিসাব করলে ২০১৬ সালে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কোভিড-১৯ মহামারি দ্বারা সৃষ্ট ব্যাঘাতের পরে পর্যটকপ্রবাহ আবারও ফিরে এসেছে পূর্বের অবস্থানে। দুটি দেশের মধ্যে বাস এবং ট্রেন রুট প্রসারিত রয়েছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে উপকৃত হয়েছে ট্রানজিট সুবিধার সম্প্রসারণ এবং বাংলাদেশের উভয় সামুদ্রিক বন্দর, চট্টগ্রাম ও মংলায় প্রবেশাধিকার মেলায়। এই অ্যাক্সেসটি উত্তর-পূর্ব এবং অন্যত্র ভারতীয় ব্যবসায়িকদের অর্ধেকেরও বেশি পরিবহন খরচ কমিয়ে দিয়েছে ।

তবুও বিগত ১৫ বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের চারগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় রফতানি ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় আমদানি ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং চীনের পর বাংলাদেশ ২০১৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম রফতানি গন্তব্য। ভারত বিদ্যুৎ, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস এবং তেল রফতানি করে বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০১৭ সালে, আদানি গ্রুপ, মোদি সরকারের ঘনিষ্ঠ একটি কনসোর্টিয়াম, ঝাড়খন্ড রাজ্যের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই চুক্তি বাংলাদেশকে অসুবিধায় ফেলেছে। বাংলাদেশের প্রতি মোদি সরকারের মনোভাব সম্ভবত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণিয়াম জয়শঙ্করের লেখা সাম্প্রতিক বই- ডযু ইযধৎধঃ গধঃঃবৎং থেকে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, দেশের অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার সবসময় বিদেশ নীতির একটি শক্তিশালী চালক।

আসলে অর্থনৈতিক কূটনীতি হলো বেশ জটিল একটি বিষয় এবং বিতর্কে পূর্ণ। যদিও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কগুলো সাধারণত লেনদেনমূলক হয়, কিছু সম্পর্ক একতরফা অসম হয়। ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যের বহুল প্রচলিত একটি ধারণা হলো যে, ঢাকাকে ক্রমাগতভাবে আদানি চুক্তির মতো প্রতিকূল বিষয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক বাণিজ্য সমিতি অভিযোগ করেছে যে নয়াদিল্লি এমন পণ্যগুলোর ওপর অশুল্ক বাধা আরোপ করেছে যেখানে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা রয়েছে। অধিকন্তু, এটি একটি সাধারণ প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে যখনই বাংলাদেশে চাল, পেঁয়াজ এবং চিনির মতো প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর ঘাটতি দেখা দেয়, ভারত তাদের ওপর রফতানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বাংলাদেশ এখন মিশর, তুরস্ক এবং ব্রাজিলের মতো দেশগুলো থেকে আমদানির পরিবর্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর জন্য ভারতের ওপর অনেক বেশি নির্ভর করে, যা শুধু তার দুর্বলতাকে বাড়িয়ে তোলে।

মোদি সরকারের আরেকটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিল কোভিড মহামারি চলাকালীন বাংলাদেশে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন সরবরাহ স্থগিত করা। যদিও বাংলাদেশ ভ্যাকসিনের উৎপাদন শুরু হওয়ার আগেই লক্ষ লক্ষ ডোজের জন্য সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়াকে অগ্রিম অর্থ প্রদান করেছে। ফ্রন্টলাইন কর্মীদের সুরক্ষার জন্য এই ডোজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এই পদক্ষেপটি ভারতের কথিত ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি থেকে বিচ্যুতির উদাহরণ। এই সংকটময় সময়ে, চীন বাংলাদেশকে তার সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করে। ভারতে মোদির শাসনামলের এক দশক পর, বাংলাদেশের মানুষ তাদের সরকারের নয়াদিল্লিতে হিন্দুত্ববাদী শাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রয়াসে সহায়তা করতেও ভারত ক্রমাগত ব্যর্থ হচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য অর্থায়ন প্রকল্পগুলোতে ভারতের স্বার্থ এবং প্রতিশ্রুতিগুলো মূলত আঞ্চলিক সংযোগের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এদিকে নেপাল এবং ভুটানে বাংলাদেশি রফতানি এবং পরিষেবাগুলোর জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রদান এখনো অধরা রয়ে গেছে। উপরন্তু, নয়াদিল্লির প্রতিশ্রুত ঋণ এবং তহবিল বিতরণ হতাশাজনকভাবে ধীর। গত বছরের আগস্টে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের লাইন অব ক্রেডিটের অধীনে প্রকল্পগুলোর একটি পর্যালোচনা সভায় দেখা গেছে যে, একটি ৭.২ বিলিয়ন ডলার প্রোগ্রামের অধীনে ভারত যেখানে উন্নয়নমূলক কাজের জন্য অন্যান্য দেশকে ঋণ দেয়, ভারত মাত্র তার ২০ শতাংশ ছাড় করেছে।

বাংলাদেশে একটি নির্দিষ্ট দলের পক্ষে ভারতের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বিরোধীদের প্রান্তিক করে দিয়েছে এবং বাস্তবে দেশে একদলীয় শাসনের সূত্রপাত করেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের প্রতি নয়াদিল্লির এই অবহেলা ইতিমধ্যেই প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মোদির বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে আসুক বা রাহুল গান্ধীর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ভারত জোট সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন পেয়ে থাকুক না কেন, ভারতে নির্বাচনের পর বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাবের যে পরিবর্তন হবে তা বাংলাদেশের মানুষ খুব একটা আশা করে না। ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দেশের সরকারের বন্ধুত্বের বিষয়ে জনগণের অবিশ্বাস ও হতাশার চোরা স্রোত এখন বাংলাদেশের বুকে বয়ে যাচ্ছে। বিজেপি যদি অপ্রতিরোধ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং সেখান থেকে সম্ভাব্যভাবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান পরিবর্তন করে ‘হিন্দু সংস্কৃতি’ পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করে, তাহলে নাটকীয়ভাবে পটপরিবর্তন হতে পারে।

সূত্র : হিমাল সাউথএশিয়ান

শেয়ার করুন