০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০১:২৭:১৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


হাসিনার পলায়ন : যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের কি প্রত্যাশা পূরণ
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৮-২০২৪
হাসিনার পলায়ন : যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের কি প্রত্যাশা পূরণ পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করছেন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা/ছবি সংগ্রহীত


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া টর্নেডোর ছোবলে মুহূর্তের মধ্যে সাজানো গোছানো আওয়ামী লীগ সরকার তছনছ। ক্ষতবিক্ষত শেখ হাসিনার ১৬ বছরের ক্ষমতা, দাম্ভিকতার। ৫ আগস্টের ওই টর্নেডোতে লণ্ডভণ্ড আওয়ামী লীগ। দাম্ভিক শেখ হাসিনা পালিয়েছেন, অন্যসব মন্ত্রীরাও কেউ আগে পালিয়েছেন, কেউ যেতে গিয়ে আটক হচ্ছেন। কেউ লুকাচ্ছেন বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতার কাছে ধরা পড়ার ভয়ে। উপদেষ্টা, মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িঘর ব্যাবসা-বাণিজ্য ছেড়ে সবাই দেশ ছেড়ে পালানোর উপায় খুঁজছেন। দীর্ঘ দেড় যুগের সব দম্ভচূর্ণ। 

অথচ গত ২০২৪ এর জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ঠিক এক বছরেরও বেশি সময় আগ থেকে জো বাইডেনের বিশ্বের প্রতিটা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভিশন, এটা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় সব পরাশক্তিসমূহ এক জোট হয়ে বারবার শেখ হাসিনা সরকারকে বহু আবেদন নিবেদন অনুরোধ করেছেন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের। বার বার এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকগণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বারবার ডেকে নিয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট। হুমকি ধমকিও কম দেয়া হয়নি। নির্বাচনে কারচুপি ভয়ভীতি দেখানোর সঙ্গে জড়িতদের বাংলাদেশের জন্য নতুন করে তৈরি করা ভিসানীতির আওতায় ফেলে ভিসা ক্যানসেল বা ভিসা দেয়া হবে না বলে পররাষ্ট্র দফতর ঘোষণা দেয়। এছাড়াও একসূত্রে গাথা ছিল র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্মকর্তার উপর নিষেধাজ্ঞা। এমন পদক্ষেপ কম নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এসব আভাস আমলে নেয়নি হাসিনা। 

বারবার শেখ হাসিনা সেটা উপহাস করে দাম্ভিকতার সঙ্গে এড়িয়ে গেছেন। পাল্টা প্রশ্ন রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতির দিকে। সেন্টমার্টিন লোলুপ দৃষ্টি এমনটাও বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবাদ করেছে। ’২৪ এর নির্বাচনের এক সময় বড় তিন দলের মধ্যে সংলাপে বসার চিঠিও দেন ডোনাল্ড লু, সেটা পৌঁছে দেন সে সময়ের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেটাও উপেক্ষিত করে মুহূর্তে তফসিল ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইইউসহ সব দেশ চুপ হয়ে যায়। শেখ হাসিনা নিশ্চিত জানতেন যুক্তরাষ্ট্রের কথা মেনে নির্বাচন দিলে তার দলের ভরাডুবি ঘটবে। ফলে তিনি ক্ষমতা নিশ্চিত করতে ভারতের নিশ্চয়তা ও সহায়তা নিয়ে নির্বাচন (অনেকটাই ভোটারবিহীন, প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাবে নিজ দলের স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা তৈনি করে) অনুষ্ঠান করে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। 

যাতে অন্যসব বারের মতো বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দল বাইরে ছিল। এমনকি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ওই সময় কারাগারে বন্দি করেন বিএনপি মহাসচিবসহ। বাকি ঘটনা সবারই জানা। খুব কী বেশি দিন হলো শেখ হাসিনার নতুন এ সরকারের বয়স? তা ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনায় টানা ১৫ বছরের অভিজ্ঞ এবং বিএনপিসহ বিরোধী দলের বহু আন্দোলন সংগ্রাম মুহূর্তে উড়িয়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে চলা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা উড়ছিল বাংলাদেশের আকাশে। যাদেরকে মাটিতে নামাবে কে কখন সেটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা শক্তিরও বাইরে। 

এরই মধ্যে সামান্য ছাত্রদের আন্দোলন তিল থেকে তালে পরিণতই শুধু নয়, গোটা বিশ্বে দুর্বার গতির এক ছাত্র আন্দোলনের নজির স্থাপন করে দাবি আদায় করে এরপর স্বৈরাচারি সরকারের নির্মম পরাভূত করে ফেলেছে, ছাত্রদের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে জনতা মিলে একাকার হয়ে। বহু ছাত্র ও আম জনতার প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে হাসিনা সরকারের নির্দেশে তার আইনশৃংলা বাহিনী, সেই দলীয় সন্ত্রাসীরা। লাশ ও রক্তের বন্যা বইয়েও টিকতে পারেনি। নির্মমভাবে বিদায় নিতে হয়েছে সামান্য ক’দিনের আন্দোলনে। যা শুরু হয় অহিংস। এবং শেষাব্দি অহিংসই ছিল, কিন্তু ছাত্র ও আমজনতাকে ঠেকাতে সরাসরি গুলিতে শত শত প্রাণ কেড়ে নেয়ার পর আরো বিধ্বংসীরূপ ধারন করে প্রতিহত করে ছাত্র জনতা। শুধু লাঠি, ইট পাটকেল নিয়ে। শেষ পর্যন্ত জয় হলো রুদ্রমূর্তি ধারণ করে ফুসে ওঠা ছাত্র জনতার দাবির মুখে। যা প্রথম ৯ ছিল। মুহূর্তে হয়ে যায় এক দফা। শেষ পরিণতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন। টানা ১৬ বছর ক্ষমতার অবসান। শেষ পর্যন্ত তাকে ভারত পালাতে হলো। 

কিন্তু এতসবের পর একটি হিসেব অনেকেই মেলাতে চেষ্টা করছেন। আর সেটা যখন ছাত্ররা প্রফেসর ইউনূসকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার দাবিতে অনঢ় যখন, ঠিক তখন থেকে। তাহলে এখানে কী কোনো প্রি-প্ল্যান কাজ করছিল। নতুবা ছাত্ররা ছাত্রত্বের আন্দোলনের বাইরে যেয়ে কেন রাজনৈতিক দলের মতো ‘বাংলা ব্লক’ বা বাংলাদেশ অচল এমন কর্মসূচি দিয়ে গোটা দেশের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। তাহলে এখানে কী কোনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদের মতের প্রতিফলন ঘটলো? নতুবা শেষ পর্যন্ত দেশে এত লোক থাকতেও প্রফেসর ইউনূসকে বেছে নেয়া। যিনি কিনা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ওইসব শক্তিধর দেশের পরম বন্ধু ও একজন জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব। 

যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের প্রিয়পাত্র ইউনূস 

ইউনুসকে কতটা পশ্চিমারা পছন্দ করেন তার একটা নমুনা নিম্নে- 

১৮ মে ২০২২। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্ধোধন উপলক্ষ্যে এক অনুষ্ঠানে বললেন তাকে পদ্মা সেতু থেকে দুইবার চুবানি দিয়ে তুলে দেয়া উচিৎ। ড. ইউনূসকে ওই কথা বলেছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে ম্যালা অভিযোগ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর। এরপর মামলায় হাজিরা দেয়া। ইউনূসের ভাষায় হয়রানি করা। বিচারকের সামনে দাঁড়াতে লোহার খাচার মধ্যে দাঁড়াতে হয়েছিল। সে সময় ইউনূসকে হয়রানি না করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার রায় এবং দুদকের মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্বস্থানীয় ২৪২ ব্যক্তি। 

চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরও ছিলেন। চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুটি মামলা পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে আরও ছিলেন তাওয়াক্কুল কারমান, নাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা ও হুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোসসহ ১৬ জন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রয়েছেন ৬ জন। তাঁদের মধ্যে ওরহান পামুক ও জে এম কোয়েটজি রয়েছেন। জোসেফ স্টিগলিৎজসহ অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী আছেন ১২ জন। এ ছাড়া রসায়নে ৩৬ জন নোবেল বিজয়ী, চিকিৎসাশাস্ত্রে ২৯ জন নোবেল বিজয়ী এবং পদার্থবিজ্ঞানে ২৬ জন নোবেল বিজয়ী রয়েছেন।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, যুক্তরাজ্যের ধনকুবের স্যার রিচার্ড ব্রানসনসহ শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন চিঠিতে স্বাক্ষরদাতাদের তালিকায়। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সামরিক কমান্ডারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা ছিলেন। 

শেখ হাসিনা ছিলেন ইউনুসের ব্যাপারে অনঢ়

কিন্তু সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী কারোরই কথা না রেখে বা এড়িয়ে চলেন নিজস্ব গতিতে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছিলেন প্রতিনিয়ত। বলেছিলেন আইন চলবে তার নিজস্ব গতিতে। বিশ্বের এত সব নামীদামী ব্যাক্তিত্বদের অহ্বান থ্রোয়াই কেয়ার করে হয়রানির চরম শিখরে নিয়ে চরমভাবে অপদাস্ত করেন শেখ হাসিনা। 

সেই শেখ হাসিনার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে মাত্র ৪৫ মিনিটের নোটিশে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যান। 

আর তারই সে স্থানে সেই ড. ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে ৬ আগস্ট মঙ্গলবার রাতে বঙ্গবভনে। শেখ হাসিনা কোথায় আশ্রয় লাভ করবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ধর্ণা দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশে। আর প্রফেসর ইউনূস তারই স্থানে স্বসম্মানে বসতে যাচ্ছেন। 

ফলে এটা প্রকারান্তে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের মতের প্রতিফলন ঘটলো বললে বাড়িয়ে বলা হবে কি! 

ইন্দো প্যাসেফিক 

বাংলাদেশ বিশ্বমানচিত্রের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেখানে ইন্দো প্যাসেফিকের নিয়ন্ত্রণে বা এ অঞ্চলে চীনকে প্রতিহত করতে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সমর্থন বড্ড প্রয়োজন। শেখ হাসিনা এটা কৌশলে এড়িয়ে গেছেন বহুবার। কোয়াড বা চারদেশী (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ভারত) জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা তার চায়না স্বার্থ উপেক্ষা বা চায়না সম্পর্ক বিনষ্ট করতে কখনই রাজী হননি। 

এমন দৃষ্টিকোণ থেকে শেখ হাসিনা বাধা দূর হলো এটা বলা যাবে কী সেটা সময় বলে দেবে। 

শেয়ার করুন